মানবতা ও সাম্যের কবি

নিতাই চন্দ্র্র রায়

কবি কাজী নজরুল ইসলাম
কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ফাইল ছবি

কলকাতার এলবার্ট হলে হিন্দু-মুসলমানদের পক্ষ থেকে কবি নজরুল ইসলামকে এক বিশাল গণসংবর্ধনা দেওয়া হয় ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর। কলকাতার এলবার্ট হলে ওই সংবর্ধনার সময় নজরুলের বয়স ছিল মাত্র ২৯ বছর। কবি নজরুলকে উদ্দেশ্য করে ওই সময়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্ব নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বলেন, ‘আমি সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছি, কিন্তু দুর্গম গিরি কান্তার মরুর মতো কোনো গান আমি খুঁজে পাইনি।’ তিনি আরও বলেন, যেদিন দেশ স্বাধীন হবে, ভারতবর্ষ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবে বাঙালির জাতীয় কবি হবেন কাজী নজরুল ইসলাম। তার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নেতাজীর সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে খুব ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন তার দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা। দেশের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে তিনি ভ্রমণ করতেন সাংগঠনিক কাজে। বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, বাঙালির স্বাধীনতার জন্য তিনি বক্তৃতা করতেন প্রাঞ্জল ভাষায়। মানুষ তার বক্তৃতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রবণ করতেন। সেসব বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু প্রায়ই নজরুলের কবিতার অংশবিশেষ আবৃত্তি করতেন। বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নজরুলের গান ও কবিতা অসীম অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত- কারার ঐ লৌহ কপাট,/ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট,/রক্ত জমাট/শিকল পূজার পাষাণ বেদী। শিকল পরা ছল/মোদের এই শিকল পরা ছল/এই শিকল পরেই/শিকল তোদের করবো রে বিকল। তাঁর রচিত গণসংগীতগুলো দেশের কৃষক শ্রমিক ও ছাত্রজনতাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সাহস জুগিয়েছে হানাদার পাক সেনাদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করার। একই রকম অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ- ‘তোমাদের যা কিছু তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ কী অদ্ভুত মিল বাঙালির আর এক মহান নেতা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর বক্তব্যের সঙ্গে। তিনি বলতেন, ‘আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ভারত সফরেই শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করে নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে। আর এভাবেই ১৯২৯ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর দেখা সেই স্বপ্নের সার্থক বাস্তবায়ন বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক বাণীতে বলেন, ‘কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার বিদ্রোহী আত্মার ও বাঙালির স্বাধীন-ঐতিহাসিক-সত্তার রূপকার। বাংলার শেষ রাতের ঘনান্ধকারে নিশিত-নিশ্চিত নিদ্রায় বিপ্লবের রক্ত-লীলার মধ্যে বাংলার তরুণরা শুনেছে রুদ্র-বিধাতার অট্টহাসি, কাল-ভৈরবের ভয়াল গর্জন, নজরুলের জীবনে, কাব্যে, সংগীতে ও তার কণ্ঠে। প্রচন্ড সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মতো, লেলিহান অগ্নিশিখার মতো, পরাধীন জাতির তিমির-ঘন অন্ধকারে বিশ্ববিধাতা নজরুলকে এক স্বতন্ত্র ছাঁচে গড়ে পাঠিয়েছিলেন এই পৃথিবীতে।’

নজরুলকে ভালোবাসতে হলে তার চেতনার চারা রোপণ করতে হবে জাতির হৃদয়ের উর্বর মাটিতে। পরিচর্যা করতে হবে পরম যত্নে। পোকামাকড়, রোগবালাই ও আগাছা দমন করতে হবে সঠিক সময়ে। স্বপ্নের সেচ ও সার প্রয়োগ করে চারা গাছটিকে মহিরুহে পরিণত করতে হবে। এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে কবি, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও রাজনীতিবিদদের। এ ছাড়া নজরুলের স্বপ্ন জাতির জনকের স্বপ্ন শোষণহীন সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে না। সম্ভব হবে না ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার লেখনীতে যেমন সমাজের সব অন্যায়, অবিচার ও অসাম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন; তেমনি মানুষের মধ্যকার বিভেদের সব প্রাচীর ভেঙে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তার কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর সব মানুষ সমান। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। তার কাছে নারী-পুরুষের মধ্যে কানো পার্থক্য নেই। বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণ কর।/অর্ধেক করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। তার এ অমর উক্তির মধ্যেই লুকিয়ে আছে নারীর ক্ষমতায়ন ও সম-অধিকারের অঙ্গীকার। তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখেছ তাহার প্রাণ/অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শাহজাহান। পৃথিবীর প্রতিটি মহৎ কাজের পেছনে রয়েছে নারী-পুরুষের যৌথ অবদান।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তৈরি পোশাকশিল্প, চাশিল্প ও কৃষিকাজের সঙ্গে রয়েছে নারীর নিবিড় সম্পর্ক। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের শতকরা ৮০ ভাগে আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এ শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের সিংহভাগ হলো নারী। শুধু পোশাকশিল্প কেন? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুলিশ, প্রশাসন, রাজনীতি, স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধি ও জাতীয় সংসদসহ দেশের সব পেশায় রয়েছে নারীদের অবাধ বিচরণ। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের স্পিকারও হলেন নারী। আর এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে জাতীয় কবি নজরুল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শে উদ্দীপ্ত শেখ হাসিনার সাহসী ও সঠিক পদক্ষেপের কারণে।

অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ ও সাম্যবাদী রাষ্ট্রের প্রতি ছিল নজরুলের আজীবন পক্ষপাত। এজন্য তুরস্কের রক্ষণশীল ব্যবস্থা ভেঙে যখন মোস্তফা কামাল পাশা আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের স্বপ্ন দেখেন, তখন নজরুল তাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে কবিতা লেখেন। মানবতা, প্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা সাম্য প্রভৃতি ছিল নজরুলের মূল চেতনা। তাইতো তিনি লিখেছেন ‘সাম্যের গান গাই/ আমার চক্ষে পুরুষ রমণীর কোনো ভেদাভেদ নাই। পৃথিবীর কজন কবির কবিতায় নারী অধিকার নিয়ে এ ধরনের কথা উচ্চারিত হয়েছে? নারীকে পর্দার অন্ধকার প্রাচীরে বন্দি করে রাখলে অন্ধাকার গুহার ভেতরে পুরুষকে না খেয়ে মরতে হবে। এমন সত্য কথাইবা বলেছেন কজন কবি?

নজরুলের সাহিত্যকর্মে দুটি ভাবকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। একটি হলোÑ সমাজের নানাবিধ বৈষম্যের প্রতি তার তীব্র ক্ষোভ। আর দ্বিতীয়টি হলো জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা। প্রথমটি থেকে তার মধ্যে সাম্যবাদী চেতনা আর দ্বিতীয়টি থেকে তার মধ্যে সন্ধান মিলে বিশ্ব মানব ধর্মের প্রেরণা। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, ছায়ানট, জিঞ্জির, চক্রবাক প্রভৃতি গ্রন্থে কবিকণ্ঠে বারবার বেজে উঠেছে সংগ্রামের আহ্বান। তার এই সংগ্রাম ও বিপ্লব আকাক্সক্ষার কোনো আপস নেই। বিরাম নেই। নেই কোনো ক্লান্তি ও অবসাদ। নেই দেশকাল পাত্রের ভেদ। তার বিদ্রোহ ব্রিটিশ সামাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে। প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে। তথাকথিত নীতিবোধ, ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের বিরুদ্ধে এবং বিশ্ববিধাতার বিরুদ্ধে। আর এসব ভাবনা থেকেই এসেছে নজরুলের বিশ্ব মানবতাবোধ।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, নাটোর

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে