তিন বোন মিলে বাবাকে খুনের কারণ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

তিন বোন মিলে বাবাকে খুন
তিন বোন। ছবি : ইন্টারনেট

২০১৮ সালের ২৭ জুলাই নিজ বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন ৫৭ বছর বয়সী মিখাইল খাচাতুরান। ওই সময় তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে তারই তিন মেয়ে। ঘটনাটি ঘটে রাশিয়ার মস্কোর একটি ফ্ল্যাটে।

হত্যাকাণ্ডটি ওই সময় রাশিয়ার পাশাপাশি গোটা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। অনেকেরই ধারণা ছিল না, ঠিক কী কারণে তিন বোন বাবাকে খুন করেছিল। শুরু হয় তদন্ত। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে খুনের আসল কারণ।

হত্যাকাণ্ডের সময় তিন মেয়ে ক্রিস্টিনা, অ্যাঞ্জেলিনা ও মারিয়ার বয়স ছিল যথাক্রমে ১৯, ১৮ ও ১৭ বছর।

তিন বোন পুলিশকে জানায়, ঘটনার দিন তাদের বাবা তিন বোনকে একে একে তার ঘরে ডেকে নেন। এরপর ঘর পরিষ্কার না করায় প্রচণ্ড বকাঝকা করেন এবং তাদের মুখে পেপার গ্যাস স্প্রে করেন।

তারা জানান, এই ঘটনার কিছুক্ষণ পর তিন বোন ঘুমন্ত বাবার ওপর ছুরি, হাতুড়ি ও পেপার স্প্রে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনজন মিলে বাবার মাথা, ঘাড় ও বুকে কমপক্ষে ৩০টি আঘাত করে তাকে হত্যা করে। এরপরই তারা পুলিশকে খবর দেয়।

শুধু বকাঝকা করার জন্য বাবাকে এভাবে কেউ হত্যা করতে পারে– এটা মানতে পারছিলেন না তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এরপরই তারা তদন্তে নামেন। তদন্তে তারা ওই পরিবারের পারিবারিক সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস জানতে পারেন।

তাদের তদন্তে উঠে আসে টানা তিন বছর ধরে মেয়েদের বাবা কীভাবে তাদেরকে মারধর করতেন, কয়েদির মতো আটকে রাখতেন এবং নিয়মিত তাদের ওপর যৌন অত্যাচার চালাতেন সেই সব ঘটনা।

হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ জানার পর রাশিয়ার বেশিরভাগ মানুষই ওই তিন বোনের পক্ষ নেন। মামলাটি দ্রুত আলোচিত হয়ে ওঠে রাশিয়ায়। মানবাধিকার কর্মীরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন।

তারা বলেন, তিন বোন অপরাধী নয়, তারা ঘটনার শিকার মাত্র। কারণ অত্যাচারী বাবার যৌন নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতেই তারা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের মুক্তির জন্য ওই সময় অনলাইনে ৩ লাখেরও বেশি মানুষ স্বাক্ষর করেন।

এমনিতে রাশিয়ায় পারিবারিক সহিংসতা রোধে কোনো আইন নেই বলে জানা গেছে। ২০১৭ সালে অবশ্য একটা আইন করা হয়। সেখানে বলা হয়, পরিবারের সদস্যকে মারধর করেছেন কিন্তু তাদের হাসপাতালে যাওয়ার মতো খারাপ অবস্থা করেননি– এমন অপরাধ করলে জরিমানা বা সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ শাস্তি হতে পারে।

পারিবারিক সহিংসতাকে রাশিয়ায় পারিবারিক বিষয় ভাবা হয়। এ কারণে পুলিশ সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ করে না।

ওই তিন মেয়ের মা অওরেলিয়া ডানডুকও নিহত মিখাইলের হাতে নির্যাতিত হতে বলেন জানা গেছে। তিনি কয়েক বছর আগে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলাও করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকায় পুলিশ ওই সময় তাকে কোনো সহায়তা করেনি।

নিহত মিখাইল মারধর করে তার স্ত্রী অওরেলিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। ওই সময় অওরেলিয়া মেয়েদের সঙ্গে নিতে চাইলেও মিখাইল দেননি।

খবরে প্রকাশ, তিন বোন মিলে যখন তাদের বাবাকে হত্যা করে তখন মেয়েদের মা তাদের সঙ্গে থাকতেন না। মা চলে যাওয়ার পর তার সঙ্গে তিন বোনকে যোগাযোগ করতেও নিষেধ করেছিলেন তাদের বাবা।

আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মামলা খুব ধীরগতিতে চলছে। হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত তিন বোনকে কারাগারে থাকতে হয় না। কিন্তু তারা কড়া নজরদাড়িতে থাকেন। তারা কোনো সাংবাদিক বা অন্য কারো সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। মনোবিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে তিন বোনের চিকিৎসাও চলছে।

মামলাটি নিয়ে এখনও তর্ক-বিতর্ক চলছেই। বাদীপক্ষের আইনজীবীরা জোর দিয়ে বলছেন, মিখাইল হত্যাকাণ্ড পূর্ব পরিকল্পিত। কারণ তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন এবং তিন বোন ছুরি হাতে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের যুক্তি, তিন বোনের উদ্দেশ্যই ছিল প্রতিশোধ নেওয়া।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, নিজেদের বাঁচাতেই তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। রাশিয়ার আইনে নিজেকে বাঁচাতে তাৎক্ষণিক ‘আত্মরক্ষা’ আইন ছাড়াও ধারাবাহিকভাবে নির্যাতনের ক্ষেত্রে ‘আত্মরক্ষা’ আইন প্রচলিত আছে।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আরও বলছেন, তিন বোন দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ কারণে তাদের মুক্তি দেওয়া হোক। তারা আশা করছেন, আত্মরক্ষা আইনে তিনবোন শিগগিরই মুক্তি পাবে।

অন্যদিকে তিন বোনের বিরুদ্ধে আনা হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তাদের সর্বোচ্চ ২০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

দেশটির সাধারণ মানুষ ও মানবাধিকার কর্মীদের অনেকেই চাইছেন পারিবারিক সহিংসতা রোধে বিদ্যমান আইনটির পরিবর্তন হোক।

সূত্র: বিবিসি

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে