ডাকবাংলোর কাছে গুলিবর্ষণ

মঈনুস সুলতান

ডাকবাংলোর কাছে গুলিবর্ষণ
ছবি : সংগৃহিত

মলয় তাদের বাসাবাড়ির বাইরের দিকের টিনের চারচালা ঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। তার বাবা শ্রী অতুল চন্দ্র দাস এই ঘরে বসে মক্কেলদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। শেষ দিকে হরেক রকমের রোগ-শোকে তার শরীর কেবলই কমজোর হচ্ছিল।

দেওয়ানি আদালতে যাওয়া একবারে কমিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরও অনেক বছরের পুরনো মামলার চেনাজানা মক্কেলরা এলে না বলতে পারতেন না। মুহুরির কাঁধে হাত রেখে রিকশায় কখনও-সখনও আদালতে হাজিরা দিতেন।

মার্চ মাসের পয়লা তারিখ- পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান যেদিন জাতীয় সংসদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করলেন, সেদিন সন্ধ্যায় প্রয়াণ হল তার বাবার। শ্রী অতুল চন্দ্র এলএলবি মহাশয়ের নামফলকটি এখনও ঝুলছে বারান্দার কাঠের খুঁটিতে।

সাইনবোর্ডের প্রান্ত থেকে চালের কড়িবর্গা অব্দি একটি মাকড়সা জাল বুনেছে। মলয় আঙিনার কামিনী ঝোপের তলা থেকে তুলে নেয় দীর্ঘ একটি শুকনা ডাল। তা দিয়ে মাকড়সার জাল ভেঙে দিলে কালোয় হলদে ডোরাকাটা পতঙ্গটি ছুটে গিয়ে চুনকাম করা দেয়ালে সবকটি পা ছড়িয়ে আটকে থেকে মলয়ের দিকে কুতকুতিয়ে তাকায়।

ইলেকশনের পর থেকেই চলছিল রাজনৈতিক অচলাবস্থা। বাঙালিদের ভোটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা পশ্চিমারা যে তুলে দেবে না- তা হানড্রেড পার্সেন্ট পরিষ্কার হয় পয়লা মার্চে সংসদ অধিবেশন মুলতবির মাধ্যমে।

২৬ মার্চের পরপর মহকুমা শহর মৌলভীবাজারে খানসেনাদের প্রতিরোধে সশস্ত্র লড়াইয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটিতে আসা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক, পুলিশ, আনসার ও দোনালা শিকারি বন্দুক প্রভৃতি নিয়ে বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবকরা উদ্যোগ নেয় প্রতিরোধ যুদ্ধের। শেরপুরের নদী সংলগ্ন এলাকায় জোর লড়াই চলে কয়েকদিন। আজ এপ্রিলের সাত তারিখ। সপ্তাহদিন আগে জঙ্গিবিমানের ছত্রছায়ায় খানসেনাদের রিএনফোর্সমেন্ট এসে পৌঁছলে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা রিট্রিট করে প্রথমে এসে পৌঁছে মহকুমা শহরে।

তারপর শরণার্থীদের সঙ্গে শামিল হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নেয় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। মলয়ের জননী, তার স্কুল-শিক্ষক বড়ভাই সুবিমল বাবু, বৌদি ও তাদের ছোট্ট মেয়ে অর্পিতা এবং ছোট বোন সবিতা রানী ত্রিপুরা রাজ্যের দিকে রওনা হয়েছে দোসরা এপ্রিল। তার পরদিন খানসেনারা তোড়েজোড়ে ফিরে এসেছে মহকুমা শহরে। সন্ধ্যার দিকে কারফিউ চলছে।

মলয় শহরের পশ্চিম বাজারে পারিবারিক ব্যবসা বইয়ের দোকানটি চালায়। ডিসটারবেন্সের কারণে দোকানটি সপ্তা দুয়েক হল তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। তাদের বাসাবাড়িটি সুনসান নির্জন, শুধু সে তার চৌরানব্বই বছরের বৃদ্ধা দিদিমাকে নিয়ে ভিটা আঁকড়ে পড়ে আছে। দিদিমা পক্ষাঘাতে পঙ্গু, কানে শুনেন না, চোখেও দেখেন খুবই কম।

শোনা যাচ্ছে, পাক আর্মিরা শেরপুর থেকে মৌলভীবাজারে আসার পথে রাজসড়কের পাশের কতগুলো হিন্দু পল্লীতে আগুন দিয়েছে। মহকুমা শহরটির পরিস্থিতি থমথমে। কখন কী হয় বলা মুশকিল।

মলয় কী ভেবে সাবধান হয়ে বারান্দার খুঁটি থেকে খুলে নেয় পিতা প্রয়াত অতুল চন্দ্র মহাশয়ের নামফলক। চাদরের খুট দিয়ে সে সাইনবোর্ডের ধুলোবালি মুছে ভেতরের কামরায় যে টেবিলে বসে তার বাবা হাই পাওয়ারের চশমা-চোখে দলিল, পরচা ও ফারগ ইত্যাদি পরীক্ষা করতেন তার তলায় লুকিয়ে রাখে। তখনই খেয়াল হয়, আজ ভোরে গৃহদেবতার থানে নৈবদ্য দেয়া হয়নি।

‘ঠাকুর’ বলে জিভ কেটে, জোড় হাতে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে মলয় ছুটে গিয়ে ভেতরের ঘর থেকে তুলে নেয় বেতের ডালিটি। মলয় যখন শিশু তখন এ সংসারে সম্পূর্ণ কতৃত্ব ছিল দিদিমার হাতে। নিত্যদিন ভোরবেলা তিনি চান করে কুলদেবতা ঠাকুরকে নৈবদ্য দিতেন। তারপর কালে কালে দিদিমা পক্ষাঘাতে চলৎশক্তি রহিত হলে দ্বায়িত্বটি তার জননীর ওপর বর্তায়।

ঘটনাটি ঘটে আজ থেকে বছর আষ্টেক আগে, মলয় যখন প্রাইমারি পাশ দিয়ে কেবল কাশিনাথ হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। মা দেশত্যাগী হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের দিকে যাত্রার সময় বারবার পই পই করে ঠাকুরের প্রসাদ ও নৈবদ্যে যেন বিঘ্ন না ঘটে- এ জন্য তাকে অনুরোধ করেছিলেন। আত্মগ্লানিতে মর্মে মর্মে পীড়িত হয়ে মলয় ডালি হাতে বেরিয়ে আসে আঙিনার এক চিলতে বাগানে।

ঠাকুরের ধ্যানে মনকে নিবদ্ধ করে সে তুলে নেয় গন্ধরাজ, রক্তজবা ও গোলাপ। কামিনী ঝোপের তলা থেকে কিছু ঝরা ফুল তুলে নেয়ার জন্য উবু হতেই সামনের সড়ক দিয়ে মৃদুগতিতে ছুটে যায় খানসেনাদের টহলদারি পিকাপ। পেছনে অটোমেটিক কারবাইন হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিকদের সঙ্গে স্থানীয় এক শান্তি কমিটির মুসলিম লিগার দালালকে দেখতে পেয়ে সে সতর্ক হয়ে সরে যায় ঝোপঝাড়ের আবডালে।

মলয় ঠাকুরঘরের ছোট্ট কুটুরিতে ঢুকে চোখ মুদে মন্ত্র পড়ে নৈবদ্য অর্পণ করতে যায়। তখন কাছেই ডাকবাংলোর দিকে গোলাগুলির দারুণ আওয়াজ ওঠে। চমকানো মলয়ের হাতে ধরা পুষ্পাচার থেকে একটি ফুল ছিটকে পড়ে মেঝেতে। তার মন কু গেয়ে ওঠে।

সে জানে না- তার মা, বোন, বড়ভাই, বৌদি নিরাপদে ওপারে ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়ে পৌঁছেছেন কিনা? তাদের আত্মীয়স্বজনদের নিবাস ধর্মনগরে। তারা এতজনের পরিবারকে আশ্রয় দেবে কি? এদিকে স্বদেশের পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। বিবিসি থেকে মুক্তিকামী বাঙালিদের সঙ্গে খানসেনাদের সংঘর্ষকে গৃহযুদ্ধ বলা হচ্ছে।

পত্রিকা-পড়া ছেলে মলয়, ভিয়েতনামের চলমান যুদ্ধের খবরাদি সে রাখে। তো আন্দাজ করে, দু-চার বছরে এ ধরনের সশস্ত্র দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কোনো ফয়সালা হবে না। এদিকে মহকুমা শহরটি থেকে জ্ঞাতিগোষ্ঠি সবাই শরণার্থী হয়ে চলে গেছে ভারতে। এ পরিস্থিতিতে দিদিমার অখন-তখন কিছু হলে সে সামাল দেবে কীভাবে?

গোলাগুলির শব্দজনিত উদ্বেগ মাথায় নিয়ে সে দিদিমার কামরায় উঁকি দেয়। জানালার পর্দা সরে যাওয়াতে এক চিলতে কড়া রোদ এসে পড়েছে বৃদ্ধার মুখে। তিনি নেতিয়ে আছেন, তার চোখের পল্লব মিরমিরিয়ে কাঁপছে। মলয় এগিয়ে গিয়ে জানালার পর্দা টেনে দেয়। তখন খেয়াল করে যে, দিদিমার ঠোঁট শুকিয়ে পাঁপড়ের মতো হয়ে আছে। সে চামচে তালমিছরি গোলা পানি ঢেলে তাকে জাগানোর চেষ্টা করে। তিনি চোখ খুলেন না, তবে ঠোঁট থেকে পানির ফোঁটা জিভ দিয়ে চেটে নেন।

পাশের বাসা থেকে জোরেশোরে কী যেন এক গোলমালের আওয়াজ ভেসে আসে। মলয়দের পাশের বাসাবাড়িটি মিনহাজ মঞ্জিল নামে পরিচিত। পুরনো ধাঁচের দালানটির সিঁড়ির উপরকার ছত্রিতে বাড়ির নামের পাশে লেখা- স্থাপিত: ১৯৪৫ সাল।

এ বাড়ির আদি মালিক মরহুম মিনহাজ আহমেদ ছিলেন ব্রিটিশ আমলের দুঁদে ম্যাজিস্ট্রেট। তার উত্তর পুরুষদের সহায়-সম্পত্তি প্রচুর। মলয়ের পিতা শ্রী অতুল চন্দ্র তাদের মামলা-মোকদ্দমার তদারকি করতেন। সে কারণে তাদের সঙ্গে মিনহাজ মঞ্জিলের সম্পর্ক আত্মীয়তার মতো। এ পরিবারের বড় ছেলে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

পঁচিশে মার্চে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে কর্মরত এ পরিবারের ছোট মেয়েটির জামাই পাক আর্মির হাতে নিহত হলে, ক্যাপ্টেন সাহেব বিদ্রোহ করে কিছু বাঙালি সৈনিকসহ ক্যান্টনমেন্ট ছাড়েন। শোনা যাচ্ছে, তিনি তেলিয়াপাড়ার দিকে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। পরিস্থিতি খারাপ হলে মিনহাজ পরিবারের সবাই সেভেন-সিটার গাড়ি ভাড়া করে দূর কোনো গ্রামে তাদের আত্মীয়দের বাড়িতে চলে গেছেন।

আবার পাশের বাসাবাড়িতে আওয়াজ হয়, মনে হয় কারা যেন কুঠার দিয়ে ছেদিয়ে দরোজা ভাঙছে। মিনহাজ মঞ্জিলের গৃহিণী দিনচারেক আগে ঘর ছাড়ার আগে মলয়কে তার বাসাবাড়িটির দিকে নজর রাখতে অনুরোধ করে গেছেন। তো সে চুপচাপ ঘটনা কী তা বোঝার জন্য কলা, আতাফল ও আমগাছে ছায়াচ্ছন্ন বাগান দিয়ে উঁকি দেয় মিনহাজ মঞ্জিলের পেছনের আঙিনায়।

পাক আর্মির দুই জওয়ান বিশাল একটি ট্রাংক ধরাধরি করে বয়ে আনে বারান্দায়। তারা বন্দুকের বাঁট দিয়ে বাড়ি মেরে ভাঙতে চেষ্টা করছে তালা। মলয় কী করবে ঠিক বুঝতে পারে না। তখনই দেখতে পায়, শান্তি কমিটির স্থানীয় দালাল ডান হাতে ভারী দেয়ালঘড়িটি চেপে ধরে বা-হাতে একটি টেবিল ল্যাম্প ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসছে। সে বেরোতে গিয়ে চৌকাঠে ধাক্কা খায়।

তখন বোধ করি মলয়ের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে আরেকটি মোচওয়ালা খানসেনা বন্দুক বাগিয়ে ছায়াচ্ছন্ন বাগানের দিকে এগোয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মলয় নদীর পাড়ের দিকে দৌড়ায়। খানসেনা খানিক ছুটে এসে -‘সালে বহেনচোত..’ বলে ফায়ার করে। মলয় পিচাশ ঝোপ মাড়িয়ে এক লাফে ডিঙ্গায় খাটা পায়খানার নোংরা। মনু নদীর পাড় ধরে পড়ি মড়ি সে দৌড়ায়। তখনই দেখতে পায়, তার মতো আরও বেশ কিছু মানুষজন, নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সবাই দৌড়ে যাচ্ছে গাঙ্গ পাড়ি দেয়া ব্রিজটির দিকে।

মনু ব্রিজের গোড়ায় দাঁড়িয়ে সে বুক চেপে ধরে হাঁপায়। তার হৃৎপিণ্ড যেন সদ্য পিঞ্জিরায় পোরা শাবকহারা শালিকটির মতো তড়পাচ্ছে। শহর ছেড়ে ব্রিজ ধরে প্রচুর মানুষ ছুটে যাচ্ছে নদীর ওপারে। মলয় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

তখন ডাকবাংলোর পেছন দিক থেকে ঠে ঠে ঠে শব্দ ভেসে আসে এলএমজির আওয়াজ। ব্রিজ পাড়ি দেয়া মানুষজনের মাঝে দারুণ ছোটাছুটি শুরু হয়। ভিড়ের তোড়ে মলয়ও চলে আসে পুলের মাঝ বরাবর। তার সামনে কাছাখোলা হয়ে চেনা এক মাছ কারবারি বাঁক কাঁধে ছুটছে। তার টুকরি যে ফুটো হয়েছে সে দিকে কোনো খেয়াল নেই, সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে থোকা থোকা তাজা কেঁচকি মাছ। ব্রিজ থেকে ওপারে নামার মুখে দেখা হয় কাশিনাথ হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক আজীজ স্যারের সঙ্গে। স্যার বোধ করি ছুটির দিনে বারান্দায় বসে উল্টোরথের পুজো সংখ্যাটি পড়ছিলেন।

তা হাতে করে নাকের ডগায় চশমা ঝুলিয়ে ছুটছেন। মলয় স্যারকে ‘আদাব’ বললে তিনি ভ্রুকটি করেন, তবে জানের ডরে এমন তটস্থ হয়ে আছেন যে, সাবেক ছাত্রটিকে ঠিক চিনতেও পারেন না। তার বাম পা-টি খালি, সম্ভবত দৌড়ে ব্রিজ পাড়ি দেয়ার ছোটাছুটিতে চটিজুতোটি খুইয়েছেন। সামনের ছতিম তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ছেড়ে ধুঁকছে একটি তিনটনি ট্রাক। সবাই হুলস্থুল করে চাপছে তাতে। ট্রাকটির গন্তব্য কুলাউড়া। ওখান থেকে সীমান্তের দূরত্ব তেমন বেশি কিছু না। পায়ে হেঁটে পৌঁছা যাবে ত্রিপুরায়।

চলমান ট্রাকে মানুষজনের ভিড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হতে হতে মলয়ের দারুণ বিভ্রান্তি লাগছিল। তার পাশে বেলবটম প্যান্ট পরে বসেছে মহকুমা শহরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েপড়ুয়া এক তরুণ। যুবকটি মাঝে-সাজে মলয়ের বইয়ের দোকানে আসে মর্নিং নিউজ পত্রিকাটি কিনতে।

সে ছোট্টমোট্ট একটি ট্রানজিসটার রেডিও কানে চেপে ধরে বিবিসি শুনছিল। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বলে, ‘তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছে। কর্নেল ওসমানী দায়িত্ব নিয়েছেন খানসেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ের।’ সিঁথিতে টকটকে সিঁদুর পরা এক মহিলা তার কিশোরী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। বালিকাটির মুখ সে দেখতে পায় না। তবে তার সুগোল শ্যামল বর্ণের হাতটি চোখে পড়ে। মেয়েটির কব্জি ছিঁড়ে গিয়ে বেরোচ্ছে রক্ত। সে মুঠোয় ধরে আছে নীল চুড়ির ভাঙা টুকরা। বোধ করি ট্রাকে ওঠার সময় ঘঁষা লেগে কাচ ভেঙে হাত কেটেছে।

ট্রাকের জারকিংয়ের ভেতর সাবধানে বাতাস বাঁচিয়ে কেরোসিন লাইটার দিয়ে রমনা সিগ্রেট ধরান দাড়িওয়ালা এক প্রৌঢ়। এ মানুষটিও মলয়ের চেনা। পেশায় দর্জি ইনি, কাপড়ের দোকানের বারান্দায় বসে ফরফরিয়ে সেলাই কল চালান।

অনির্দিষ্ট যাত্রায় এ ভদ্রলোক সঙ্গে করে নিয়ে চলছেন তার সিঙ্গার মেশিনটি। পাশে পুরো পরিবার নিয়ে কম্বল পেতে বসেছেন সাবরেজিস্ট্রার অফিসের কেরানি মনমোহন বাবু। ইনিও তার বইয়ের দোকানে হামেশা এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়েন। বছরে একবার ইনি খরিদ করেন লোকনাথ পঞ্জিকা। তার যমজ কন্যা দুটি একই ডিজাইনের দুটি পুতুল কোলে তব্দিল হয়ে বসে আছে।

মাইল কয়েক পথ পাড়ি দিয়ে ধকধকিয়ে থেমে যায় ট্রাক। হ্যান্ডোলম্যান ইঞ্জিনের ঢাকনা খুলে দিয়ে বালতি হাতে ছুটে পানা পুকুরের দিকে। হাত-পা এর খিল ছোটানোর জন্য অন্যান্য প্যাসিনজারদের সঙ্গে মলয়ও নেমে আসে।

তখনই তার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। হা ভগবান! দিদিমা বিছানায় নেতিয়ে পড়ে আছেন। বৃদ্ধা দুপুরের দিকে পানি-পানি করে রান্না দুই-তিন চামচ জাউ খান। কাম-কাজের ঝি এ সময় তার গা-গতর ভেজা কাপড়ে মুছিয়ে দেয়। চুম্বকের টুকরাটির দিকে ছুটে যাওয়া লোহার মতো মলয় উল্টা দিকে ছুটতে শুরু করে। ট্রাকযাত্রী দু-একজন চেনাজানা মানুষ তাকে থামাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু মলয় কারও কথা কানে তুলে না। সে ছন্নের মতো দৌড়ায়।

ঘণ্টা কয়েক হেঁটে-দৌড়ে, ঘেমে, ফোস্কা পড়া পায়ে সে সন্ধ্যা লাগার মুখে এসে পৌঁছায় মনু ব্রিজের কাছাকাছি। এ দিককার দোকানপাঠ সব বন্ধ। মানুষজন দূরে থাক, কোথাও কোন পোক-পরিন্দারও দেখা মিলে না। গাছ-বিরিক্ষের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না। কেমন যেন ছমছমে অনুভূতি নিয়ে যে ছাতিম তলা থেকে সে ট্রাকে চেপেছিল ওখানে এসে দাঁড়ায়। সবুজ ঘাসে পড়ে থাকা নীল চুড়ির ভাঙা টুকরা-টাকরায় বেলা শেষের আলো পড়ে ঝলমল করছে।

মনু ব্রিজে উঠার মুখে কী ভেবে মলয় চেনা টং দোকানটির সামনে দাঁড়িয়ে দোকানদারের নাম ধরে মৃদুস্বরে আওয়াজ দেয়। ঝাপটা একটু ফাঁক হয়। দোকানি ফিসফিসিয়ে তাকে সাবধান করে। ওপারে ব্রিজের গোড়ায় চেক পয়েন্ট বসেছে। পথচারী পুরুষদের লুঙ্গি তুলে খানসেনারা খতনার চিহ্ন খতিয়ে দেখছে।

ব্রিজ থেকে নেমে এসে নদীর পাড় ধরে মলয় উজানের দিকে হাঁটতে শুরু করে। ডুবু ডুবু সূর্যের আলোয় ওপারে গাছপালার ওপর দিয়ে উঠছে মৃদু ধোঁয়া। তার মন কু গেয়ে ওঠে। তবে কী খানসেনারা লুটতরাজের পর মিনহাজ মঞ্জিলে আগুন দিয়েছে। নদী পারের গাঁও-গেরাম মনে হয় জাদুবলে উজাড় হয়ে গেছে। সবাই কী চলে গেছে সীমান্তের দিকে? বালুচরে পড়ে থাকা কয়েকটি নৌকাকে দেখাচ্ছে কাইয়ূম চৌধুরীর আঁকা জলরঙের চিত্রটির মতো।

আরও কিছু দূর হেঁটে গিয়ে চরে ঠেকানো বাঁশের বিশাল একটি চালি দেখতে পায়। চালিটির মাঝামাঝি বাঁশ-বেত-ছনে তৈরি দোচালা উরা-ঘর। তার দাওয়ায় বসে থেলো হুঁকায় ধূমপান করছে এক নাইয়া। মলয় থেমে ওপারে যাওয়ার বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করে। নাইয়া মাথা দুলিয়ে তাকে হুশিয়ার করে দেয়- না গো বাবু, ওপারে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ডাকবাংলোর কাছে তিন-চারবার গোলাগুলি হয়েছে, ঘরদুয়ারও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে একদম ছাতু করে দিয়েছে।

মলয় ফের পা বাড়ায়। না, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শরণার্থী হওয়ার ললাট নিয়ে সে জন্মেনি। তার দিদিমা বিছানায় নেতিয়ে পড়ে আছেন। তাকে নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে যেতেই হবে।

কখন যে সূর্য ডুবে গেছে সে ঠিক বুঝতেও পারে না। নদীর পাড়ে কাশবনে শিয়ালগুলো হুক্কা হুয়া ধ্বনিতে মেতে ওঠে। বালুচর অতিক্রম করে সে জলে পা দেয়।

মনু নদীতে স্রোত তেমন নেই। সে গৃহদেবতার উদ্দেশ্যে হাত জোড় করে বলে… ‘ঠাকুর’, তারপর অন্ধকারে সাঁতরাতে থাকে ওপারের উদ্দেশ্যে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে