কাশ্মীর নিয়ে আবার একটি ভুল ভারতের

আহমদ রফিক

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক। ফাইল ছবি

কাশ্মীর ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরকধর্মী বোমা, প্রতীকী অর্থে দীর্ঘদিন থেকে কথাটা বলা হলেও এর বিপজ্জনক বাস্তবতা অনস্বীকার্য। এর দায় ভারত ও পাকিস্তান উভয়েরই। তবে যথারীতি এর সূচনা ঘটায় ১৯৪৭ সালের সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান।

কারণ ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ করা যে কী কঠিন কাজ তা সিরিল র‌্যাডক্লিফ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছিলেন। জিন্নাহ ইচ্ছা করেই চোখ বন্ধ করে ছিলেন রাজনৈতিক বিচারে তাঁর উদ্ভট পরিকল্পনার অস্বাভাবিকতা লক্ষ করে।

তাই প্রথম দফায়ই তাঁর কণ্ঠে চরম স্ববিরোধী ঘোষণা খণ্ডিত ভারতে ফেলে যাওয়া ভারতীয় মুসলমানদের উদ্দেশে, যাতে তারা ভারত ডোমিনিয়নের অধীনে বিশ্বস্ত নাগরিক হিসেবে বসবাস করে। ভারত বিভাগ উপলক্ষে ছোট-বড় কতগুলো বোমা যে ফাটানো হয়েছে, তা হিসাব করে দেখার বিষয়।

এই ঘোষণা ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগানধারী এবং জিন্নাহ কর্তৃক পরিত্যক্ত ভারতীয় মুসলমানদের স্তব্ধ করে দিয়েছিল তাদের স্বপ্নের পাকিস্তানে যেতে না পেরে। জিন্নাহ তো ভারতীয় মুসলমান সবাইকে স্বতন্ত্র মুসলমান ভূমি পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তিনি তিন-সাড়ে তিন কোটি মুসলমানকে তাঁর ভাষ্যের হিন্দু ভারতে রেখে তাঁর ব্রিফকেস গুছিয়ে পাকিস্তানের উদ্দেশে পাড়ি জমালেন।

দ্বিতীয় স্ববিরোধিতায় র‌্যাডক্লিফ সাহেব দেখলেন, ভারতে বঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের বসবাস ও সহাবস্থান এমন নিগূঢ় সান্নিধ্যে যে পরিচ্ছন্ন সীমারেখা টেনে রাষ্ট্রীয়ভাবে এদের আলাদা করা কঠিন। ভারত-পাকিস্তান বিভাগ তাই নৈরাজ্যিক হতে বাধ্য। প্রাকৃতিক সীমানাও এ ব্যাপারে বিভাজনবিরোধী। তাই তাঁর কিছু করার নেই। তাঁর বিচার-বুদ্ধিমতো লাল-কালো কালির টানে অবুঝ এই দুই জনগোষ্ঠীকে কিছু একটা বুঝিয়ে দিতে হবে। অথবা বুঝিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তাঁর হিসাব-নিকাশ মতো ভাগাভাগিটাই শেষ কথা।

বাস্তবে তাই ঘটেছিল। বাংলা বিভাগের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিভাজক রেখা কারোর বাড়ির উঠানের ওপর দিয়ে, কারো জমির মাঝখান দিয়ে গেছে, কী দুরবস্থাই না মানুষের। ট্রেন লাইনের এক পাশে ভারত, তো অপর পাশে পাকিস্তান। গঙ্গাসাগর কমলাসাগর এপারে-ওপারে। সবচেয়ে বড় উদ্ভটত্ব হলো ব্যাপক মুসলমানপ্রধান মুর্শিদাবাদ জেলা পদ্মার ওপারে ভারতে, আর হিন্দুপ্রধান খুলনা নদীর এপারে পাকিস্তানে। অবাস্তব এক বিভাজন।

দুই.

এই স্ববিরোধিতার আরেক প্রকাশ ব্রিটিশ ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে। শাসক এক সম্প্রদায়ের তো শাসিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্য ভিন্ন সম্প্রদায়ের। আবার তাদের অবস্থানও সর্বদা বিভাজননীতির পক্ষে নয়। হায়দরাবাদের নিজাম বা কাশ্মীরের মহারাজা হরিসিংয়ের মনে নানা দ্বিধা। মূলনীতিমাফিক তাদের পাকিস্তান বা ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে হবে। এর ব্যতিক্রম চলবে না। কিন্তু তাদের ইচ্ছা স্বাধীন দেশীয় রাজ্য।

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের ওপর জিন্নাহসহ পাকিস্তানি শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি বরাবরই ছিল। তাই দুর্বল সেনা শক্তির কাশ্মীর দখলের পরিকল্পনা তাদের। পাকিস্তানের দুর্ধর্ষ উপজাতীয়দের দিয়ে প্রথম আক্রমণ কাশ্মীরের ওপর। মুজফফরাবাদসহ বেশ কিছু শহর জবরদখল হয়ে যাওয়ার পর হরিসিংহের নিদ্রাভঙ্গ। কারণ ওদের পেছনে আসছে পাকিস্তানি সেনারা। ঘটনা ১৯৪৭ সালের শেষ দিককার।

বিপন্ন হরিসিং শেষ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে সংযুক্তির পক্ষে মতামত জানান। স্বাক্ষরদান অনুষ্ঠান দ্রুত শেষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে। কিন্তু সমরশক্তিতে বিশ্বাসী পাকিস্তান ছাড়ার পাত্র নয়। তাই দেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গেই কাশ্মীর নিয়ে পাক-ভারত সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের দৌত্যে স্থিতাবস্থায়। পাকিস্তানের দখলকৃত অংশ বিচ্ছিন্ন নাম আজাদ কাশ্মীর এবং তা নামেই আজাদ—এক কাশ্মীরি মেডিক্যাল ছাত্রের ভাষায় দুটিই গোলাম কাশ্মীর।

কাশ্মীরের জননেতা শেখ আবদুল্লাহ তখন হরিসিংহের কারাগারে বন্দি, তাঁর মুক্তির পর তাঁদের রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সই জম্মু-কাশ্মীর উপত্যকা শাসন করেছে সংসদীয় পদ্ধতির নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেহরুর বন্ধুস্থানীয় রাজনীতিক শেখ আবদুল্লাহর সঙ্গে সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলেননি। মুসলমানপ্রধান কাশ্মীরের রাজনীতিতে নানা মত—একপর্যায়ে জঙ্গিবাদের উত্থান, পাকিস্তানের ক্রমাগত অপপ্রচার, কাশ্মীরের ভেতরে ক্রমাগত হিংসাত্মক, ধ্বংসাত্মক তৎপরতার উসকানি, পাকিস্তানকেন্দ্রিক জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান যেমন সত্য, তেমনই সত্য ভারতীয় শাসকদের শেখ আবদুল্লাহ পরিবারের প্রতি আস্থার অভাব, সমরশক্তির ওপর বিশ্বাস, অনেকটা পাকিস্তানি কায়দায়। ফলে সেনাবাহিনীর অনাচারের বিরুদ্ধে জনগোষ্ঠীর বিক্ষোভ, বিরোধিতা ভারতবিদ্বেষে পরিণত, ক্রমে এর তীব্রতা, ব্যাপকতা বৃদ্ধি। আমি এক ভারতীয় সমাজসেবী মহিলা সাংবাদিকের কাছে শুনেছি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের অনাচারের কথা, বিশেষ করে নারীর ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনাবলি।

তিন.

ভারতের সঙ্গে যুক্ত কাশ্মীরের দাবি ছিল স্বায়ত্তশাসন, আপন বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে। স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজ্য কাশ্মীরের এ দাবি যুক্তিহীন ছিল না। কিন্তু তরুণদের একাংশের ছিল স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি, যা ভারতের মানার কথা নয়। কিন্তু সেনা উপস্থিতি ও তৎপরতাও জনগণের মানার কথা নয়। এই ভুলটা ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের, তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল নেতাদের ওপর আস্থা না রাখা।

কাশ্মীর দখল করতে ভুট্টোর হাজার বছরের যুদ্ধের হুমকি, ভারতের উচিত ছিল বাস্তবতার ভিত্তিতে মোকাবেলা করা। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের কয়েকটি যুদ্ধ ভারতের শুভভিত্তির ভিত নড়বড়ে করে দেয়। সমরশক্তির জোরে নয়, সহানুভূতিশীল মমতায় জনগণের চিত্তজয়ের নীতি গ্রহণ করা উচিত ছিল ভারতের। ভারতের অনুসৃত কাশ্মীরবিষয়ক সমরবাদী নীতি ভারত-কাশ্মীর সম্পর্ক দুর্বল করে ফেলে।

ভারতের কাশ্মীর নীতির ভাবনায় একটি প্রবণতা বরাবর গুরুত্ব পেয়েছে। আর তা হলো, স্বশাসিত বা স্বাধীন কাশ্মীর ধর্মীয় ঐকমত্যে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে। এ ধারণা সঠিক ছিল না। স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে পাকিস্তানের কাছে আত্মবিক্রয় কখনো কাম্য হতে পারে না—কাশ্মীরের ক্ষেত্রে এটাই ছিল বড় সত্য। একটি জনগোষ্ঠীর সমাজে বিভিন্ন মতাদর্শের প্রাধান্য থাকবে—এমনটাই স্বাভাবিক। কাজেই তাদের মধ্যে সেনা তৎপরতার প্রতিক্রিয়ায় সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান কার্যকারণ প্রক্রিয়ার অন্তর্গত। তাদের দমন করার দায়িত্ব সংসদীয় গণতন্ত্রী শাসকদের ওপর ন্যস্ত করাই যুক্তিসংগত পদক্ষেপ নিতে পারত। ভারত সেসব যুক্তিবাদী পথের পরিবর্তে সেনাশক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছে।

চার.

অশান্ত কাশ্মীরের এমন এক অস্থির পরিবেশে ভেবেচিন্তে আপাত সর্বশেষ বোমা ফাটাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার। কাগজগুলোতে মোটা হরফে বিচিত্র শিরোনামেও মমার্থ একই : কাশ্মীর তার রাজ্যসত্তা হারাল, স্বায়ত্তশাসন হারাল, বিভাজিত হলো কাশ্মীর, লাদাখ ভিন্ন একটি অঞ্চল গোটা কাশ্মীর ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে। সংবিধানের সুবিধাপ্রাপক ধারা বর্জিত।

এককথায় কাশ্মীরে কেন্দ্রীয় শাসন জারি এবং এককালের কার্জনীয় নীতি বঙ্গভঙ্গ অনুসরণে কাশ্মীর ভঙ্গ, তথা বিভাজন। গৃঢ় উদ্দেশ্য কাশ্মীরি প্রতিবাদীদের শক্তিহীন করা, সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রসার ঘটানো। প্রসঙ্গত, লাদাখের সীমান্ত পুরুত্ব স্মরণযোগ্য। দুই লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে এখন থেকে শাসিত হবে—সাবেক জম্মু কাশ্মীর, দুই ভিন্ন নামে। বলতে গেলে প্রকৃতপক্ষে চলবে সামরিক শাসন।

এমন একটি অগণতন্ত্রী, সম্প্রদায়বাদী চরম রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধে সেখানে বিশালসংখ্যক সেনা সদস্য জড়ো করা হয়েছে। সমস্যা মোকাবেলায় জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা এবং কারফিউ। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, জম্মু কাশ্মীরে প্রতি হাজার লোকের জন্য ৭৭ জন সেনা মোতায়েন। দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রীসহ কয়েকজন রাজনীতিক গ্রেপ্তার ও গৃহবন্দি।

বিজেপির এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর রাজ্য তোলপাড়, দিনটিকে তারা আখ্যায়িত করে ‘কালো সোমবার’ নামে। সংখ্যাধিক্যের জোরে সংবিধানে পরিবর্তন। অন্যদিকে পাকিস্তানের হুমকি ব্যবস্থা নেওয়ার। আরেকটি পাক-ভারত যুদ্ধ কি আসন্ন? না, বিশৃঙ্খল পাকিস্তানের এমন শক্তি নেই। বিশ্বশক্তি চাইবে না ধ্বংসাত্মক আণবিক যুদ্ধ। যা করার কাশ্মীরি জনগণকেই করতে হবে? বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছিল গণ-আন্দোলনে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমন সম্ভাবনা কম, তৎকালীন ইংরেজ যুক্তিবাদী চিন্তা আধুনিক ভারতে গেরুয়াপন্থীদের কাছ থেকে আশা করা বৃথা।

এ ব্যাপারে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে আন্তর্জাতিক মহলের? আমার ধারণা, ইঙ্গ-মার্কিন-ভারতীয় আঁতাতের পরিপ্রেক্ষিতে তারা বলতে পারেন, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনা, এখানে নাক গলানো ঠিক হবে না। কাশ্মীর ভঙ্গের সীমান্ত তাৎপর্য তাদের স্পর্শ করছে না, করবে চীন ও রাশিয়াকে। কিন্তু সাধের পাকিস্তান? এখন তো সেদিকে তাদের, বিশেষত মার্কিনদের আগ্রহ বোধগম্য কারণে কমে গেছে। ওরা ডলারের ঋণশৃঙ্খলে আবদ্ধ, তাদের দরকার ভারতকে, চীনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে।

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে