“আমি এদেশের ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে বলতে চাই, তুমি যদি পরিশ্রম করতে রাজি থাক (এবং ফেসবুকে লাইক দেয়া এবং লাইক পাওয়ার প্রলোভন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পার), তাহলে এ পুরো পৃথিবী তোমার জন্য উন্মুক্ত। ”
আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে আমরা যখন ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছি তখন তিন বছরে বিএসসি অনার্স ডিগ্রি পাওয়া যেত (তারপর এক বছরে একটা মাস্টার্স ডিগ্রি!)। তবে যে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা হতো টানা তিন বছর পর! এর মঝে ডিগ্রির জন্য গুরুত্ব নেই সেরকম কিছু পরীক্ষা ছিল যেগুলো কেউ গায়ে লাগাত না। যদি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার তিন বছর পর পরীক্ষা দিতে হয় তাহলে কে আর লেখাপড়া করে? আমরাও লেখাপড়া করতাম না, খেলাধুলা করতাম, নাটক করতাম, ক্যান্টিনে বসে চা খেতে খেতে রাজা-উজির মারতাম!
তিন বছর সময়টাও টেনেটুনে আরও লম্বা হয়ে যেত এবং শেষ পর্যন্ত যখন পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হতো আমরা দরজা বন্ধ করে পড়াশোনা শুরু করতাম। সে কী পড়াশোনা- আজকালকার ছেলেমেয়েরা দেখলে ভিরমি খেয়ে যাবে। টানা তিন বছরের পড়াশোনা তিন মাসের ভেতরে মস্তিষ্কে ঠেসে ঢোকাতে হবে, মস্তিষ্ক যে ফেটে চৌচির হয়ে যায়নি সেটাই আশ্চর্য! পরীক্ষার দিনগুলোতে ডান হাতটা যত্ন করে বুকের কাছাকাছি ধরে রেখেছি। রিকশা থেকে পড়ে হাত মচকে গেলে কিংবা ভেঙে গেলে তিন বছরের পুরো পরিশ্রমের সলিল সমাধি হয়ে যাবে!
প্রায় আঠারো বছর দেশের বাইরে কাটিয়ে যখন দেশে ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি তখন দেখতে পেলাম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ব্যাচেলর ডিগ্রি তিন বছর থেকে বাড়িয়ে চার বছর করতে শুরু করেছে। এখন আর তিন বছর পর পরীক্ষা নয়, বছর বছর পরীক্ষা কিংবা প্রতি সেমিস্টারে পরীক্ষা। চার বছরে একটা বিএ, বিকম কিংবা বিএসসি ডিগ্রির পর আবার এক, দেড় কিংবা দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি। তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করতে করতে সেশন জ্যাম ছাড়াই পাঁচ ছয় বছর লেগে যাবে।
আমাদের দেশে একটা ছাত্র কিংবা ছাত্রীর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লেখাপড়া শেষ করে সংসারের হাল ধরার কথা, এতদিন যদি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে যায় তাহলে কাজকর্ম শুরু করবে কখন? মনটা খুঁতখুঁত করত, তখন নিজেকে বোঝাতাম চার বছরের ব্যাচেলর ডিগ্রির বিষয়টা এসেছে পশ্চিমা জগতের আদলে। পশ্চিমা জগতে ব্যাচেলর ডিগ্রি হচ্ছে চূড়ান্ত ডিগ্রি, এটা শেষ করে সবাই কাজে লেগে যায়। আমাদের বেলাতেও নিশ্চয়ই তাই হবে, সবাইকে জানিয়ে দেয়া হবে ব্যাচেলর ডিগ্রি নেয়ার পর তোমাদের লেখাপড়া শেষ। শুধু যারা শিক্ষকতা করবে কিংবা গবেষণা করবে তারাই মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি করতে এসো।
কিন্তু কয়েক বছরের মাঝে আবিষ্কার করলাম কীভাবে কীভাবে জানি সব ছাত্রছাত্রীকে মাস্টার্স ডিগ্রি করতে বাধ্য করা শুরু হয়েছে। এদেশে কোনো নিয়মনীতি নেই, বুঝে হোক না বুঝে হোক, বড় ও পুরনো ইউনিভার্সিটি যে নিয়ম করে ফেলে সবাইকে সেই নিয়ম মানতে হয়। চাকরির বিজ্ঞাপনে যখন মাস্টার্স ডিগ্রি চাওয়া শুরু হল তখন ছাত্রছাত্রীদের আর কোনো উপায় থাকল না, তাদের মাস্টার্স ডিগ্রি করা বাধ্যতামূলক হয়ে গেল! আমাদের দেশে কোনো নিয়মনীতি না মেনে, কোনো আলাপ আলোচনা না করে এক দু’জন মানুষের প্রাচীনপন্থী চিন্তাভাবনার কারণে উদ্ভট একটা নিয়ম চালু হয়ে যায় এবং সবাইকে সেই নিয়ম মানতে হয়, এর থেকে দুঃখের ব্যাপার কী হতে পারে? এটা কী পরিবর্তন করা যাবে?
২.
মনে আছে, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে আমরা যখন ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করার জন্য ভর্তি হতে গিয়েছিলাম তখন আমাদের স্যারেরা বেশ খোলামেলাভাবে আমাদের বলেছিলেন যে, পড়ালেখা শেষ করার পর আমরা কিন্তু কোনো চাকরি বাকরি পাব না। না বললেও কোনো ক্ষতি ছিল না, কারণ আমরা নিজেরাও সেটা জানতাম, মাত্র যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশের মানুষের মুখে খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই, মাথার ওপর আশ্রয় নেই, সেই দেশের ছেলেমেয়েরা কোন মুখে কার কাছে চাকরি চাইবে?
যেহেতু লেখাপড়া শেষে কোনো চাকরি নেই, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করলে ভালো হবে সেটি নিয়ে কেউ চিন্তাভাবনা করত না। যার যেটি পছন্দ সে সেটা নিয়ে লেখাপড়া করত। আমরা দল বেঁধে সবাই পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করেছি। পাস করে কী করব সেটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি।
এখন আর সে অবস্থা নেই, লেখাপড়া শেষে চাকরি-বাকরি পাওয়া যায় তাই যে বিষয়ে যত বেশি চাকরি সেই বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের তত বেশি ব্যস্ততা। মেয়ে হলে ডাক্তার এবং ছেলে হলে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এরকম একটা নিয়ম হয়ে গেছে বলে মনে হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়গুলোর মাঝে আবার কম্পিউটার সায়েন্স পড়ার জন্য ছেলেমেয়েরা সবাই খুব ব্যস্ত। আমি যেহেতু দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্রিয়ার মাঝে ছিলাম, ভর্তি প্রক্রিয়াটুকু খুব কাছে থেকে দেখেছি।
তাই আমি জানি প্রায় সব সময়েই একটা ছেলে বা মেয়ে যখন তার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা পছন্দের বিভাগে ভর্তি হতে পারে না তখন মনে হয় তার জীবন বুঝি পুরোপুরি ব্যর্থ এবং অর্থহীন হয়ে গেছে। সেসব ‘ব্যর্থ এবং অর্থহীন’ হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের কথা মনে রেখে আমি আজকের লেখাটি লিখতে বসেছি।
অনেকেই হয়তো লক্ষ করে থাকবেন, কিছুদিন আগে পৃথিবীব্যাপী একটি প্রতিযোগিতায় আমাদের দেশের একটি টিম চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। প্রতিযোগিতাটি ছিল প্রযুক্তিনির্ভর, আয়োজন করেছিল আমেরিকার মহাকাশবিষয়ক প্রতিষ্ঠান নাসা, যার নাম ছিল নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ। প্রতিযোগিতার শেষ পর্যায়ে আমাদের টিমটির যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মতো দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়েছে। তারা চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়ার খবরে আমি সবার মতোই খুশি হয়েছি, কিন্তু অবাক হইনি। এদেশের ছেলেমেয়েরা
আজকাল আন্তর্জাতিক নানা ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে আমাদের এক ধরনের যোগাযোগ আছে এবং এখন আমি নিশ্চিতভাবে জানি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা সোনার টুকরা ছেলেমেয়ে, আমরা তাদের সুযোগ দিতে পারি না বলে সেটা কারও চোখে পড়ে না। যদি কখনও সুযোগ দেয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে তারা কিছু একটা করে দেখিয়ে দিতে পারে। অনেক সময় সুযোগটাও দিতে পারি না, তখন শুধু একটুখানি উৎসাহ দিতে পারলেও তারা অনেক কিছু করে ফেলে।
কত সহজেই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটা বিপ্লব করে ফেলা যায়; কিন্তু কিছু না করে আমরা শুধু কালক্ষেপণ করে যাই দেখে আমার মাঝে মাঝে নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছা করে!
যাই হোক, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা একটা প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিযোগিতায় সারা পৃথিবীকে হারিয়ে দিয়েছে সেটা নিয়ে আমার আনন্দ ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার জন্য আমি এই লেখাটি লিখতে বসিনি। কারা সারা পৃথিবীকে হারিয়ে দিয়েছে তাদের সম্পর্কে একটুখানি লেখার জন্য আমি লিখতে বসেছি। যেহেতু প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু ছিল অ্যাপস ব্যবহার করে নাসার বিশাল তথ্য ব্যবহার করা সংক্রান্ত, কাজেই স্বাভাবিকভাবেই সবাই মনে করতে পারে আমাদের টিমে অংশ নিয়েছে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা।
কিন্তু অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি যে, এই টিমের চারজন প্রতিযোগীর একজন হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের, অন্য তিনজন ভূগোল বিভাগের (বিভাগের পুরো নাম জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট)। কেউ কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের নয়। তবে এদের মাঝে দু’জন আমাদের সেকেন্ড মেজর হিসেবে কম্পিউটার সায়েন্স পড়াশোনা করেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিভাগের ছাত্র হয়ে অন্য বিভাগ থেকে ডিগ্রি নেয়ার একটি পদ্ধতি ছিল, পৃথিবীর আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি বহুদিন থেকে চালু আছে।
তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবর্তন করে প্রাচীনপন্থী করে ফেলার উদ্যোগ হিসেবে এ সেকেন্ড মেজর পদ্ধতিটি সমূলে উৎখাত করা হবে বলে কানাঘুষা শুনতে পাচ্ছি। সারা পৃথিবীর মাঝে চ্যাম্পিয়ন হওয়া টিমটির কোচ আমার সাবেক ছাত্র এবং বর্তমান সহকর্মী কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন তরুণ শিক্ষক।
আমি এখন যেখানেই সুযোগ পাচ্ছি (সুযোগ না পেলে জোর করে সুযোগ তৈরি করে নিয়ে), উচ্চকণ্ঠে বলে যাচ্ছি, এই দেখ তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে একেবারে বিশ্বমানের কাজ করার জন্য তোমার কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে পড়তেই হবে সেটি সত্যি নয়। তুমি যে কোনো বিভাগের ছাত্র হয়ে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বমানের অবদান রাখতে পারবে। কাজেই তুমি তোমার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিভাগে ভর্তি হতে না পারলেই তোমার জীবন পুরোপুরি ব্যর্থ এবং অর্থহীন হয়ে গেছে মনে করার কোনো কারণ নেই। পৃথিবীতে তথ্যপ্রযুক্তির একটা বিশাল ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, সেখানে অসংখ্য মানুষের প্রয়োজন। কাজেই যদি একটা ভালো চাকরিই প্রয়োজন, নিজের উদ্যোগে নিজেকে গড়ে তুলে তুমি যে কোনো পর্যায়ে অংশ নিতে পারবে!
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সব বক্তব্য আত্মরক্ষামূলক। সহজ সত্যটি হচ্ছে, সত্যিকারের বাস্তব কিছু কারণে আমরা এখনও আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে ঢুকতে পারিনি। তবে আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় সারা পৃথিবীর শ’খানেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে আমাদের দেশের কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় নিয়মিতভাবে ঢুকে যাচ্ছে এবং মাঝে মাঝেই অনেক সুপারস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর স্থান করে নিয়ে এদেশের মান-সম্মান রক্ষা করছে!
আমি এই উদাহরণটি নিয়ে কথা বলছি তার কারণ যেহেতু আন্তর্জাতিক মানের প্রোগ্রামিং নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে, অনেকেই ভাবতে পারেন এখানে নিশ্চয়ই শুধু কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের হার্ডকোর প্রোগ্রামাররা অংশ নিচ্ছে। সেটি কিন্তু সত্যি নয়, একেবারে বিশ্বমানের শ্রেষ্ঠ প্রোগ্রামার হিসেবে যারা কোনোভাবে এদেশের সম্মানটি বাঁচিয়ে রাখছে তাদের ভেতরেও নানা বিভাগের ছাত্রছাত্রী আছে!
কাজেই আমি এদেশের ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে বলতে চাই, তুমি যদি পরিশ্রম করতে রাজি থাক (এবং ফেসবুকে লাইক দেয়া এবং লাইক পাওয়ার প্রলোভন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পার), তাহলে এ পুরো পৃথিবী তোমার জন্য উন্মুক্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহকর্মীরা আজকাল নতুন একটা বিষয় নিয়ে মনোকষ্ট পেতে শুরু করেছেন। তারা মাঝে মাঝেই দুঃখ করে বলেন, ছেলেমেয়েরা যদি নিজের পছন্দের বিভাগে ভর্তি হতে না পারে তাহলে তারা পড়াশোনা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। হয়তো এ ব্যাপারে আমাদের নিজেদেরও দোষ আছে, আমরা তাদের লেখাপড়ায় আগ্রহী করে তোলার মতো সুন্দর করে পড়াতে পারি না। আমাদের সহকর্মীদের দুঃখ অন্য জায়গায়, তারা বলেন আজকাল ছেলেমেয়েরা ক্লাশে বসে বসেও দিনরাত বিসিএস গাইড পড়তে থাকে (কিংবা মুখস্থ করতে থাকে)। নতুন প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিচিত্র একটা মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে, যাদের জ্ঞান ও ধ্যান হচ্ছে বিসিএস ক্যাডার হওয়া। বিষয়টি রহস্যময় এবং বিপজ্জনক।
বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বড় একটি শব্দ, এ শব্দের মাঝে পুরো বিশ্বব্যাপারটি রয়েছে (এর ইংরেজি শব্দ ইউনিভার্সিটিটি আরও বড়। সেখানে পুরো ইউনিভার্স বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড রয়ে গেছে)। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কিংবা ছাত্রী হয়ে কেউ যদি দিন-রাত বসে বসে বিসিএস গাইড মুখস্থ করে সেটা গীতবিতানের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে সেটাতে ঝালমুড়ি খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়।
এগুলো অনেক বড় সমস্যা। নিজ থেকে এ সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যাটাকে স্বীকার করে নিয়ে এর সমাধান খুঁজতে হবে। কেউ কি এটাকে সমস্যা বিবেচনা করে এর সমাধান খুঁজে বের করবেন?
৩.
‘নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ’ প্রতিযোগিতার বিজয়ী টিমটিকে আমেরিকায় নাসার একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। টিমের কোচ আমার সাবেক ছাত্র বর্তমান সহকর্মী যখন বেশ আনন্দের সঙ্গে আমাকে খবরটা দিতে এসেছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘তোমরা আমেরিকার ভিসা পাবে না এবং যেতে পারবে না।’ আমার এরকম চরম হতাশার ভবিষ্যদ্বাণী শুনে সে অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইল। আমি তখন তাকে বলেছিলাম, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমার ব্যক্তিগত বন্ধু না হলেও ওই দেশের মানসিকতা আমি জানি। যদি এ মুহূর্ত থেকে রাষ্ট্রের সম্ভাব্য সবচেয়ে উঁচুমহলের সহযোগিতা নিয়ে প্রক্রিয়াটা শুরু না করো, তোমাদের ভিসা দেয়া হবে না।
তারা চেষ্টা করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত ভিসা পায়নি এবং যেতে পারেনি। আমার ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গেছে বলে আমি বিন্দুমাত্র আনন্দ পাইনি। আমাদের ছাত্রদের এ টিমটি যেতে না পারলেও তাদের কারণে অন্য যেসব কর্মকর্তা আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, তারা মহা ধুমধামে আমেরিকা বেড়িয়ে এসেছেন। তারা লজ্জা পেয়েছেন কিনা জানি না; কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমের একজন প্রযুক্তি বিশ্লেষক যখন আমাদের ছাত্রদের বিশাল অর্জনের ভূয়সী প্রশংসা করে তাদের ফেলে রেখে সরকারি কর্মকর্তাদের আমেরিকা ভ্রমণের বিচিত্র ঘটনাটি সবিস্তারে সারা পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে দিল তখন লজ্জায় আমার মাথা কাটা গিয়েছে।
যাই হোক, আমি স্বপ্ন দেখি আমাদের দেশের মানুষ একদিন শুধু বিদেশে থাকার জন্য সাহারা মরুভূমি পাড়ি দিতে গিয়ে মারা যাবে না, শরণার্থী হওয়ার জন্য জাহাজডুবিতে জীবন হারাবে না, বেআইনিভাবে ভিনদেশে ঢুকতে গিয়ে গ্রেফতার হবে না, খেলোয়াড় হিসেবে কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে বিদেশে গিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে না। আমরা আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকব, নিজের দেশ নিয়ে আমার অহংকার থাকবে।
একটি দেশের আমন্ত্রণে সেই দেশে যাওয়ার সময় ভিসা পাওয়া যাবে কী যাবে না সেটি আর কখনও আমাদের মাথা ব্যথার কারণ হবে না।
আপাতত ঠিক করেছি আমার ছাত্রদের এ টিমকে অনুপ্রাণিত করার জন্য সামনের বইমেলায় তাদের একটা বই উৎসর্গ করব!
আমি আর কী-ই বা করতে পারি!
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : লেখক ও অধ্যাপক