৫০ জেলায় ডেঙ্গুর সন্ধান

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেঙ্গু
ফাইল ছবি

দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, এরই মধ্যে দেশের ৫০ জেলায় ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান মিলেছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুত বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। ফলে ভয় আর আতঙ্ক ভর করেছে সারা দেশের প্রতিটি ঘরেই।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, রাজধানী ছাড়া দেশের বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগ পরীক্ষার সরঞ্জাম নেই। ফলে বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে জ্বর নিয়ে রোগীরা ছুটছে। এ রোগে ফরিদপুর, সাভার ও রাজধানী ঢাকায় গতকাল সোমবার আরো তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে দুই শতাধিক।

যশোরে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা। সেখানে স্থানীয়ভাবে অনেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে বলে চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেছেন। ডেঙ্গু বিষয়ে পরামর্শের জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে খোলা হয়েছে হেল্প ডেস্ক। অনেক জেলায় চালানো হচ্ছে সচেতনতামূলক প্রচারণা।

ফরিদপুর : ফরিদপুরে চার দিন ডেঙ্গু জ্বরে ভুগে মৃত্যুর কাছে হারলেন সেলিম বিশ্বাস (৪০)। গতকাল সোমবার সকালে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাঁর মৃত্যু হয়। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে গত রবিবার বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। তাঁর বাড়ি চরভদ্রাসনের লোহারটেক বাছার ডাঙ্গী গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মৃত কদম বিশ্বাসের ছেলে।

সেলিমের স্ত্রী মুন্নী আক্তার জানান, ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি গ্যারেজে কাজ করতেন সেলিম। এক মাস আগে নিজেই একটি গ্যারেজ করেছিলেন। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় জ্বরে আক্রান্ত হলে প্রথম দুই দিন ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খেলেও জ্বর না কমায় রবিবার দুপুরে তিনি ঢাকা থেকে চরভদ্রাসনের গ্রামের বাড়ি চলে আসেন। পরে সেলিমকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল সোমবার সকালে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।

এদিকে ফরিদপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ৩১ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। এর মধ্যে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৯ জন এবং ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে দুজন চিকিৎসাধীন।

সাভার (ঢাকা) : ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গতকাল সোমবার দুপুরে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন জুয়েল মাহমুদ নয়ন (৩৩) নামের এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি ধামরাইয়ের কুল্লা ইউনিয়নের আবদুল জলিল মিয়ার ছেলে। জুয়েলের স্বজনরা জানায়, গত শনিবার জ্বর নিয়ে ঢাকা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যান জুয়েল। সেখানেই তিনি ডেঙ্গুর বিষয়টি নিশ্চিত হন। জুয়েলকে ‘লাস্ট স্টেজে’ হাসপাতালে আনা হয়েছে জানিয়ে তাঁকে যেকোনো হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।

তখন তাঁকে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। পরে এনাম মেডিক্যালেই চিকিৎসাধীন দুপুরে তিনি মারা যান।

এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপক মো. ইউসুফ জানান, গত এক সপ্তাহে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তাঁদের হাসপাতালে ৪১ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল।

সাভারের থানা বাসস্টান্ডের দীপ ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপক রাশেদুল হাসান সোহাগ জানান, গত ১৫ দিনে ক্লিনিকটিতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ১৫ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত কয়েক দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছে।

ঢাকা : গতকাল সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন রিতা আক্তার নামে এক পোশাক শ্রমিক। রিতা গত ২৬ জুলাই থেকে ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন ছিলেন জানিয়ে ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, অবস্থার অবনতি হলে রিতাকে আইসিইউয়ে রাখা হয়েছিল। গতকাল সকাল ৮টার দিকে তিনি মারা যান। গাজীপুর জেলার টঙ্গীর বিসিক এলাকায় থাকতেন রিতা। সেখানেই একটি পোশাক কারখানায় তিনি চাকরি করতেন।

যশোর : যশোরে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা। ঢাকায় না গিয়েও যশোরেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। এমন কয়েকজন চিকিৎসা নিচ্ছে যশোরের বিভিন্ন হাসপাতালে। এর আগে প্রথম দিকে ডেঙ্গু আক্রান্তরা ছিল ঢাকাফেরত। গতকাল সোমবার পর্যন্ত যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ২৬ জন ডেঙ্গু রোগী। সব মিলিয়ে গত ১১ দিনে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছে ৩৭ জন। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৪ জন জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছে।

চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। গত কয়েক দিন নগরে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক মিলে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ-ছয়জন করে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হলেও গত ২৪ ঘণ্টায় এক লাফে প্রায় পাঁচ গুণ বেড়ে ভর্তি হয়েছে ৪২ জন।

বগুড়া : বগুড়ায় ৭৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ভর্তি আছে ৪০ জন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি আছে সাতজন। ২৪ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। আর ছয়জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আক্রান্তদের সবাই ঢাকা থেকে শরীরে এডিস মশার জীবাণু নিয়ে বগুড়ায় আসে। আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য শজিমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হালিমুর রশিদের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বহির্বিভাগের সামনে হেল্প ডেস্ক খোলা হয়েছে। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মো. আরিফুর রহমান তালুকদার জানান, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও হেমোরেজিক ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার কোনো সরঞ্জামাদি এখানে নেই। রোগীদের জাতীয় গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

রংপুর : গত ২৪ ঘণ্টায় আরো সাতজন ডেঙ্গু রোগী রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। ৩০ রোগীর মধ্যে তিনজন রংপুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। বাকিরা ঢাকায় আক্রান্ত হয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসে চিকিৎসা নিচ্ছে।

রাজবাড়ী : রাজবাড়ীতে গতকাল সোমবার বিকেল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১৯ জন। রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন মাহফুজুর রহমান সরকার বলেন, রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে এরই মধ্যে তিন সদস্যের মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের সতর্ক রাখা হয়েছে। প্রচার-প্রচারণার জন্য ব্যানার টানানো এবং স্কুল-কলেজে স্বাস্থ্যকর্মীদের সচেতনতামূলক সভা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদিকে রাজবাড়ীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে কোনো ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তিতে পড়ছে রোগীরা।

হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জে আরো পাঁচজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে হবিগঞ্জে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল আটে। এর মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চারজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। বাকিদের হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসা চললেও এই হাসপাতালে ডেঙ্গু শনাক্তকরণের কোনো উপকরণই নেই। এদিকে সোমবার দুপুরে হাসপাতালের সভাকক্ষে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এ বিষয়টি জানানো হয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি বেসরবকারি বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলীকে। তিনি এ সময় হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এনে দেওয়ার ঘোষণা দেন।

জামালপুর : ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জামালপুর সদর হাসপাতালে গতকাল সোমবার সকালে নতুন করে আরো চারজন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। নতুন এই চারজনসহ মোট ১৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ নিয়ে জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ জনে।

মাদারীপুর : মাদারীপুরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে ১৩ জন। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে ভর্তি হয়েছে ১০ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ১১ জনই ঢাকা থেকে এডিস মশার জীবাণু নিয়ে মাদারীপুরে এসেছে বলে জানিয়েছেন মাদারীপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শশাঙ্ক চন্দ্র ঘোষ। ফলে জনমনে ভীতি ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সিভিল সার্জন ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু জ্বর শনাক্তকরণের কীট নেই। যে কারণে ডেঙ্গু শনাক্ত করে রোগীরা এলে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।’

গৌরনদী (বরিশাল) : গৌরনদীতে তানিয়া আক্তার নামের এক শিক্ষিকা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। রবিবার সন্ধ্যায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ওই রোগীকে গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে রয়েছে আতঙ্ক।

চাঁদপুর : চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে নতুন ও পুরনো মিলে ডেঙ্গু আক্রান্ত ২১ জন রোগী বর্তমানে ভর্তি চিকিৎসা নিচ্ছে। এর মধ্যে গতকাল সোমবার পর্যন্ত ছয়জনকে ভর্তি করা হয়েছে। চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বেশির ভাগ রোগী রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গ্রামের বাড়িতে ফেরে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ছয় রোগী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। গত শনিবার রাত থেকে রবিবার পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হয়। আক্রান্ত রোগীরা ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিল। সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. শওকত হোসেন জানান, ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাদের জন্য মশারিরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কুড়িগ্রাম : ঢাকায় জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কুড়িগ্রামে ফিরে এসে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে চার ডেঙ্গু রোগী। ডেঙ্গু রোগ শনাক্ত করার কোনো কীট কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে না থাকায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে।

ভোলা : ভোলায় গতকাল সোমবার পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১০ জন ছাড়িয়েছে। এদের মধ্যে ভোলা সদর হাসপাতালে আটজন চিকিৎসা নিচ্ছে।

আগৈলঝাড়া (বরিশাল) : ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত চারজনকে আগৈলঝাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাদের গতকাল সোমবার বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

গোপালগঞ্জ : মুকসুদপুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এক নারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছেন।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে