পদ্মায় পিনাক-৬ ডুবির ৫ বছর আজ

সারাদেশ ডেস্ক

পিনাক-৬
পিনাক-৬

আজ ৪ আগস্ট। মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের মাওয়ার কাছে পদ্মায় পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবিতে শতাধিক যাত্রীর প্রাণহানির পাঁচ বছর। তবে এই দুর্ঘটনায় দায়ীদের এখনও বিচার হয়নি। এ নিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোতে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

তাছাড়া এত বড় একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর এখনও এই রুটে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে বহু ত্রুটিপূর্ণ নৌযান।

universel cardiac hospital

সরকারি হিসেবে ৪৯ জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। আর নিখোঁজ ৫৩ জন। অনেক চেষ্টায় খুঁজে পাওয়া যায়নি দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটি। দুর্ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় আসামিরা জামিনে মুক্ত। মেরিন কোর্টে দায়ের করা মামলাটির কার্যক্রম হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে।

তবে থানায় দায়ের করা মামলাটি চলমান। মুন্সীগঞ্জ কোর্ট ইন্সপেক্টর হেদায়েতুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, তিন-চার মাস আগে এই মামলায় চার্জশিট হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের ৬ নম্বর আমলি আদালতে মামলাটির বিচার প্রক্রিয়াধীন।

এই মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবী সুবাস নন্দী বলেন, আদালতে চার্জশিট গৃহীত হয়েছে। তবে একজন আসামি পলাতক থাকায় মামলাটি ট্রায়ালে যেতে পারছে না। এই পলাতক আসামির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট হয়েছে। তবে যদি তাকে গ্রেপ্তার না করা যায়, তবে প্রক্রিয়া অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। এরপর অন্যসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে মামলাটি ট্রায়ালে যাবে। তবে এসব প্রক্রিয়ায় আরো সময় লাগবে।

পিনাক-৬ লঞ্চের মালিক আবু বক্কর সিদ্দিক কালুর ছেলে ওমর ফারুক লিমন (৩৩) বলেন, ‘আমার বাবার বয়স এখন ৬৭। এসব চিন্তায় অসুস্থ হয়ে বিছনায় তিনি। তারপরও হুইল চেয়ারে করে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। কিন্তু আমি বা আমার বাবা এই ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নই। বরং যারা জড়িত তাদেরকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।’

ওমর ফারুক লিমন বলেন, তিনি স্পেন প্রবাসী। ঘটনার দেড় মাস আগে স্পেন থেকে আসেন বিয়ের কারণে। বিয়ের তারিখ ছিল ২০১৪ সালের ৬ আগস্ট। আর ৪ আগস্ট দুর্ঘটনা ঘটে। এরপর সবকিছু তছনছ হয়ে যায়।

তিনি জানান, গত চার্জশিটভুক্ত ছয় আসামির মধ্যে পিতা-পুত্র, গ্রিজার সাত্তার মোল্লা এবং লঞ্চ মালিক সমিতির সুপার ভাজার (টাইমকিপার) কাশেম হালদার- এই চারজন বৃহস্পতিবার আদালতে হাজিরা দিয়েছেন।

তবে লঞ্চ মালিক সমিতির অপর সুপারভাইজার মো. মিনিস্টার হজ পালনে রয়েছেন। আর ঘটনার পর থেকেই লঞ্চটির সুখানি (চালক) গোলাম নবী পলাতক।

ওমর ফারুক লিমন বলেন, ‘মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্যই সুখানি গোলাম নবীকে খোঁজাখুঁজি করছি। তাঁর বাড়ি মাগুরায়। সেখানে নেই তিনি। ভারতে পালিয়ে গেছেন- এমনও শুনেছি।’ মামলাটির পরবর্তী ধার্য তারিখ ১৫ সেপ্টম্বর।

ওমর ফারুক লিমন জানান, তাঁকে শুধু গ্রেপ্তারই করা হয়নি, সব কাগপত্রও জব্দ করা হয়েছে। তাই স্পেনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন তাঁর বোনের লঞ্চটিই দেখাশুনা করছেন তিনি।

লৌহজং থানা থেকে দেওয়া চার্জশিট নিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা অপরাধী তাদের নাম বাদ দেওয়া হলো। আমরা যারা নির্দোষ তাদের চার্জশিট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। লঞ্চটির প্রকৃত মালিক বরিশালের মনিরুজ্জামান খোকন। তাঁকেই প্রধান আসামি করা হয়েছিল। তাঁর এক আত্মীয় ছিল বড় পুলিশ কর্মকর্তা, তাঁর নামও বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ তাঁর কারণেই লঞ্চের কাগজপত্র ঠিক করা যায়নি। তাঁর কাছ থেকে কাঠপট্টি-সদরঘাট রুটের এই লঞ্চ ১৫ লাখ টাকায় কেনা হয়েছিল। পরে লঞ্চটি ভালো ব্যবসা হচ্ছে বলে বেঁকে বসে ফর্ম পূরণ করে দিতে আরো ২০ লাখ টাকা দাবি করেন।

দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, এ ছাড়া মামলার আরো দুই আসামি মাদারীপুরের শিবচরের কাওরাকান্দি ঘাটের ইজরাদার আব্দুল হাই শিকদার ও শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটের ইজারাদার ইয়াকুব বেপারীকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ এই দুই ইজারাদারই দুই ঘাট থেকে যাত্রী ভরে দিয়েছেন। তাঁদের পেছনে সরকারের প্রভাবশালী লোক থাকায় মূল অপরাধী সত্ত্বেও মামলার অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়।

লৌহজং থানায় দায়ের করা মামলাটির বাদী ছিলেন তৎকালীন মাওয়া ঘাটের বিআইডাব্লিউটিএ-এর টার্মিনাল ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর হোসেন। কিন্তু তদন্তে এই দুর্ঘটনার অন্যতম অপরাধী হিসেবে আলোচিত হয় বিআইডাব্লিউটিএ-এর টার্মিনাল ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর হোসেন। তদন্তে প্রমাণ পাওয়ায় তাঁকে আসামি করার কথা জানায় তখনকার দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা। কিন্তু চার্জশিটে তাঁর নামও নেই।

লৌহজং থানার ওসি আলমগীর হোসাইন জানান, নতুন থানায় নতুন যোগদানের কারণে এই বিষয়টি এখনই বিস্তারিত জানাতে পারছেন না। তবে তিনি শুনেছেন মামলাটি তদন্ত করেছেন তৎকালীন এসআই জুলহাস।

বিচার না হওয়ায় নিহতদের পরিবারে ক্ষোভ

এই দুর্ঘটনায় অনেকে স্বপরিবারেও নিখোঁজ। লঞ্চটিতে ওঠার আগে শিবচরের স্বর্ণা, হিরাসহ তিন বোনের সেলফিই এখন পরিবারের একমাত্র সম্বল। নিহত হিরা ও স্বর্নার বাবা নূরুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘এই দুর্ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূল শাস্তি চাই।’

শিবচর উপজেলার ফরহাদের পরিবারের পরিণতি আরো ভয়াবহ। ফরহাদসহ পরিবারের চারজনের কারোরই লাশ পাওয়া যায়নি। নেই কোনো ফটোগ্রাফও। ছেলে মিজানুর, বৌসহ পরিবারের চারজনকে হারিয়ে মা রিজিয়া বেগম এখনো চোখের জল ফেলেন। নিখোঁজ অর্ধ শতাধিক পরিবারের কাউকেই দেওয়া হয়নি কোনো অনুদান। আর অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে ২১ জনের লাশ দাফন হলেও ডিএনএ সংগ্রহ করে নমুনাতেই রয়ে গেছে, মেলেনি পরিচয়।

২০১৪ সালে ঈদুল ফিতরের পর ৪ আগস্ট ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে পিনাক-৬ লঞ্চটি উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে মাওয়ার অংশে ডুবে যায়।

ওই দুঘর্টনার পর মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানা ও মেরিন কোর্টে দুটি মামলা হয়। আসামি লঞ্চ মালিক কালু খান ও তাঁর ছেলে গ্রেপ্তারর হলেও বর্তমানে জামিনে। তবে চার বছর অতিবাহিত হলেও দোষীদের বিচার সম্পন্ন হয়নি। দুর্ঘটনায় পর তদন্ত কমিটির দেওয়া নির্দেশনাগুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

দুর্ঘটনার পরের দিন ৫ আগস্ট রাতে ‘অধিক মুনাফার আশায় ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে বেপোরোয়া লঞ্চ চালিয়ে অবহেলাজনিত নর হত্যার’ অপরাধে ছয়জনকে আসামি করে লৌহজং থানায় হত্যা মামলা দায়ের করে বিআইডাব্লিউটিএ। এর আগে দুর্ঘটনার দিন ৪ আগস্ট মেরিন কোর্টে পাঁচজনের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর। পরে গ্রেপ্তার করা হয় পিনাক-৬ লঞ্চের মালিক আবু বক্কর সিদ্দিক কালু ও তার ছেলে ওমর ফারুক লিমনকে।

লৌহজং উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা কাবিরুল ইসলা খাঁন বলেছেন, ‘পিনাক-৬’ ট্র্যাজেডির কথা মাথায় রেখেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি রাখা হচ্ছে। এমন দুর্ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার জন্য প্রশাসন সতর্ক রয়েছে। সংশ্লিষ্টদেরও সতর্ক রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো অনিয়ম থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পিনাকের পরিবর্তে ‘খালিদ সালিদ’

‘এমএল পিনাক-৬’ লঞ্চ ডুবে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছে ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট থেকে। তবে লোভনীয় শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি (তৎকালী মাওয়া-কাওড়াকান্দি) লঞ্চ রুটের সেই স্থান খালি নেই। সেখানে এখন চলছে ‘এমভি খালিদ সালিদ’। দুর্ঘটনার দেড় বছর পর এই স্থানে জায়গা করে নেয় ‘এমভি খালিদ সালিদ’। তবে এই লঞ্চের কাগজপত্রে মালিক রয়েছেন পিনাক-৬ লঞ্চের আবু বক্কর সিদ্দিক কালুর মেয়ে খাদিজা আক্তার। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে খাদিজা আক্তারের জাপান প্রবাসী স্বামীর টাকায়ই এই লঞ্চটি কেনা হয়। তবে লঞ্চটি দেখাশুনা করছেন খাদিজা আক্তারের ভাই ওমর ফারুক লিমন। এই লঞ্চের যাবতীয় কাগজপত্র বৈধ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জুড়ে বসল ‘নাহার’

উড়ে এসে জুড়ে বসল ‘এমএল নাহার’। ‘এমএল নাহার’ ছোট আকারের এটি লঞ্চ। যথাযথ ফিটনেস না থাকায় চলাচল অনুপযোগী ঘোষণা করা হয় এটিকে। পরে মালিক লঞ্চটি বন্ধ রেখে এর পরিবর্তে ‘এমএল অর্পন’ নামের একটি লঞ্চ এই স্থানে চালু করেন। লঞ্চটি অপেক্ষকৃত বড়। এটি বছর দুই আগের ঘটনা। এতে এই রুটে একই মালিকের লঞ্চ হয় দুটি। অপর লঞ্চ এমএল জলহংস-৪। কিন্তু গত মধ্য রোজায় সেই অচল লঞ্চই রহস্যজনক কারণে ‘সচল’ হয়ে যায়। ‘এমএল নাহার’ এর স্থলে দেওয়া ‘এমএল অর্পন’ও থেকে যায়। তাই ভাস্কর চৌধুরীর মালিকানায় এই রুটে এখন তিন লঞ্চ। বাণিজ্যিকভাবে এই লঞ্চ রুট ‘লোভনীয়’ হিসেবে পরিচিত। তাই এই রুটে লঞ্চ যুক্ত করা কঠিন। লঞ্চ রুটটিতে যেসব মালিক রয়েছেন, তাঁরা অনেকে প্রভাবশালী বা পেছনে প্রভাবশালী রয়েছেন। ব্যবসায়িক স্বার্থে এই রুটে নতুন কোনো লঞ্চ প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না তাঁরা। তারপরও নানা কৌশলে ঢুকে যায় ‘এমএল নাহার’। যা এখানে বড় বেশি আলোচিত। ‘এমএল নাহার’, ‘এমএল অর্পন’ ও ‘এমএল জলহংস-৪’- এই তিন লঞ্চের মালিক ভাস্কর চৌধুরী এখন তাই আলোচিত। তিনি এই নৌ রুটের মালিক সমিতির প্রভাবশালী নেতা।

এ ছাড়া লঞ্চ মালিক যাত্রী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। লৌহজং উপজেলার ইউএনও কাবিরুল ইসলাম খান জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবহিত নন। তবে এই রুটে এখন ৮৮টি লঞ্চ চলাচল করছে এটি সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে। এর আগে এখানে ৮৭টি লঞ্চ চলাচল করতো।

‘এমএল’ নিয়েও ভেজাল!

‘এমএল’ ও ‘এমভি’ নিয়েও ভেজাল রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি লঞ্চ রুটে চলাচলকারী লঞ্চের নামের আগে রয়েছে ‘এমএল’ ও ‘এমভি’। সাধারণত ছোট লঞ্চের নামের আগে ‘এমএল’ (মোটর লঞ্চ) এবং অপেক্ষাকৃত বড় লঞ্চের নামের আগে ‘এমভি’ (মোটর ভেসেল) লেখা হয়ে থাকে। তবে এক লঞ্চ মালিক অভিযোগ করেছেন ‘এমএল’ ক্যাটাগরি লঞ্চের যাত্রী প্রতি সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয় কম। আর ‘এমভি’ ক্যাটাগরি লঞ্চের যাত্রী প্রতি ট্যাক্স দিতে হয় কয়েকগুণ বেশি। এই ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্যই এই রুটে চলাচলকারী কিছু লঞ্চের কাগজেপত্রে ‘এমএল’ ক্যাটাগরি করে রাখা হয়েছে।

দেশের সব নৌযানের কাঠামোগত নির্মাণ-নকশা ও চলাচলের সনদ অনুমোদনকারী সংস্থা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর। এই দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘৬৫ ফুটের কম দৈর্ঘ্যের লঞ্চগুলো হচ্ছে এমএল (মোটর লঞ্চ) ক্যাটাগরির, আর ৬৫ ফুটের ওপরেরগুলো হচ্ছে এমভি (মোটর ভেসেল)। তাই কোনো লঞ্চের পরিসর যদি ৬৫ ফুটের ওপরে এক ফুটও হয়ে থাকে, তবে তা এমভি ক্যাটাগরির হওয়ায় বিধিগত কোনো সমস্যা নেই। এ নিয়ে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে খতিয়ে দেখা হবে।

লৌহজং উপজেলার ইউএনও কাবিরুল ইসলাম খান বলেন, এটি অন্য দপ্তরের। তারপরও কারসাজি হয়ে থাকলে খোঁজখবর নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে