আইনজীবী পলাশ কুমার রায় আত্মহত্যা করেছেন বলে হাইকোর্টে বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে তদন্ত প্রতিবেদনটি উপস্থাপনের পর এ বিষয়ে শুনানি হয়। এরপর আদালত আদেশ দেয়।
পঞ্চগড় জেলা কারাগারের ভেতরে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর গত ৩০ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আইনজীবী পলাশের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল।
আজ শুনানির সময় তদন্ত প্রতিবেদন দেখে হাইকোর্ট বিচারিক বলেন, এখানে তো বলা হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি আত্মহত্যা।
এছাড়া হাইকোর্টে দাখিল করা বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদনে পঞ্চগড় কারাগারে গ্যাস লাইটারের অবাধ ব্যবহার, অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা না থাকা, কারাগারের ভেতরে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা না থাকা, কারাগারে জেল সুপার না থাকা, কারা হাসপাতালে ডিপ্লোমা নার্সের দায়িত্ব পালন ও খুনের মামলার আসামিকে দিয়ে সার্জিক্যাল বিভাগের দায়িত্ব পালন করানোর বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়।
সেই সাথে এই বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদনে দেওয়া পলাশের মা ও ভাইয়ের বক্তব্যের আলোকে রিটকারি আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, পলাশের গায়ে আগুন লাগার ২৪ ঘণ্টা পর তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। দাপ্তরিক ও আনুষঙ্গিক কাজের জন্য এই ২৪ ঘন্টা সময় চলে যায়।
আজ শুনানির পর হাইকোর্ট এই বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদনের কপি স্বরাষ্ট্রসচিব ও আইজি প্রিজন বরাবর পাঠানোর নির্দেশ দেন। সেই সাথে পঞ্চগড় কারাগারের নিরাপত্তা ও কারা হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার অব্যবস্থাপনার বিষয়ে এই দুই কর্মকর্তাকে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। এবং আগামী ১৫ অক্টোবর এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছে আদালত।
আজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
ঘটনার বিবরণ থেকে জানা যায়, আইনজীবী পলাশ রায় পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মীরা রানী রায়ের ছেলে।
কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের আইন উপদেষ্টা ছিলেন পলাশ। ২০১৬ সালে বেসরকারি কোম্পানি কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের ৩১ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় র্যাব গ্রেপ্তার করেছিল তাকে। পরে তিনি এ মামলায় জামিন পান।
সর্বশেষ গত ২৫ মার্চ দুপুরে পলাশ তার বিরুদ্ধে করা কোহিনূর কেমিক্যালের ৩১ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলাটি প্রত্যাহারের দাবিতে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে পরিবারের লোকজন নিয়ে অনশন শুরু করেন।
একপর্যায়ে সেখান থেকে উঠে এসে পঞ্চগড় শের-ই-বাংলা পার্ক–সংলগ্ন মহাসড়কে এসে মানববন্ধন করেন। এ সময় মানববন্ধন থেকে তিনি মাইকে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ‘কটূক্তি’ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এরপর আশপাশের লোকজন পলাশ রায়কে পঞ্চগড় সদর থানা-পুলিশে সোপর্দ করে এবং সেদিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রী নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে পলাশের বিরুদ্ধে পঞ্চগড় জেলা শহরের ধাক্কামারা ইউনিয়নের বাগানবাড়ি এলাকার রাজিব রানা মামলা করেন। ওই মামলায় ২৬ মার্চ দুপুরে পঞ্চগড়ের আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়।
কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, পলাশ সেরোসিস ‘অর্থাইটিস রোগী বলে’ তাকে সহানুভূতি দেখিয়ে কারা অভ্যন্তরে হাসপাতালে রাখা হয়। এরপর ২৬ এপ্রিল সকালে হাসপাতালের বাইরে থাকা একটি টয়লেট থেকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় পলাশ দৌড়ে বের হলে কারারক্ষীরা তার শার্ট-প্যান্ট ছিঁড়ে শরীরের আগুন নেভান। পরে তাকে পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এরপর তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় এবং সেখান থেকে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ওইদিন দিবাগত রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
অবশেষে ৩০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আইনজীবী পলাশ রায়।
পলাশের অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষকে দায়ি করে ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন পলাশের মা মীরা রানী। তিনি বলেন, বংশীয়ভাবে আমরা আওয়ামী লীগের সমর্থক। দলীয় সমর্থনেই আমি উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ছিলাম। আমার স্বামী ৩৬ বছর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন (বছরখানেক আগে প্রয়াত)।
এদিকে আইনজীবী পলাশ রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে গত ৬ মে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন।
সে রিটের শুনানি নিয়ে গত ৮ মে হাইকোর্ট রুল জারিসহ পলাশ কুমার রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় বিচারিক তদন্তের নির্দেশ দেন। পঞ্চগড়ের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে এ তদন্ত করে প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করতে বলা হয়। সে অনুযায়ী হাইকোর্টে বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।