এহসানুল ইয়াসিন, জন্ম : ২০ জানুয়ারি, ১৯৮২, ব্রাহ্মণবাড়িয়া । প্রকাশিত গ্রন্থ : কবিতা : রাধিকা নগরীর দিকে হেঁটে যাচ্ছি, উত্তরাধিকারের হলফনামা, অহঙ্কারের গোপন চিঠি। গল্পগ্রন্থ : ফেরাও অথবা ভেঙে ফেলো
আমি অসহায়ের মতো অপেক্ষা করি। অবশ্য অপেক্ষা বললে ভুল হবে। বলা যায় সময়ের কাছে আত্মসমর্পণ করি। তারপরও এ অবস্থা থেকে উত্তরণে চেষ্টার শেষ নেই। কিন্তু কবে? এদিকে অজয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধৈর্যহারা। আমার খুব রাগ হয়। এমন অসময়ে ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে কী চলবে? কিন্তু তাকে এ কথা কে বোঝাবে? আমার প্রায়ই ইচ্ছে করে অজয়কে খুব করে বকে দেই। পারি না। কারণ ওর সবকিছু বাবার অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে। ছেলেটার বয়স আর এমন কী? অথচ এ বয়সেই তাকে লড়তে হচ্ছে।
আজকাল আমার প্রায়ই মনে হয়- অজয়ের মতো অবস্থা হলে আমি কী করতাম? কোনো কূল কিনারা পাই না। চোখের সামনে বিস্তীর্ণ খোলা মাঠের মতো জনমানবহীন একটা ভূমির অস্তিত্ব অনুভব করি। হয়তো আমার নিয়তি ওর মতোই হতো। অজয়ের মুখের দিকে তাকানো যায় না। সেই সকালে বাসা থেকে বের হয় আর ফিরে গভীর রাতে। প্রায় দিনই আমার এখানে এসে বসে থাকে। চোখে-মুখে ধুলোর মতো হতাশা লেগে থাকে। কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করলে আগ বাড়িয়ে কিছু বলবে না। আমি ওর দুরন্ত কৈশোরকে মনে করতে পারি। তখন ও কোন ক্লাসে পড়তো এখন আর মনে নেই। বাসা কিংবা রাস্তায় দেখা হলে গালভরা হাসিতে মুহূর্তটাকে অনেক বেশি আনন্দঘন করে তুলতো। আমি লাবনিকে প্রায়ই বলতাম- অজয় এত দম পায় কোথায়? লাবনি আমার এ কথায় হাসতো।
আজও সারাদিন কোথায় কোথায় যেন ঘুরে আমার কাছে এসেছে। আমি তখন ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় নোট নিচ্ছি। সে নিঃশব্দে রুমে প্রবেশ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আমি দেখেও না দেখার ভান করে বইয়ের পাতায় চোখ আটকে রাখলাম। আজ অজয়কে শুধু ক্লান্ত কিংবা হতাশ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সমস্ত শহরের ইটপাথরের নির্মমতায় এক টুকরো ভাঙা কংক্রিট। আমি কাজ শেষ করে ডাকলাম। – জমি বিক্রির সাইনবোর্ডটার কী করছো? – এখনো কিছু করতে পারিনি। – কেন? – ওরা বোধহয় জমিটা বিক্রি করতে দেবে না। আজ গিয়েছিলাম। কি যে বিচ্ছিরি কথাবার্তা বললো। – তুমি কিছু বলোনি? – বলার সুযোগ দিলো কোথায়? আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। এটা কি মগের মুল্লুক? যা ইচ্ছে তাই করবে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। – চলো থানায় যাবো। – দাদা থানায় গিয়ে কোনো লাভ হবে কী? থানা-পুলিশ তো ওদের হাতের মুঠোয়। তার ওপর সরকারি দলের লোক। আপনি একবার কথা বলে দেখুন না। লাখ পাঁচেক টাকা দিলেও জমিটা ওদের দিয়ে দেবো। বাবার অবস্থা খুব ভালো না। – জমিটার বাজার মূল্য সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে? কম করে হলেও ১৫ লাখ হবে। – দাদা, দামের কথা ভাবার সময় নেই। আমার ভয় হচ্ছে। পারলে কিছু একটা করেন। আমার আর কিছু করা হয়ে ওঠে না। প্রতিদিন কলেজে যাই আর ফেরার পথে হাসপাতালে। কোনো কোনো দিন এলোপাতাড়ি ঘোরাঘুরি করি। কারণ এ শহর আমার পূর্ব পরিচিত হলেও আমি অনেকটা অতিথির মতো। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত হলে আমার দৌঁড় বড়জোড় বাদশা। কিন্তু বাদশা পর্যন্ত যাওয়ার মানসিক পরিস্থিতিতে আমি নেই। সুলতানার সঙ্গে ব্যক্তিগত ঝামেলাটা চুকিয়ে নেয়ার পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রতিরাতেই ফোনে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। এদিকে লাবনির পরিবারের বিষয়টাও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দেড় দু’বছরের পরিচয়ে ওদের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছি যে এমন দুর্দিনে এড়িয়ে যাওয়াটা অন্যায়। তাই একদিন দুপুরে কলেজের ক্লাস শেষে বাদশার খোঁজে মদিনগর যাই। আমাকে দেখে ওর মা ভীষণ খুশি হয়। বাড়িঘর অনেক বদলে গেছে। আমার আসার খবরে বাড়িতে প্রায় সরগরম পড়ে যায়। বাদশার মা ভেতর বাড়ি থেকে বাদশার বউকে ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমি জানতাম না ও বিয়ে করেছে। বাদশাদের বাসা থেকে ফিরার পথে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কারণ বাদশার কোনো খবর ওরা দিতে পারেনি। প্রায় দু’মাস হলো সে নিখোঁজ। পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার আর পরনের কাপড় পাল্টাতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ কেন জানি পুরনো দিনগুলো মনের ভেতর দোল খাচ্ছে। ভাবছি- মানুষ কী চরম সংকটে পড়লে অতীত হাতড়ে সান্ত্বনা নিতে চায়? মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়লো। মা থাকলে সাহস দিতেন। আজ যখন বাদশাদের বাড়ি থেকে ফিরছি তখন খুব ক্লান্ত লাগছিল। তারপরও আমি হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরেছি। মদিনগর ছেড়ে আসার পর এ সময়টাকে খুব মিস করেছি। আমি তখন বাদশাদের বাড়ির হাউজ টিউটর। ওর ছোট দুই ভাইকে পড়ানোর বিনিময়ে আমার থাকা-খাওয়া। বাদশারা বেশ অবস্থাসম্পন্ন পরিবার। কিন্তু বাদশার কর্মকাণ্ড তার বাবাকে দীনহীন মানুষের চেয়েও অসহায় করে তুলেছিল। এ নিয়ে ওর বাবার আফসোসের শেষ ছিল না। তিনি প্রায়ই বলতেন- মাস্টার, জীবনে একটা সাপও মারি নাই। আর আমার ছেলে নাকি মানুষ মারে! কী পাপ যে জীবনে করেছিলাম। আল্লাহ জানে। আমি তাকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করতাম। তার এককথা- সবই বুঝি মাস্টার। সব আমার কপাল! বাদশাদের বাড়ি থেকে কলেজের দূরত্ব তিন কি সাড়ে তিন কিলোমিটার। রিকশায় ত্রিশ টাকার মতো ভাড়া। কিন্তু আমার কোনোদিন রিকশায় চড়া হয়নি। বাড়ি থেকে টাকা আনবো দূরের কথা উল্টো পাঠানোর চিন্তা করতে হতো। ওর বাবা বোধহয় আমার পারিবারিক অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিল। তাই মাঝে-মধ্যে তিনি হাত খরচের টাকা দিতেন। শুধু তাই নয়, দুটো টিউশনির ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। আমি থাকা অবস্থায় একদিন ভদ্রলোক স্ট্রোক করে মারা যান। তার মৃত্যুর পর বাদশা পাগলের মতো হয়ে পড়েছিল। অনিয়মিত বাড়ি আসা নিয়মিত হলো। বাবার ব্যবসাপাতি বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। কেন পারেনি জিজ্ঞেস করলে বলতো- স্যার, কে চায় দুধের গরু বিক্রি করে হালের বলদ কিনতে? আপনি শিক্ষিত মানুষ। আমার চেয়ে ভালো বোঝেন। আমি যে বুঝতাম না এমন নয়। তারপরও ওর কাছ থেকে জানার ভীষণ আগ্রহ ছিল। তাই সময় সুযোগ পেলেই বাদশার সঙ্গে নানা কথার ফাঁকে ওর অন্ধকার জীবনের কথা জানতে চাইতাম। আমার মনে আছে বাদশাদের বাড়িতে যাওয়ার দিন দু’একের মধ্যে আমি একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম। সাংঘাতিক ছিল সেই অভিজ্ঞতা। আমি আজও যখন রাস্তা-ঘাটে পুলিশ দেখি সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে। রাত বারোটা কি সাড়ে বারোটা হবে। আমি ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় কে যেন দরজায় নক করলো। দরজা খুলে দেখি পুলিশ। ভয় পেয়ে গেলাম। – কী নাম আপনার? – আনোয়ার। – বাদশা আছে? – না। – আমরা ঘরটা সার্চ করতে চাই। আমি ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দিলাম। কিন্তু বাদশাকে না পেয়ে আমাকে কড়া ভাষায় শাসিয়ে গেল। পুলিশ চলে যাওয়ার পর অনেকটা ঘাবড়ে গেলাম। জীবনের এই প্রথম পুলিশের জেরার মুখে পড়লাম। সেদিন সারারাত একটুও ঘুমাতে পারিনি। একটা অজানা আতঙ্ক তাড়া করেছিল। বাদশার সঙ্গে শুরুর দিনগুলো ভয় আর আতঙ্কের ছিল। তারপরও বাদশাকে নিয়ে আমার আগ্রহের কমতি ছিল না। আমার কেন জানি মনে হতো- ক্রিমিনালরা মানবিক মনের হয়। আমি যে রুমে থাকতাম তার পাশের রুমে সে ঘুমাতো। তবে খুব নিয়মিত নয়। দেখা যেত মাসে দু’তিন রাতও আসতো না। আবার যখন আসে তা অস্বাভাবিক সময়। তখন খুব বিরক্তি ধরে যেত। আজ এ অসময়ের ক্লান্তিতে সবকিছু ছায়াছবির মতো মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। আমার স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে কুমিল্লা শহর। মনে পড়ছে পায়ে হেঁটে পুরো শহর ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য! মদিনগর থেকে বলারামপুর, রংপুর, দৌলতপুর পাড়ি দিয়ে অশোকতলার মোড়ে রনির জন্য অপেক্ষা করতাম। তারপর আমাদের গন্তব্য ছিল ঠাকুরপাড়ার মদিনা মসজিদ। মসজিদের ঐ গলিতে লাবনিদের বাসা। গভীর রাত পর্যন্ত সে বাসায় আমাদের আড্ডা চলতো আর সঙ্গে লাবনির সুরেলা কণ্ঠের গান। আমরা কোনো কোনো দিন চলে আসতাম ধর্মসাগর পাড়ে। একদিন রাত আটটা সাড়ে আটটার দিকে আমি আর লাবনি রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি। এমন সময় কয়েকটি ছেলে এসে আমাকে ঘিরে ধরলো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই লাবনি এগিয়ে যায়- ওকে কিছু বলার দরকার নেই। কিছু বলার থাকলে আমাকে বলো। একটা ছেলেকে দেখলাম উত্তেজিত গলায় বলছে- ওর সঙ্গে এত মাখামাখি কেন? ওকে এখানে আসতে মানা করো। নইলে কিন্তু দেখে নেবো। লাবনি শুধু বললো- এ নিয়ে পরে কথা বলবো। তোমরা যাও। সেদিন লাবনি আমার সঙ্গে বের হয়নি। বললো- আজ থাক। অন্যদিন যাবো। চল বাসায় ফিরে যাই। আমি লাবনির বাসায় না গিয়ে মদিনগর চলে আসি। বাসায় ফিরে ঘটনাটা কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। মনের ভেতর এক ধরনের গ্লানিবোধ অনুভব করলাম। পড়ায় মন বসেনি। ছাত্রদের বলে দিলাম আজ পড়াতে পারবো না। আমার মন ভীষণ খারাপ। সে রাতেই বাদশাকে কথায় কথায় অপমানের কথা জানালাম। বাদশা শুধু বললো- ঠিক আছে স্যার। আপনি চিন্তা করবেন না। পরদিন কলেজে লাবনির সঙ্গে দেখা হতেই বললো – এতদূর যাওয়া ঠিক হয়নি। – ঠিক বুঝলাম না। – গতরাতের ব্যাপারটার কথা বলছি। – কেন, কী হয়েছে? – সকালে ছেলেগুলো বাসায় এসে ক্ষমা চেয়েছে। তুই কী কাউকে কিছু বলেছিস? আমি বাদশার কথা জানালাম। সে শুনে অবাক হয়। এটা কী করে সম্ভব? – আমি ওদের বাসার হাউজ টিউটর। তারপর থেকে বাদশা আমার ভরসার নাম। কোনো সমস্যা হলে আমি ওর শরণাপন্ন হতাম। একবার লাবনিদের একটা পারিবারিক কাজে আমি বাদশার সাহায্য নিয়েছি। আলেখারচরে লাবনিদের অল্প একটু জায়গা ছিল। একটা ডেভলপার কোম্পানি জায়গাটা দখলে নিয়ে নেয়। লাবনির বাবা নিবারণ চক্রবর্তী বহু জায়গায় ধরণা দেবার পর কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না। কিন্তু তিনি শেষ সম্বলটুকু হাতছাড়া করতে রাজি না। আমি একদিন বাসায় গেলে তার দুঃখের কথা জানালেন। বললাম- আপনি স্থানীয় লিডারদের কাছে যান। ওরা চাইলে কিছু করতে পারবে। তিনি জানালেন ওদের কাছে গিয়েছিলেন। লাভ হয়নি। উল্টো পরামর্শ দিয়েছেন এই বলে- দেখুন মশাই, আমরা বড়জোর ওদেরকে বলে দিতে পারি- যাতে আপনাকে ন্যায্য পাওনাটা বুঝিয়ে দেয়। এর বেশি কিছু সম্ভব না। আমি নিবারণ জ্যাঠাকে বাদশার কাছে নিয়ে গেলাম। সে সব শুনে বললো- স্যার, ঝামেলায় ফেলে দিলেন। ঝামেলার কথা শুনে কাজটা বাদ দিতে বলি। জ্যাঠাও বললো- বাবা তোমার সমস্যা হলে থাক। ভগবানের উপর ছেড়ে দিলাম। কিন্তু না, ভগবানের উপর ছাড়তে হয়নি। বাদশা কাজটা করে দিয়েছিল। একটা কাকপক্ষীও আর কোনোদিন এদিকে মুখ ফেরায়নি। আজ নিবারণ জ্যাঠা অসুস্থ। বাদশা পলাতক। আর লাবনি বিয়ে করে কলকাতায়। পিতার অসুস্থতায় অজয় অসহায়ের মতো আমার কাছে এসে বসে থাকে। জমিটা বিক্রি করতে পারলে বাবার চিকিৎসা হবে। কিন্তু অজয়কে কে বোঝাবে আমার মতো একজন কলেজ মাস্টারের কী এমন ক্ষমতা আছে? তারপরও সে আসে, অস্থিরতা দেখায়। আমি কেবল এসব দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারি না।
০২. নিবারণ চক্রবর্তী চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া গেলেন। তার সঙ্গে গেল অজয়ের মা। অজয় বাড়িঘর দেখার জন্য দেশে থেকে যায়। তবে জমি বিক্রির টাকায় নয়। আমি কোনোভাবে কিছু করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আমার একাউন্টে জমানো ১ লাখ টাকা তুলে দিলাম। প্রথমে সে নিতে রাজি হয়নি। তাকে অনেক করে বুঝিয়ে বললাম যে, এ মুহূর্তে জমি বিক্রি করা সম্ভব হবে না। আগে চিকিৎসা করাও, তারপর দেখা যাবে। নিবারণ চক্রবর্তী দেশের বাইরে যাওয়ার পর একটা মারাত্মক বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটে গেল। তার জমিটা দখল হয়ে যায়। তবে পুরনো দখলদার নয়। রাজনীতি নির্ভর সন্ত্রাসীরা জমিতে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে। অজয় একদিন রাতের বেলা এসে আমাকে এ খবর জানায়। ছেলেটার কী কান্না! – তুমি সাইনবোর্ডটা ফেলে দিতে পারলে না? সে কোনো উত্তর দেয় না। আমি বেশ রাগারাগি করলে বলে – দাদা, মালোয়ান হওয়াটা কি অপরাধ? এ দেশ কি আমার না? আমি এসব দেখে-শুনে দিশেহারা। আমার কলেজের ক্লাস কিংবা ব্যক্তিগত কাজে বেশ ভাটা পড়ে। একদিন কলেজ থেকে বাসায় ফিরে বারান্দায় বসে আছি। এমন সময় আমার মোবাইলে অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে টেক্সট আসে। ‘আপনার কাজ ছাত্র পড়ানো। অন্য বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান কেন?’ আমার আর বোঝার বাকি থাকে না। কারা এসব করছে এবং কেন করছে। আমি পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে আছি। দক্ষিণের খোলা বাতাস শরীরে অনুভব করলেও মনের ভেতর তোলপাড় করছে লাবনি। ও একদিন আমাকে বলেছিল – দেখিস, এমন সময় আসবে কেউ আমাদের হয়ে কথা বলবে না। আমি জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু আজ লাবনি থাকলে নিশ্চিত লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠতো। ভাবছি- লাবনিরা কি খুব বেশি একা হয়ে গেল? নাকি আমরা দুর্বল হয়ে পড়ছি? দুটো অবস্থানকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু খুব বেশি দূর এগুতে পারি না। নিজের ভেতর এক ধরনের ভয় আর অপরাধবোধ কাজ করে। স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় প্রেমপ্রত্যাখাত কিশোরীর অভিমানের মতো হতাশা আমার চারপাশ ঘিরে ধরে। অথচ আমি জানি- এখন এতসব ভাবার সময় না। তারপরও মন থেকে পাথরের মতো চেপে বসা দুঃখটা সরাতে পারছি না। কেবল ঘুরে ফিরে নিজেকে প্রশ্ন করি- আমরা কোথায় যাচ্ছি? কোথায় আমাদের গন্তব্য? আমি বারান্দা থেকে উঠে ঘরের ভেতর গেলাম। ঘরকে মনে হলো একটা জেলখানা। দক্ষিণের বাতাসকে মনে হলো দোজখের তাপ নিয়ে এসেছে। আমার কোনো কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করছে না। অসহিষ্ণু রাজনীতিকের মতো সবকিছু গোলমেলে ঠেকে। এমন অস্থিরতায় বাসার বাইরে বের হওয়ার কথা ভাবলাম। মনে হচ্ছিলো কোথাও ঘুরে আসতে পারলে ভালো লাগবে। আমি কাপড়টা চেঞ্জ করে স্টেশনের দিকে রওনা হলাম। রিকশায় চড়তে ইচ্ছে হলো না। দৌলতপুর টিএন্ডটির সামনে থেকে হাঁটতে হাঁটতে ধর্মপুর চৌমুহনীতে থামি। আমি যখন ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়তাম তখন এখানে একটা ছাত্রাবাস ছিল। এখন হাইরাইজ বিল্ডিং মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একবার ভাবলাম এই রাস্তা ধরে খেতাসার চলে যাই। ওখানে গেলে নিশ্চয় মামুনকে পাওয়া যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। আমি মোড়ের ডানপাশ দিয়ে রেলস্টেশনের দিকে হাঁটা দিলাম। মনে পড়ছে প্রায় দশ বছর আগে একদিন এই স্টেশনে লোকাল ট্রেনে চড়ে নেমেছিলাম। তার ঠিক দেড় বছরের মাথায় ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় চলে যাই। সে দিনটার কথা আমি কোনোদিন ভুলব না। মদিনগর থেকে ব্যাগপত্র গুছিয়ে স্টেশনে আসলাম। বাদশাও আমার সঙ্গে এসেছিল। স্টেশনে এসে দেখি লাবনি, লাবনির বাবা আর অজয় দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা যখন ঢাকার উদ্দেশে চলতে শুরু করলো আমি হু হু করে কেঁদে উঠেছিলাম। আমার সিটের পাশে বসা ভদ্রলোকটি অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেছিল- তুমি কাঁদছো কেন? জবাব দিতে পারিনি। তারপর সবকিছু কেমন জানি বদলে গেল। আমি লড়াই করতে করতে আজ এখানে দাঁড়িয়ে। কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি কুমিল্লায় ফেরা হবে। কিন্তু আমি তো এমন নিষ্ঠুর পরিণতি দেখার জন্য এখানে আসিনি। আমি অনেকটা নস্টালজিয়া আক্রান্ত হয়ে অনেক তদবির করে এখানে পোস্টিং নিয়েছি। এখন এই শহর আমার কাছে যন্ত্রণার সমার্থক। এসব ভাবতে ভাবতে স্টেশনে যাওয়ার কথা ভুলে গেলাম। যখন মনে হলো- দেখি অশোকতলার মোড়ে এসে গেছি। এখানে দাঁড়িয়ে বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। কত স্মৃতি এই রাস্তা ঘিরে। শূন্যপকেটে বন্ধুদের সঙ্গে মাইলের পর মাইল হাঁটা। ধর্মপুর, অশোকতলা, চৌধুরীপাড়া, ঝাউতলা, শালবন বিহার কিংবা ঠাকুরপাড়া। কোথায় পায়ের ছাপ পড়েনি? একদিন এই হাঁটা নিয়ে গল্প করতে করতে আবিষ্কার করেছিলাম আমরা এই শহরের পাহারাদার। এ মুহূর্তে আমার আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। খুব ক্লান্তবোধ করছি। একবার ভাবলাম, একটা রিকশা করে বাসায় ফিরে যাই। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো- বাসায় ফিরে কি করবো? তারচেয়ে অনেক ভালো অজানা অচেনা পথে নিরুদ্দেশ ঘুরে বেড়ানো। আমি অশোকতলা মোড় থেকে বা দিকে টার্ন নিয়ে চৌধুরীপাড়া কবরস্থানের দিকে হাঁটা দিতেই কেউ একজন আমার ধরে ডাক ধরে দেয়। তার গলার স্বর পরিচিত মনে হলেও চেহারা দেখে ঠিক চিনতে পারছিলাম না। সে যখন নিজের পরিচয় দেয় আমি বিস্ময় আর লজ্জায় একাকার হয়ে পড়ি। বিস্ময় তার শারীরিক পরিবর্তন দেখে আর লজ্জিত চিনতে না পেরে। অথচ এ শহরে ফিরে আমি প্রথমে দু’জন মানুষের খোঁজ করি। একজন মামুন আর অন্যজন এই মাত্র দেখা হওয়া রনি। রনিকে পেয়ে মনে হলো কষ্টে আয় করা টাকা খোয়া যাওয়ার পর ফিরে পেলে যেমন আনন্দ হয় ঠিক তেমনি। – মামুনের কথা মনে আছে? – মনে থাকবে না মানে? ও এখন কী করে? – কান্দিরপাড়ে একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছে। – ওর পারিবারিক ঝামেলাটা মিটেছে? – তোর তো দেখছি সে কথাও মনে আছে। চল ওর ওখানে যাই। তোকে দেখলে চমকে উঠবে। আমার শত ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও না করলাম না। এমন দিনের উত্তেজনা নিয়েই আমি এ শহরে প্রত্যাবর্তন করেছি। যদিও আমার মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে নিবারণ জ্যাঠা, অজয় আর লাবনি। কিন্তু কান্দিরপাড় গিয়ে অনেকটা হতাশ হতে হলো। মামুনের কর্মচারি জানালো- সে তিনদিনের চিল্লায় চলে গেছে। আমি প্রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ভাবছি- জীবন বোধহয় এমনই। আমার মনে পড়ে গেল সেই দিনগুলোর কথা। মামুনের বাড়ি থেকে মদিনগর ১০ মিনিটের রাস্তা। প্রায় রাতেই ও আমার এখানে চলে আসতো। আমরা দুজন রাতভর রাস্তায় হাঁটতাম আর গল্প করতাম। মামুন টুকটাক গান বাজনা করতো। একদিন খবর পেলাম মামুন স্মৃতিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। কি যে কাণ্ডটাই না ঘটেছিল। থানাপুলিশ আরো কত কী? সে মামুন এখন! মামুনকে না পেয়ে রনিও হতাশ। রাত তখন প্রায় দশটা ছুঁইছুঁই। সে আমাকে রাতে খাওয়ার প্রস্তাব করলো। আমি রাজি হলাম না। বললাম অন্য একদিন। আজ বাসায় যেতে হবে। কিন্তু সে আমাকে কিছুতেই ছাড়বে না। নিজে যেচেপড়ে আমার বাসায় আসতে চাইলো। শেষে দুজন বাসায় ফিরি। ০৩. বাসায় ফিরে আমার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি রনির পরিবর্তন। একবারও লাবনির কথা জিজ্ঞেস করলো না। এমন তো হওয়ার কথা না। রনি কী ভুলে গেছে? তাদের ব্যাপারটা আমিও জানতাম। নাকি ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাচ্ছে? কোনো কিছু অনুমান করতে পারলাম না। আমার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। বাসায় রান্না হয়নি। কারণ আমাকে বাসায় না পেয়ে বুয়া ফিরে গেছে। হোটেলের খাবার জঘন্য মনে হলো। তারপরও চোখ বুঝে খেয়ে নিলাম। রনি আমাকে সিগারেট অফার করলো। – না, খাই না। – কী বলিস, কতদিন ধরে? – বছর পাঁচেক হবে। – খুব ভালো করেছিস। হোটেলে বেশিক্ষণ বসলাম না। অন্য সময় হলে নির্ঘাত ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে কাটিয়ে দিতাম। বাসায় ফিরে মনটা উসখুস করছে। আমার বারবার জানতে ইচ্ছে করছে রনি ও লাবনি সম্পর্কে। কিন্তু রনিকে দেখছি এ ব্যাপারে নির্বিকার। তাই নিজেই আগ বাড়িয়ে প্রসঙ্গটা তুললাম। – লাবনির সাথে যোগাযোগ আছে? – ওসব বাদ দে। তোর কথা বল? – তুই কি এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিস? – না, কিন্তু এ কথা বলে লাভ কী? কেবল যন্ত্রণা বাড়বে। – ওকে ফেরালি না কেন? – তুই তো ফেরাতে পারতি? তুই ফেরালি না কেন? আমি হা করে রনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। রনিও নিশ্চুপ। – কিরে বললি না যে? – কী বলবো? – ঐ যে ফেরানোর কথা বললাম। – দেখ্ চাইলে ফেরাতে পারতাম। তাছাড়া – তাছাড়া কী? – তুই তো সবই জানিস। – না, আমি কিচ্ছু জানি না। – ওর মা আমার হাত ধরে অনুরোধ করেছিল আমি যেন এই সর্বনাশটা না করি। এমনিতে দিন দিন ওরা দুর্বল হয়ে পড়ছে। তার উপর এমন ঘটনা ঘটলে আত্মহত্যা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। আমার মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। মাসীমা আমাকেও একই কথা বলেছিল। তবে তার সঙ্গে আলাপের পর মনে হয়েছে- এখানে সে নিরাপত্তার অভাব বোধ করে। যদি সত্যিই একদিন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তাহলে অন্তত যাওয়ার একটা জায়গা তৈরি হবে। – ওদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে? – না। – কেন? – আমি সহ্য করতে পারবো না। – বিয়ে করিসনি? – না। – করবি না? – না। রনির এ রকম হ্যাঁ না মার্কা উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারছি না। – আমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি না জানতে ইচ্ছে করছে না? – আমার ইচ্ছে অনিচ্ছায় এখন কারো কিছু আসে যায় না। আমি এ বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না। ঘুমবো, তুইও ঘুমা। অনেক ঘুরাঘুরি হয়েছে। রনি কাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আমিও ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম আসছে না। বারবার লাবনির মুখটা মনে পড়লো। ওর বিয়ের আগে জ্যাঠা আমাকে ফোন করে অনুরোধ করে ছিল- আমি যেন লাবনিকে বিয়ের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। লাবনি এ বিয়েতে রাজি না। অন্যদিকে লাবনি আমাকে ধরলো রনির সঙ্গে কথা বলতে। কারণ রনি সাফ জানিয়ে দিয়েছে- বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব না। আমি কথা বলতে গিয়েছিলাম। কিন্তু রনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি। এ খবরটা লাবনিকে যখন জানালাম তখন আমাকে জড়িয়ে সেকি কান্না! আমি পারবো না। এই জন্মস্থান আর স্বজনদের ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না। কিছু একটা কর। ০৪ রনির সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমার একাকিত্ব অনেকটা কমেছে। কিন্তু মাথা থেকে লাবনিদের বিষয়টা কিছুতেই সরছে না। ভাবি সত্যি কী এমন দিন এসে গেছে? নইলে অসহায়ের মতো এমন আত্মসমর্পণ করতে হবে কেন? আমি ওদের কম্যুনিটির লোকদের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরাও সাহস পায় না। বললাম আপনারা একটা প্রেস কন্ফারেন্স অথবা মানববন্ধন করেন। বাকিটা আমি দেখছি। তারা কোনো সাড়া দেয়নি। কোথায় যেন একটা গোপন ভয় আর আতঙ্ক। যা আমাকেও তাড়া করে বেড়ায়। একবার মনে হয় পিচ্চি কামালের সঙ্গে দেখা করি। ও এখানকার লোকাল ছেলে। যদি কিছু করতে পারে। কিন্তু তার আগে মামুনের সঙ্গে দেখা করা দরকার। ও নিশ্চয় কামালের ঠিকানা জানে। আমি মামুনকে ফোন করতে গিয়ে ব্যর্থ হই। ওর নাম্বার সেভ নেই। গতকাল তাবলীগ থেকে ফিরেই ফোন করেছিল। আমি আর দেরি করিনি। রনিকে ফোন করে জানতে চাইলাম যেতে পারবে কিনা? সে জানালো- সম্ভব না। কারণ পাঁচটা পর্যন্ত স্কুলে থাকতে হবে। শেষে একাই রওনা হলাম। আমার কলেজ থেকে মামুনের রেস্টুরেন্টের দূরত্ব প্রায় ১০ মিনিটের পথ। তারপরও হাঁটতে সাহস পেলাম না। কেন জানি মনের জোর কমে গেছে।
– দোস্ত শেষ পর্যন্ত তোমার দেখা পেলাম। আমি কেবল একটু মুচকি হেসে নিজের আনন্দ প্রকাশ করলাম। আমারও বিস্ময়ের সীমা নেই। মামুনকে এমন দেখবো কখনো ভাবিনি। মুখভর্তি দাড়ি ওর সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। দোকানের একজন কর্মচারিকে ক্যাশবাক্সে বসিয়ে দিলো। আজ আর ব্যবসা নয়। আমার সঙ্গেই গল্প করবে। আমি বললাম- এটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। সে মানতে রাজি নয়। কতদিন পর দেখা। অনেক খবর জানতে চাইলো। কোনটা রেখে কোনটা বলি। মামুনের তাবলীগে যাওয়ার খবরে আমি ভেবেছিলাম ও অনেক বদলে গেছে। কিন্তু না, একটুও বদলায়নি। আগের মতোই আছে। – এখনো কি গান করিস? – সে সময় কি আর আছে? – তোর মনে আছে ঐ ঘটনাটা? – কোনটা? – একবার তবলা হারমোনিয়াম ভেঙে ফেলেছিলি? মামুন হাসলো। বললো- সে দিনগুলো কি ভোলা যায়? রেস্টুরেন্টে লোকজনের ভীড় বাড়ছে। মামুনের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগলেও ওর ব্যস্ততার কথা চিন্তা করে চলে আসতে চাইলাম। কিন্তু সে আমাকে ছাড়বে না। নিজেই আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। – চল ধর্মসাগর পাড়ে বসে গল্প করি। ধর্মসাগর আর আগের মতো নেই। আমরা যখন এখানে দলবেঁধে আসতাম তখন এতলোকের আনাগোনা ছিল না। তবে বখাটেদের উৎপাত ছিল। এখন আছে কিনা জানি না। পার্কের জৌলুস বেড়েছে। আমি, লাবনি, রনি আর মামুন কতদিন এখানে সময় কাটিয়েছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা বেঞ্চে বসি। – লাবনির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে? – খুব কম। মাঝে মধ্যে অজয়ের সঙ্গে দেখা হয়। তুই এখনো ওকে মনে রেখেছিস? – ও কি ভোলার মতো। আচ্ছা, বাদশার কথা মনে আছে? – থাকবে না কেন? তোর সূত্রেই তো আমার সঙ্গে খাতির হয়েছিল। আমি মামুনকে ঘটনার বিস্তারিত বলি। এবং আমাদের কোনো করণীয় থাকলে তা করার অনুরোধ করি। মামুন কেবল খুব জোরে একবার নিঃশ্বাস ফেলে উদাস ভঙিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ০৫. সময় বদলে যায় জানি। কিন্তু এতটা বদলায় জানতাম না। এই কয়েকমাসের ঘটনার পরম্পরা আমাকে অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছে। এখন প্রতিটা পদক্ষেপই আমাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। মানুষের মুখোমুখি হলেই বিশ্বাসের রেখা পড়ার চেষ্টা করি। যদিও বিশ্বাস হারাই না। তবে একটা বিষয় টের পাই যে সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদলাতে পারিনি। এ নিয়ে আমার আফসোস নেই। এত হিসাব নিকাশ করে কী হবে? খুব কি খারাপ আছি? তারপরও আজকাল নানা চিন্তা মাথায় ভর করে। বিশেষ করে লাবনির ব্যাপারে রনির অবস্থান আমাকে ভীষণ ভাবায়। ভালোবাসা বোধহয় এমনই হয়। রনি আমার চিন্তার দরজাটা নতুন করে খুলে দিয়েছে। রনির সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই সুলতানার বিষয়টা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সুলতানাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু তার বিদেশে পড়তে যাওয়াটা আমার ইচ্ছে অনুযায়ী হয়নি। আমাদের বিয়ের পাঁচমাসের মাথায় সুলতানা স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যায়। তারপর থেকে আমার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। সুলতানার ইচ্ছে ওখানে সেটেল্ড হবে। আমি সাফ জানিয়ে দিয়েছি- এই দেশ ছেড়ে কোথাও যাবো না। কুমিল্লায় পোস্টিং নিয়ে আসার আগে আমি ওকে একটা দীর্ঘ ইমেইল করেছিলাম। দু’মাসের সময় দিয়ে লিখেছিলাম- ‘এভাবে আর পারছি না। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। তুমি চাইলে কাগজে কলমে জোড়া লাগানো সম্পর্কটায় ইতি টানতে পারো।’ সুলতানা কোনো উত্তর দেয়নি। কিন্তু গত কয়েকমাসের শিক্ষা আমাকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। এখানে আর ভালো লাগছে না। অহেতুক এত নিস্ফল লড়াই করে কী লাভ? সময় পাল্টেছে, পাল্টেছে মানুষ। আদর্শ বলতে কি কিছু আছে? আমি কোনো কিছুই মেলাতে পারি না। এত নির্লজ্জতা দেখে ভীষণ লজ্জা পাই। আর কারো লজ্জা হয় কিনা জানি না। তবে আমার মনে হয় এ লজ্জার দায় আমার একার! কুমিল্লাতে আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমার মনে হয় কুমিল্লা বদলাচ্ছে না। বদলাচ্ছে পুরো দেশ। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম সুলতানার কাছেই চলে যাবো। কাউকে কিচ্ছু জানাবো না। রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাবো।
আত্মযন্ত্রণা আর হতাশার মধ্যেই পালিয়ে বেড়ানোর প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। প্রত্যাবর্তনে আমি যে আনন্দ অনুভব করেছিলাম তার চেয়ে বহুগুণ বেদনা নিয়ে পুরোনো দিনগুলোকে খোঁজার চেষ্টা করেছি এ ক’টা দিন। আমার সঙ্গী হয়েছিল কখনো মামুন, কখনো রনি। শেষবারের মতো আমি সমস্ত কুমিল্লা চষে বেড়াচ্ছি। কাউকে বুঝতে দেইনি এখান থেকে কী নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু রনি যে আমাকে এত মনোযোগের সঙ্গে খেয়াল করছিল তা বুঝতে পারিনি। একদিন ভরদুপুরে আমার বাসায় রনি এসে হাজির। আমি কিছুটা নিরাসক্ত কণ্ঠেই বললাম – কিরে ক্লাস নেই? – আছে। ইচ্ছে করেই চলে এলাম। – কেন? – লাবনির কথা খুব মনে পড়ছে। ওর বাবা কেমন আছে? – তুই কী করে জানিস? – সব জানি। দূর থেকে জানি। আমি বললাম- আমার খবর নিতে ভয় হয়। লাবনি ফোন করেছিল। ইচ্ছে করে ধরিনি। কী জবাব দেবো? রনি মাথা নিচু করে বসে আছে। আমি কী বলবো জানি না। এমন সময় মামুন ফোন করলো- বাদশা ক্রসফায়ারে নিহত। খবরটা জানি কিনা? আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হলো- পৃথিবীতে আমার মতো এত অসহায় আর কেউ নেই। মনে হয় বাদশা মরেনি, ওর মৃত্যুর সঙ্গে অনেকগুলো স্বপ্নও মরে গেছে। পৃথিবীর কথিত ভদ্রসমাজ হয়তো কোনোদিন এ খবর জানবে না। একবার ইচ্ছে হয়েছিল মদিনগর গিয়ে ওর মার সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু সাহস পাইনি।
বাদশার মৃত্যু আমাকে পাল্টে দেয়। মৃত্যু খবরে আমি ধাক্কা এতটা খেয়েছিলাম যে সামলে ওঠা কষ্ট হয়ে পড়ে। অনেককটা অস্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন যাপন করতে শুরু করি। ফলে কিছুদিনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ি। একদিন বাসায় জ্বরে কাতরাতে কাতরাতে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলাম। রনিই নিয়ে এসেছিল। এ সময়টায় মামুনের স্ত্রীর উপর বেশ ধকল যায়। প্রতিদিন বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে হাসপাতালে খাবার নিয়ে আসতো। রনি তার সব কাজ ফেলে সারাক্ষণ আমার পাশে ছায়ার মতো ছিল। হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়ে বাসায় ফিরলাম। শরীরটা একটু হালকাবোধ করছি। রনিও আমার সঙ্গে এসেছে। কিন্তু বাসায় প্রবেশ করেই জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্যের মুখোমুখি হলাম। অজয় একটা চিরকুট লিখে দরজার ফাঁক দিয়ে রেখে গেছে- ‘দাদা, তুমি আমাদের জন্য যা করলে তার ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমাদের জমি দখলের খবরটা মা জেনে গেছে। তাই সে এক মুহূর্তও আমাকে এদেশে থাকতে দেবে না। সে নাকি প্রায় রাতেই স্বপ্ন দেখে আমি নিরাপত্তাহীনতায় এখানে ওখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। জানি, তোমার সামনে দাঁড়ালে না যাওয়ার মতো হাজারটা দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবে। তাই মুখোমুখি হওয়ার সাহস না পেয়ে চোরের মতো পালিয়ে যাচ্ছি। ভালো থেকো। শরীরের যত্ম নিও। আমি ওখানে গিয়ে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবো।’ চিরকুটটা হাতে নিয়ে আমি স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। রনি কাগজটা আমার হাত থেকে নিয়ে পড়তে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারেনি। হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো। রনির কান্না দেখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। এই প্রথম রনিকে কাঁদতে দেখলাম।
আমার আর কোনো কিছুতেই মন বসছে না। কেবল পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। তাই এ ক’টা দিন ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করি। হাসপাতাল ছাড়ার পর রনি আমার সঙ্গেই থাকে। আমার মতো সেও সবকিছুতে ইরেগুলার। স্কুলে যায়। মনে হয়- যাওয়ার জন্য যাওয়া। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি চাকরিটা ছেড়ে সুলতানার কাছে চলে যাবো। অজয়ের মতো আমিও আজকাল নিরাপত্তার অভাববোধ করি। রনিকে বিষয়টা জানালে শুধু এটুকুই বলে- তোদের সবারই যাওয়ার একটা দেশ আছে। আমি কোথায় যাবো? রনির কথাটা আমি গুরুত্ব না দিয়ে চুপ করে রইলাম। – কখন যাবি? – আজ রাতেই। – এই শরীর নিয়ে যেতে পারবি? – পারবো। শহর ছেড়ে পালানোর আগে মামুনের সঙ্গে একবার দেখা করতে ইচ্ছে হলো। আমি রনিকে নিয়ে মামুনের উদ্দেশ্যে বের হলাম। শহরটাকে আজ কেমন জানি অপরিচিত মনে হচ্ছে। সরু রাস্তায় মানুষের ভীড় আর সমানতালে এগিয়ে চলছে রিকশা। এমন সময় ফোন বেজে ওঠে- সুলতানার ফোন। সে জানালো- আজ রাতের ফ্লাইটে দেশে ফিরছে। আমি যেন ঠিকানাটা টেক্সট করি। এয়াপোর্ট থেকে সোজা আমার এখানে চলে আসবে।
মামুনের আজ বেশ তাড়াহুড়া। আমাদের দেখে খুশি হলেও বিরক্তি প্রকাশ করলো – এ শরীর নিয়ে আসার দরকার ছিল না। ফোন করলেই তো আমি চলে যেতাম। – আমি ইচ্ছে করেই এসেছি। তোর রেস্টুরেন্টে খাবো। – মাথা খারাপ। এ শরীর নিয়ে হোটেলে খাবি। বাসায় চল। স্মৃতিকে ফোন করে বলে দিচ্ছি- আমরা আসছি। আমি জোর করে মামুনের হোটেলে খেয়ে নিলাম। মনটা ভীষণ খারাপ। নগরের কোলাহল কানের কাছে বিরক্তির মতো ঠেকছে। এত মানুষ তারপরও এদের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। মনে হয় প্রত্যেকটা মানুষ ভীতুর ডিম। আমি কিংবা অজয়ের মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মামুনকে যাওয়ার খবরটা দিলাম। কিন্তু একেবারে যে পালিয়ে যাচ্ছি বলিনি। বিকালে বাসায় ফিরে সবকিছু গোছগাছ করে নিলাম। রাত তিনটের দিকে ট্রেন আসবে। মামুন ফোন করে জানালো- সে সব কিছুর ব্যবস্থা করে রাখবে। আমি যেন ঠিক সময়ে রনিকে নিয়ে স্টেশনে চলে আসি। একবার বাড়িওয়ালার খোঁজ করলাম। পেলাম না। বাসায় বড় একটা তালা ঝুলছে। একটা চেক লিখে রনির হাতে দিয়ে বললাম- চেকটা ক্যাশ করে বাড়িওয়ালাকে দিয়ে দিস। রনি বাধ্য ছেলের মতো আমার হাত থেকে চেকটা নিয়ে বুক পকেটে রাখলো। আমি বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি কখন ট্রেনের সময় হবে। অনেক হয়েছে আর না। ট্রেন আসার প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে বাসা থেকে বের হয়ে যাই। রাতের কুমিল্লা যে এত নিথর আগে বুঝিনি। তবে এত নিস্তব্ধতার মধ্যে টের পাচ্ছি এ শহরের দীর্ঘশ্বাস।
আমরা স্টেশনের সামনে একটা রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিলাম। মামুন আসতে পারেনি। ওর দোকানের কর্মচারি এসে টিকেট দিয়ে গেল। রনি নিশ্চুপ হয়ে কেবল আমাকে ফলো করছে। ওয়েটারকে দুটো চা আর দুটো বেনসন সিগারেট আনতে বললাম। – তুই না সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিস। – আজ কেন জানি টানতে ইচ্ছে করছে। হোটেলের চেয়ারগুলো জনমানবশূন্য। দু’একটা রিকশা মাঝে মধ্যে টুংটাং শব্দ করে হোটেলের সামনে থামছে। আমি হোটেলটার চারপাশ খেয়াল করছি। হঠাৎ দেয়ালের একটা পোস্টারের দিকে নজর গেল। সাদাকালো পোস্টার। বড় অক্ষরে লেখা- কাদিয়ানিদের কাফের ঘোষণার দাবিতে বিশাল জনসভা। স্থান : কান্দিরপাড় টাউনহল মাঠ। আমি অনেকটা আতঙ্কিত হয়ে পোস্টারের লেখাগুলো পুনরায় পড়ার চেষ্টা করলাম। দেশে হচ্ছেটা কী? রাষ্ট্র কি ব্যক্তি যে তার ধর্ম আছে? তাহলে রাষ্ট্রকে কেন এ ঘোষণা দিতে হবে? একবার ভাবলাম ওয়েটারকে ডেকে বলি- পোস্টারটা ছিড়ে ফেলো। কিন্তু পারলাম না। রনি তাড়া দিলো ট্রেনের সময় হয়ে গেছে।
আমি ট্রেনের সিটে বসে ছাড়ার অপেক্ষা করছি। রনি জানালার সামনে অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় দেখি কয়েকটা লোক ট্রেনের দিকে এগিয়ে আসছে। ওদের একজনের হাতে পোস্টার। অন্যজনের হাতে বালতির মতো কিছু একটা। সম্ভবত পোস্টার লাগানোর আঠা। ওরা এসে ঠিক আমার জানালার পাশের খালি জায়গাটাতে তড়িঘড়ি করে পোস্টারটা সেটে দিলো। ইতোমধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আমি জানালা দিয়ে মাথা বের করে রনিকে বিদায় জানাচ্ছি। রনিও ট্রেনের ধীর গতির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগুচ্ছে। বললাম- ভালো থাকিস। রনি হু হু করে কেঁদে দিলো। – আমরাও বোধহয় লাবনিদের মতো সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছি। রনির এ কথায় প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। আমি মাথাটা একটু বের করে লক্ষ করলাম হোটেলে টাঙানো সেই পোস্টারটা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পোস্টারটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে করতে চেষ্টা করলাম প্রথমবার ফেরার দৃশ্যটা। পারলাম না। বারবার কেবল লাবনি আর রনির চেহারা ভেসে উঠে। বাদশার চেহেরাটাও মনে করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। মনে হলো পায়ের তলা থেকে আসলেই মাটি সরে যাচ্ছে। আমি হাত বাড়িয়ে পোস্টারটা ছিড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাগাল পেলাম না। আমার চোখের সামনে থেকে রনি আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হতে লাগলো। গাড়ির গতি বাড়ছে। স্টেশনের আলো ছেড়ে গাড়ি অন্ধকারে প্রবেশ করে। রনির শেষ কথাটা কানের কাছে তীরের মতো বিদ্ধ হয়। ভাবছি- রনি কি কাদিয়ানি? কোনো উত্তর পাই না। কেবল মনে হয়- ও আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু!