ভারতীয় উপমহাদেশের বাম রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব, মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টাম-লীর সর্বশেষ সদস্য, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর নেই। শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে তিনি রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি…রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের একমাত্র জীবিত সদস্য ছিলেন।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়।বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রাম তাতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের বড় অবদান রয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার কাকরাইলে মোজাফফর আহমদের বাবার বাড়ি লক্ষ্য করে গোলাগুলি শুরু হলে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে যান।এরপর সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান ভারতের আগরতলায়।
তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক।ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলাবাহিনীরও তিনি অন্যতম সংগঠক।একাত্তরে ন্যাপ ও কমিউনিস্টপার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে বিশেষ গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলায় নেতৃত্ব দেন মোজাফফর আহমদ। প্রশিক্ষণ শেষে ওই বাহিনী ঢাকা, নরসিংদী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।
বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় ও জনমত গড়ে তোলার জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। জাতিসংঘেও তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন।জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে ভূমিকা পালন করেন মোজাফফর আহমদ।
১৯২২ সালে জন্ম নেওয়া এই ব্যক্তিত্ব ১৯৩৭ সালে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। রাজনীতি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় চাকরি ছেড়েছেন। তিনি যখন ঢাকা কলেজের শিক্ষক তখন থাকতেন আজমপুরে আট/ আই কলোনির বাসাতেই। সেখানেই ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত করার মিটিং হয়েছিল।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে মোজাফফর আহমেদ দেবীদ্বার থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তদানীন্তন মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রী মফিজুল ইসলামকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে নজির সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্থানকে স্বায়ত্ত্বশাসন করার প্রস্তাব করে তিনি অনেক রাঘব বোয়ালের রাজনীতিতে ধাক্কা দিয়েছিলেন। যদিও বা সেই প্রস্তাব পাশ হয়েছিল, তথাপি তখন সেটা খুব সহজ কথা ছিলনা। না বললেই নয়, পূর্ব পাকিস্থান গণপরিষদে তার প্রস্তাবের পক্ষে বক্তৃতা করে জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে ইতিহাসের মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছয় দফা প্রথমদিকে যারা জোরালোভাবে সমর্থন করে এগিয়ে নিয়েছিলেন তাদের অন্যতম অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ।
১৯৬৮ সালে ন্যাপ দু`ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একভাগ মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে থাকলেও অন্য অংশ অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে আলাদা হয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে তাজউদ্দিন আহমেদ ছয় জন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদকে নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। যেখানে মাওলানা ভাসানী, মণি সিং, মনোরঞ্জন ধরের মতো রাজনীতিবিদরা ছিলেন। তাদের অন্যতম কমরেড মোজাফফর আহমেদ। বাম সমর্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে তখন একটি বিশাল মুক্তিযোদ্ধাবাহিনীও গঠন করা হয়েছিল। তার নেতৃত্বও দিয়েছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিদেশে জনমত গঠন করতে তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন। তাকে তখন জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশনে যোগ দিতেও হয়েছিল।
১৯৭৯ সালে তিনি পুনরায় দেবীদ্বার থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে `কুঁড়েঘর` মার্কায় প্রার্থী হন। `আমার নাম মোজাফফর, মার্কা আমার কুঁড়েঘর` এই স্লোগানে দোকানে দোকানে তাকে সহজ সরল ভাবে ভোট চাইতে দেখা যায়। যদিও বা পাতানো সেই নির্বাচনে তার প্রাপ্ত ভোট দেখানো হয়েছিল মাত্র ১ শতাংশ তথাপি বন্দুকের নলের দিকে বুক তাক করে করা সেই সাহসী রাজনীতি ইতিহাসে দাগ কেটে গেছে।
নিরিবিলি রাজনীতি করার সুযোগ তিনি কখনো পাননি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান তার নামে হুলিয়া জারি করেন। তখন তার মাথার দাম হাঁকা হয়েছিল। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বেশীর ভাগ সময় তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর তাকে আবার আত্মগোপনে যেতে হয়।
জীবন সায়াহ্নে এসে বারিধারার পার্ক রোডে মেয়ের বাড়িতে থাকেন তিনি। অবশেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। দেশের প্রগতিশীল রাজনীতিতে তার অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।