পল্লী কবিতার উৎস ও নকশিকাঁথা

ড. রকিবুল হাসান

পল্লী কবিতার উৎস ও নকশিকাঁথা

রবীন্দ্র-নজরুলের পরে এখনও জসীম উদ্দীনের নামই অবধারিতভাবে চলে আসে। এই ক্রমধারা থেকেই অনুধাবন করা যায় বাংলা কবিতায় জসীম উদ্দীনের অবদান ও অবস্থান।

পল্লীকেন্দ্রিক যাপিতজীবন ও প্রকৃতিকে কবিতায় উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করে জসীম উদ্দীনের পূর্বসূরি রয়েছেন আরও অনেকেই। তিনি নিজস্ব প্রতিভাবৈচিত্র্য ও সক্রিয়তায় পল্লী কবিতার এ ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন বহুগুণে।

universel cardiac hospital

করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্র অনুসারী কবি হলেও তার কবিতায় পল্লী-প্রকৃতি নানাভাবে উঠে এসেছে। যদিও করুণানিধান কবিতায় পল্লী-প্রকৃতিকে গ্রহণ করতেই হবে এমনটিও ভাবেননি কখনও। বলা যেতে পারে তার সৃষ্টির বিশালতায় পল্লী-প্রকৃতি কবিতায় অনুরাগ কিংবা আপন মনের খেয়ালবশত অনেকখানি অংশ দখল করে নিয়েছিল। পল্লীর পথ-ঘাট, নদীর ভাঙন, গাঙচিলের ঝাঁক, কাঠঠোকরা, ঢেঁকিশাক, ছাতিম তলার ঘাট, আউশের ভূঁই- আটপৌরে গ্রাম্যমেজাজের শব্দসৌকর্য করুণানিধানের কবিতায় প্রথম উঠে আসে। এর আগে পল্লী-প্রকৃতি যে কবিতার বিষয় হতে পারে এরকম ভাবনাটিই কারো মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।

করুণানিধানের এ ধারা বা ভাবনাটি আরও অনেকখানি এগিয়ে নেন যতীন্দ্র মোহন বাগচী। পল্লীর দৈনন্দিন জীবনযাপন তাকে অনেকটা গভীরভাবেই স্পর্শ করে। যে কারণে যতীন্দ্র মোহন রবীন্দ্র ভাবনায় লালিত হয়েও তার কাব্যে পল্লীজীবন বৈচিত্র্যকে কাব্যে উপজীব্য করেছেন। যতীন্দ মোহনের কবিতায় পল্লীর বহুমাত্রিকতা সন্নিবদ্ধ না থাকলেও, পল্লী-প্রকৃতিকে কবিতায় পরীক্ষা-নীরিক্ষার প্রয়াস লক্ষ করা না গেলেও, তার কবিতায় পল্লীর নিবিড় ও সৌম্য-শান্ত যে রূপটি ধরা পড়েছে তা কাব্যের এ নবধারায় গুরুত্বপূর্ণ।

করুণানিধান ও যতীন্দ্রমোহন পল্লী-প্রকৃতিকে কবিতায় উপজীব্য করে নতুন যে ধারার ভিত্তি নির্মাণের প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন, সেটিকে অনেকখানি শক্ত অবস্থানের উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হন কুমুদরঞ্জন মল্লিক। তিনি বাংলার পল্লীকে শুধু প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেননি, আত্মার পরম তীর্থরূপে বরণ করেছিলেন। গ্রামের মাটির সঙ্গে তার ছিল নিবিড় সম্পর্ক। তার বহু কবিতায় বৈষ্ণবভাব, ভক্তিরস, ভারতের অতীতগাথা, পুরী-বৃন্দাবন মথুরা নানাভাবে এসেছে। কিন্তু এসবের থেকে তার কবিতায় অনেক বেশি স্থান করে নিয়েছে তার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি জড়ানো অজয় নদী।

এ নদীর কথা তার কবিতায় বহুভাবে বহু রঙে ব্যঞ্জিত হয়েছে। এ নদীর সঙ্গে তার জন্মান্তরের সৌহার্দ্য- কবি তা নিজেই স্বীকার করেছেন। পল্লীর মাঠ-ঘাট, বনস্পতি ফল, ছায়াতরু, তৃণগুল্ম, মেঘলা আকাশ, ভোরের আকাশ, গ্রামের পাখি, হাওর-বিল-নদী-নালা পরম মমতায় তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন।

পল্লী যেন নিজস্ব স্বরূপে এই প্রথম কবিতারাজ্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ এক রূপে সেও যে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠতে পারে- কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কবিতায় সেই সত্য বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

চূড়ান্ত সিদ্ধি অর্জনে তিনি সক্ষম না হলেও এ ধারাকে সমৃদ্ধতর করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অসামান্য ছিল। এ ধারারই সবচেয়ে সফল কবিপুরুষ জসীম উদ্দীন। পল্লী-প্রকৃতি আর যাপিতজীবনকে তিনি ভোরের ঘাসে শিশির ফোটার মতো কবিতায় অসামান্য দক্ষতায় ‘টলমল’ জীবন্ত করে তুললেন।

এতদিনে করুণানিধান, যতীন্দ্রমোহন ও কুমুদরঞ্জনেরা পল্লী-প্রকৃতিকে কবিতায় উপজীব্য করে যে নবধারার যাত্রা রচনা করেছিলেন, জসীম উদ্দীনের হাতে পেল তার উজ্জ্বল পূর্ণতা। জসীম উদ্দীনের সমকালীন সময়ে বন্দে আলী মিয়া ও কাজী কাদের নওয়াজ পল্লী জীবনপ্রকৃতি নিয়ে কাব্যচর্চায় সফলতা লাভ করলেও জসীম উদ্দীন হয়ে ওঠেন সমকালীন কবিদের মধ্যমণি। পাঠকমহলে লাভ করেন অবিশ্বাস্যরকমের জনপ্রিয়তা।

সমকালীন কবিদের মধ্যে নজরুলের পরে আর কেউই জসীম উদ্দীনের মতো জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেননি। এমনকি পরবর্তীতেও আর কোনো কবি তার জনপ্রিয়তাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হননি। জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতায় বিখ্যাত কবি। পল্লী-প্রকৃতির রূপমাধুর্য তিনি অসাধারণ শিল্পশৈলীতে তুলে ধরে বাংলা কবিতায় অসম্ভবরকম জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন।

তারপরও জসীম উদ্দীন যেভাবে ঘাট-মাঠের মানুষের কবি, জীবনানন্দ দাশ সেখান থেকে খানিকটা দূরেই। জীবনানন্দ দাশ যতখানি পল্লী-প্রকৃতির কবি, পল্লীর মানুষের ততখানি নন। পল্লী-নগরসভ্যতা-ইতিহাস-ঐতিহ্য সবমিলে জীবনানন্দের জগৎ ভিন্ন।

জসীম উদ্দীনের পরেও আর একজন বাঙালি কবি পল্লী-প্রকৃতি ও পল্লীর মানুষকে নিয়েই জীবনভর কবিতা লিখেছেন, তিনি ওমর আলী। একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কবি হলেও, ব্যাপক জনপ্রিয়- সে অভিধা তিনি লাভ করতে পারেননি।

জসীম উদ্দীনের এ রকম জনপ্রিয়তা লাভের মূল কারণ কী ছিল- সে বিষয় ভাবা যেতেই পারে। পল্লীর সহজ-সরল জীবনগাথাই তার কাব্যে পাঠকপ্রিয়তা লাভে মূল কারণ- এ প্রশ্নও খুব স্বাভাবিক। পল্লীর এ সহজ-সরল জীবনগাথা তো অন্য কবিরাও তাদের কাব্যে উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করে ছিলেন। কিন্তু তারা জসীম উদ্দীনের মতো কবিখ্যাতি ও পাঠকপ্রিয়তা লাভে সক্ষম হননি।

তিনি পল্লীর জীবনগাথাকে যেভাবে জীবন্ত করে উপস্থাপন করতে পেরেছেন, সমাজচিত্রকে যে নিপুণতায় এঁকেছেন, গ্রামীণ মানুষের মনস্বত্বঃ যেভাবে তিনি ধরেছেন, তাদের মানবসম্পর্ক ও প্রেমকে যে ট্রাজিক রূপদান করেছেন, সর্বোপরি সামগ্রিক বিষয়কে শিল্পগুণ সমৃদ্ধ করে অসাধারণ ভাষাভঙ্গিমায় কাব্যরূপ দান করেছেন- তা পাঠকপ্রিয়তা লাভে বড় শক্তি।

নজরুল পরাধীন দেশের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে অগ্নিবীণা বাজিয়েছিলেন, বিষের বাঁশিতে সর্বনাশার সুর জাগরিত করেছিলেন, মহাসমুদ্রের তুফান কবিতায় এনেছিলেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মহামন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, এ সব তাঁর আকাশ-স্পর্শী জনপ্রিয়তা অর্জনের মূল কারণ। জসীম উদ্দীন নজরুলের এ ধারায় একটুও না গিয়ে পল্লীর সাধারণ মানুষের আনন্দ-বেদনাকে কাব্যে ধারণ করে পাঠকের হৃদয় জয় করেন। তাঁর কবিতার করুণ রস বা ট্রাজেডিই পাঠকপ্রিয়তা লাভে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে- এমন বিবেচনা নানাকৌণিক থেকেই নির্ণীত হতে পারে।

জসীম উদ্দীনের কাহিনী কাব্য চারটি : ‘নক্শিকাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘সকিনা, ও ‘মা যে জননী কান্দে’। এ চারটি কাব্যেই ট্রাজেডি রস সঞ্চারে কবি সফলতার পরিচয় রেখেছেন।

‘নক্শিকাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্য দুটিতে শেকসপিরিয়ান ট্রাজেডি রূপবৈচিত্র্য ফুটে উঠেছে। কর্মের ফলই যে মানুষ ভোগ করে এ দুটো কাব্যে শেকসপীয়রের নাটকের ট্রাজেডির মতোই একই সত্যরূপ লক্ষণীয়। এখানে আলোচনা ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ দেখা যায়, কাব্যে রূপাই ও সাজু বিয়ে করে সুখের সংসার বেঁধেছিল।

বন গেঁয়োরা যখন গাজনা চরের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছিল, সে খবর পেয়েই রূপাই সড়কি-ঢাল নিয়ে গাজনাচরে কাইজা করার জন্য ছুটে যায় এবং নেতৃত্ব দেয়। রূপাই ইচ্ছে করলে এই কাইজা সে এড়াতে পারত। কিন্তু কাইজা শেষে যখন সে নিজের ভুল বুঝতে পারে তখন অনুশোচনা আর বিচ্ছেদের আগুনে দগ্ধ হওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করা থাকে না। সাজুর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সে নিরুদ্দেশ হয়।

কিন্তু রূপাইকে একমুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না সাজু। প্রতিটি মুহূর্ত বুকের ভেতর প্রেমের অগ্নিশিখা জ্বলতে থাকে। রূপাইয়ের ফেরার অপেক্ষার আগুনে পুড়ে পুড়ে সে দগ্ধ হতে থাকে। এক সময় সবাই ফিরলেও রূপাই ফেরে না। সাজুর দেহমন জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যায়। জীবনপ্রদীপ আস্তে আস্তে নিভে আসতে থাকে। খুঁজতে থাকে নিজের অপরাধ। কোন্ অপরাধে তার এ শাস্তি! সাজুর কান্না শুধু পরিবার নয় আশাপাশের সমস্ত মানুষকে ব্যথিত করে। প্রকৃতিও যেন সে কান্নায় একাত্ম হয়ে ওঠে।

জীর্ণ-শীর্ণ শরীরে সাজু নকশিকাঁথায় নিজেদের জীবনের নানা স্মৃতিচিত্র আঁকে। একই সঙ্গে মায়ের কাছে আবেদন জানায়- মারা গেলে এই নক্শিকাঁথাটি যেন তার কবরের গায়ে মেলে দেয়া হয়। সাজুর মৃত্যুতে এ কাব্যে যে বেদনার্ত পরিবেশ তৈরি হয় তা আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় তার মায়ের গগণবিদারী আর্তনাদ ও আহাজারি। রূপাই যে ভুল করেছিল এর চরম মূল্য শুধু সাজু কিংবা সাজুর মা-ই দেননি, রূপাই নিজেও দিয়েছে। সে-ও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। তারও মৃত্যুও ঘটেছে। তার মৃত্যুর ভেতর দিয়েই ‘নক্শিকাঁথার মাঠ’ সার্থক ট্রাজেডি গুণসমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।

এ কাব্যে রূপাইয়ের ভুল থেকেই ট্রাজেডির বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। সেই বীজ রূপাই থেকে সাজু, সাজু থেকে তার বৃদ্ধা মা-এ সংক্রমিত হয়ে পরিপূর্ণ এক ট্রাজেডি রূপ ধারণ করে। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ও আমরা দেখেছি সব বিষাদের মূলে রাবণ।

মেঘনাদবধের ট্রাজেডি রাবণের ট্রাজেডি হয়ে উঠেছে। ‘নক্শিকাঁথার মাঠ’ কাব্যেও রূপাইয়ের ভুল ট্রাজেডি হয়ে উঠেছে রূপাইয়ের নিজের জীবনে, তার স্ত্রী সাজু ও সাজুর বৃদ্ধা মায়ের জীবনে। যা একটি ভুল থেকেই সংক্রমিত। জসীম উদ্দীন ট্রাজিক রূপায়ণে ‘নক্শিকাঁথার মাঠে’ সার্থকতা দেখিয়েছেন।

জসীম উদ্দীন তার ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যে সচেতনভাবে ট্রাজেডির আবহ নির্মাণ করেছেন। এ কাব্যের স্থান-কাল-পাত্র-চলন-বলন-কথন একেবারেই গ্রামীণজীবন স্নাত। যেখানে কোনো কৃত্রিমতা নেই, বাড়তি কোনো রঙ-ঢঙ নেই, যা তাই শিল্পের মহিমায় উদ্ভাসিত। এ কাব্যের চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে যাওয়া যায়, বুক ভরে শান্তি করে নিঃশ্বাস নেয়া যায়, আবার বুক খুলে মন ভরে কাঁদাও যায়।

নিখাঁদ মাটির গন্ধভরা তার কাব্য। যা খুব সহজেই দখল করে নিতে পেরেছে পাঠকসাম্রাজের হৃদয়। যে কারণে ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যের আবেদন বাঙালি-পাঠকের কাছে চিরন্তন। এ যেন বাঙালি হৃদয়ের সুতো দিয়ে গাঁথা-শিরাধমনিতে নিত্য প্রবাহিত। আর সে কারণেই ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ শুধু পল্লী-প্রকৃতির মানুষের নয়, সমগ্র বাঙালিরই যেন জীবনকাব্য হয়ে উঠেছে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে