পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট আমাদের জীবনের সবচেয়ে শোকাবহ ঘটনা। এটি ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়। আগের রাতে আমরা বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন উপলক্ষে প্রস্তুতিমূলক কাজ করছিলাম। কয়েক ঘণ্টা আগে মাত্র বিদায় নিয়েছেন আমাদের অন্যতম নেতা শেখ কামাল। প্রত্যুষের দিকে তাঁকে আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে কেউ একজন এসে খবর দিল শহরে ট্যাংক দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে বাংলাদেশ বেতারের সামনে ট্যাংক ও সেনাদের দেখা গেছে। পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা জানতে পারলাম যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।
খবরের প্রথম প্রতিক্রিয়ায় আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু একটা করার কথাও আমাদের কারও কারও মাথায় এল। কিন্তু এ চিন্তাও ক্ষণিকের। কলা ভবনে বসেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আরও খবর নেওয়ার এবং বড় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের। যোগাযোগ করলাম শেখ শহীদুল ইসলামের সঙ্গে, তিনি সদ্য বিবাহিত। কোনো আগ্রহ না দেখে যোগাযোগ করলাম বাকশালের অন্যতম সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি সন্ত্রস্ত, বিভ্রান্ত এবং আত্মগোপনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। জাতীয় যুবলীগের মহাসচিব তোফায়েল আহমেদ সব যোগাযোগ বন্ধ করে বাসায় অবস্থান নেন (কিছুক্ষণ পরই তাঁকে রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়)। বাকশালের আরেক সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি শহীদ হয়েছেন।
বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা ও বাকশালের অন্যতম সম্পাদক জিল্লুর রহমানের সঙ্গে ছাত্র-যুবকদের তেমন সম্পর্ক না থাকায় দিনের মধ্যভাগে আমরা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ও সংস্কৃতিসেবী মফিদুল হকের পৈতৃক নিবাসে আশ্রয় নিই। সেখানে বসে সুস্থির মাথায় আমরা পরামর্শ করে ঠিক করি যে জাতীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব, এই নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হব এবং আন্দোলন গড়ে তুলব। সে অনুযায়ী আমরা যার যার পছন্দমতো আশ্রয়ে চলে যাই (আমি আমার উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিই)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আমাদের কর্মক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা বসে থাকিনি। জাতীয় পর্যায়ের নেতারা, যাঁরা জেলের বাইরে ছিলেন, তাঁরা মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণের কারণে এবং মন্ত্রিসভায় কয়েকজন বাদে বড় নেতাদের সমাবেশ দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। অনেকেই মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন (এর মধ্যে কয়েকজন খ্যাতিমান ছাত্রনেতাও ছিলেন)।
এ সময়ে জাতীয় যুবলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থাকা আমরা কয়েকজন এবং সাংসদদের মধ্যে মধ্যস্তরের কয়েকজন নেতা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের হোতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিই। ছাত্র ইউনিয়নের যেসব নেতা জাতীয় ছাত্রলীগে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কাজ শুরু করলাম। আমরা গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানাতে শুরু করলাম। এ সময় আমরা যারা সক্রিয়ভাবে কাজ করছিলাম, তাঁদের মধ্যে ছিলেন এস এম ইউসুফ, মরহুম শফিকুল আজীজ মুকুল, ফকির আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। পার্লামেন্টের স্পিকার আবদুল মালেক উকিল লন্ডনে ও বাকশালের নির্বাহী কমিটির সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ মস্কো গেলেন, ফিরলেন সুবোধ বালক হয়ে।
এরই মধ্যে খুনি চক্রের প্রধান খন্দকার মোশতাক বঙ্গভবনে এমপিদের বৈঠক ডাকেন। সে বৈঠক বয়কটের আহ্বান জানিয়ে আমরা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ব্যাপক তৎপরতা চালাই। ছাত্রনেতাদের মধ্যে ইসমত কাদির গামা, রবিউল আলম চৌধুরী, মোমতাজ হোসেন, নূরুল ইসলাম, কাজী আকরাম হোসেন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বেশ তৎপর ছিলেন। তাঁরা এমপিদের মোশতাকের বৈঠককে বয়কট করার আবেদন জানান। (ফ্যাক্টস অ্যান্ড ডকুমেন্টস: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ) আমাদের বাধা সত্ত্বেও বৈঠকটি হয়েছিল। এটি সফল করতে তৎপর ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, রাফিয়া আখতার ডলি প্রমুখ। কিন্তু বৈঠকটি ব্যর্থ হয়। মোশতাক কাঙ্ক্ষিত ফল পাননি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রবীণ নেতা ও আইনজীবী সিরাজুল হক মোশতাক সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলে সবকিছু ভণ্ডুল হয়ে যায়।
এ সময় আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সারির নেতাদের অনেকেই নিজেদের সংগঠিত করার জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। শামছুদ্দিন মোল্লা, সিরাজুল হক, আনোয়ার চৌধুরী, এম এ মালেক, মফিজুল ইসলাম কামাল, রওশন আলী, কামরুজ্জামান (শিক্ষক নেতা), ময়েজউদ্দিন আহমেদ, খালেদ মোহাম্মদ আলী প্রমুখ এ সময় সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মোশতাকের শাসনের অবসানের পর আরও অনেকে প্রতিবাদকারীদের কাতারে শামিল হয়েছিলেন।
আবার এ কথাও সত্য যে সেদিন অনেকের কাছ থেকেই আমরা ভালো ব্যবহার পাইনি। তাই বলে আমরা দমেও যাইনি। আমরা নিজেদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করলাম অতি স্বল্প সময়েই। মমতাজ হোসেনের পুরানা পল্টনের বাড়িতে তাঁর মা-বাবার সস্নেহ প্রশ্রয়ে আওয়ামীপন্থী ছাত্র-যুবরা প্রায়ই বৈঠক করতাম এবং কখনো-সখনো আর্থিক সহায়তাও নিতাম। আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আত্মীয়ের বাসায়। এ ছাড়া আমরা এস এম ইউসুফের নিমতলীর বাসায় ও রাজু ভাইয়ের ইস্কাটনের বাসায় অনেক বৈঠক করেছি। বৈঠক করেছি বকশীবাজারে ভুট্টো ভাইয়ের বাসায়। ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃত্ব অধিকাংশ সময়েই মহিউদ্দিন সাহেবের বড় ভাইয়ের বাসা ও অন্যান্য স্থানে বৈঠক করত। এ সময় আমরা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিন ২০ অক্টোবর জাতীয় ছাত্রলীগের ব্যানারে প্রথম মিছিল করার সিদ্ধান্ত নিই।
২০ অক্টোবর ১৯৭৫ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে এক লাল দিন। খুনি মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে আমরা এদিন প্রথম মিছিল বের করেছিলাম। মিছিলে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কাজী আকরাম হোসেন ও অজয় দাশগুপ্ত, ছাত্রলীগের নেতা রবিউল আলম চৌধুরী, মমতাজ হোসেন, খালেদ খুররম এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও নগর ছাত্রলীগের নেতা শহীদুল আলম বাদল, মৃণাল সরকার, কামরুল আহসান খান, খ ম জাহাঙ্গীর, বাহলুল মজনুন চুন্নু, হাবিবুর রহমান খান, মুকুল বোস, স ম সালামসহ ৪০ থেকে ৫০ জন ছাত্রকর্মী। পরের দিনও আমরা সমবেত হয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে।
২১ অক্টোবর যখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি, তখনই দেখতে পাই, কতিপয় গুন্ডা দেশি অস্ত্রশস্ত্র, যেমন: হকিস্টিক, কাঠের লাঠি ইত্যাদি নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। আমরা মধুর ক্যানটিনে যেই গিয়ে বসেছি, অমনি আমাদের ওপর হামলা হয়। আমরা তাদের এই ঘৃণ্য হামলায় ঘাবড়ে যাইনি, বরং এই হামলা প্রতিহত করে এদিনও একটি মিছিল বের করতে সক্ষম হই। আমাদের মিছিল অনেক বড় হয়েছিল। কয়েক শ ছাত্রছাত্রী মিছিলে শামিল হয়েছিল। জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ থেকেও আমাদের কর্মীরা এসেছিল। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মাহবুব জামান, কাজী আকরাম, অজয় দাশগুপ্ত ও আমি বক্তৃতা করেছিলাম সমাবেশে।
এর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমাদের কর্মতৎপরতা ও উপস্থিতি বেড়ে যায় (কোনো কোনো বন্ধু আমাদের সঙ্গে থাকলেও ক্যাম্পাসে আসেনি কখনো)। নগরের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের কাজ ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে আমরা বঙ্গবন্ধু ভবনে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা প্রতিনিধিদল ভাগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে বক্তব্য দিতে শুরু করি। আমার ভাগে পড়েছিল কলাভবন। আমরা এ সময় আওয়ামী লীগকেও সংগঠিত করার কাজে তৎপর হই। দিকনির্দেশনাহীন এক বিশাল কর্মীবাহিনী ও দেশপ্রেমিক জনগণকে সংঘবদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।
বর্তমান আর মোশতাক-পরবর্তী সময় এক নয়। মোশতাকের শাসন প্রলম্বিত হলে অনেককেই ভালোভাবে চেনা যেত। আমরা যেদিন মিছিলের তারিখ ধার্য করেছিলাম, সেদিনই খালেদ মোশাররফ এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মোশতাক শাসনের অবসান ঘটান। ৪ নভেম্বর ১৯৭৫ বাংলাদেশের ইতিহাসে লাল তারকাখচিত আরেকটি দিন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়ে এ মিছিল গিয়ে শেষ হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ভবনে এবং সেদিন মোনাজাত পরিচালনা করেছিলেন মাওলানা জেহাদী।