মিয়ানমার শর্ত সাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে রাজি। তবে যেসব রোহিঙ্গারা নিজেদের দাদা, মা ও সন্তান এই তিনের মিয়ানমারে অবস্থানের প্রমাণ দিতে পারবে কেবল তাদেরই নাগরিকত্ব দেয়া হবে।
এছাড়া ১৯৮২ সালের মিয়ানমারের আইন অনুযায়ী যেসব রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ভ্যারিফিকেশন কার্ডের (এনভিসি) কাগজপত্র দেখাতে পারবে নাগরিকত্ব দেয়া হবে তাদেরও।
মিয়ানমারের এমন শর্ত মানতে রাজি নন কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। তাদের দাবি, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমার তাদেরকে নাগরিক হিসেবে কোনো কাগজপত্র দেয়নি। ফলে প্রমাণ সাপেক্ষে নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়টি মিয়ানমারের চালাকি ছাড়া কিছুই নয়।
এদিকে কয়েকশ হিন্দু রোহিঙ্গা পরিবার মিয়ানমারে ফিরতে রাজি হলেও মুসলিম রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব, স্বাধীন চলাফেরার নিরাপত্তা প্রদান করলে স্বদেশে ফেরত যাবে বলে জানিয়েছেন। তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে একই দাবি করছেন ক্রিস্টান রোহিঙ্গারাও।
আজ রোববার কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ও রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ে জানান, তার দেশ রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে প্রস্তুত, তবে শর্তসাপেক্ষে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় উভয় পক্ষের আলোচনার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত বৈঠক হবে ঢাকায় ফিরে।
মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ১৯৮২ সালের মিয়ানমারের আইন অনুযায়ী প্রত্যেককে নাগরিকত্ব দেয়া হবে। এছাড়া যারা দাদা, মা ও সন্তান এই তিনের মিয়ানমারে অবস্থানের প্রমাণ দিতে পারবে, কেবল তাদেরই নাগরিকত্ব দেয়া হবে। একইভাবে ন্যাশনাল ভ্যারিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) অনুযায়ী যারা কাগজপত্র দেখাতে পারবে, তারাও নাগরিকত্ব পাবেন।
মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ে বলেন, দুই দিন ধরে একাধিক বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের প্রস্তুতি সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের অবহিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিন দফা বৈঠকে রোহিঙ্গাদের দাবিগুলোও জানা গেছে।
মিন্ট থোয়ে বলেন, প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে মিয়ানমার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে তিন ক্ষেত্রে আলোচনা করার। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে, তা আবারও হবে। একই সঙ্গে আসিয়ানের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা হবে। মার্চ মাসে দেয়া আসিয়ানের রোহিঙ্গাসংক্রান্ত প্রস্তাবনাও বিবেচনা করা হবে।
রোববার দ্বিতীয় দিনের মতো মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি সকালে কুতুপালং ৪ নম্বর ক্যাম্পে যায়। টানা ২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বৈঠকে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের কাছে রোহিঙ্গারা নিজেদের নানা দাবির কথা জানান।
তাদের দাবির মধ্যে অন্যতম, নাগরিকত্ব, স্বাধীন চলাফেরার নিরাপত্তা প্রদান করলে তারা স্বদেশে ফেরত যাবে। মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা তাদের কথা শোনেন এবং রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরার আহ্বান জানান। ফেরত গেলে তাদের দাবিগুলো বিবেচনা করার আশ্বাস দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বৈঠকে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গারা।
গতকাল শনিবার মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ে’র নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল কক্সবাজার পৌঁছায়। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন এবং রোহিঙ্গাদের ৪০ জনের একটি দলের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় আলাপ আলোচনা করেন তারা।
এর আগেও ২০১৭ সালের ১৯ ও ২০ মার্চ রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে রোহিঙ্গাদের ‘মিথ্যেবাদী’ বলে পাশ কাটাতে চেয়েছিল মিয়ানমার। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ায় রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখে দ্বিতীয়বারের মতো মিয়ানমারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলটি রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে আসেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০১৭ সালের অগাস্টে মিয়ানমারের কয়েকটি সীমানাচৌকিতে কথিত হামলার ধুয়ো তুলে রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু হয়। অভিযানে ব্যাপকভাবে হত্যা, ধর্ষণ এবং বাড়ি-ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রাণে বাঁচতে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। আগে থেকে থাকা রোহিঙ্গাদের নিয়ে এ সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় এগারো লাখের বেশি।