মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠলেও প্রবাসী শ্রমিকদের মাঝে বিরাজ করছে চরম হতাশা।
বৈধ কাগজপত্র সঙ্গে নেই এমন বিদেশি শ্রমিকদের নির্বিঘ্নে নিজ নিজ দেশে ফিরতে গত জুলাই মাসে ব্যাক ফর গুড প্রোগ্রাম কর্মসূচি শুরু করে দেশটির সরকার। এর আওতায় অবৈধ কর্মীরা ১ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে ফেরার সুযোগ পাবেন। কিন্তু এরই মধ্যে ধরপাকড়ও চলছে।
মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ২৭২ জন বাংলাদেশিকে আটক করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সিলর মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, সাধারণ ক্ষমার সঙ্গে বিদেশি কর্মী আটকের বিষয়টি সম্পৃক্ত নয়। মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ বহির্গমন আইনসহ নানা কারণে সন্দেহভাজন লোকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, সাধারণ ক্ষমার আওতায় দেশে ফিরতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেকেই যোগাযোগ করছেন। ১ আগস্ট থেকে প্রতিদিন গড়ে ২০০ কর্মী হাইকমিশনে আসছেন। মূলত যাদের কাছে পাসপোর্ট, নিয়োগপত্র বা কোনো কাগজপত্র নেই, তারাই শুধু হাইকমিশনে এসে দেশে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ সংগ্রহ করছেন।
তিনি আরও বলেন, ব্যাক ফর গুড প্রেগ্রামের আওতায় যারা দেশে ফিরবেন তাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ কাগজপত্র থাকলে পুলিশ তাদের আটক করবে না বা গ্রেফতার করবে না। যদি কারো কাছে বিফোরজির আওতায় কাগজপত্র না থাকে বা দেখাতে না পারলে সন্দেহ হলে পুলিশ তাকে আটক করবে। দেশে ফিরতে অবৈধ কর্মীদের যাতে আটক না হয় এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত দূতাবাসের আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
সাধারণ ক্ষমার আওতায় স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার সুযোগ দিতে ১৮ জুলাই ৫ মাসের সময় বেঁধে দেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন ইয়াসিন। এজন্য দেশজুড়ে ৮০টি কাউন্টার খোলা হয়েছে। অবৈধ অভিবাসীরা প্রতিদিন ইমিগ্রেশন কাউন্টারে উপস্থিত হয়ে স্পেশাল পাস সংগ্রহ করছেন। প্রত্যেক অভিবাসীকে ৭০০ রিঙ্গিত (১৪ হাজার টাকা) জরিমানা পরিশোধ করতে হচ্ছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে অবৈধ কর্মীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল মালয়েশিয়ার সরকার। ওই সময় বৈধ হতে আবেদন করেন প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। শেষ পর্যন্ত বৈধ হওয়ার সুযোগ পান ২ লাখ ৮০ হাজার ১১০ জন।
এ ছাড়া নাম, বয়স জটিলতা ও দালাল কর্তৃক প্রতারনার শিকারে ২লাখ ৬৯ হাজার ৮৯০ জন বৈধতা পাননি।
অপরদিকে দীর্ঘদিন থেকে মালয়েশিয়া অদক্ষ, আদা-দক্ষ, দক্ষ ও প্রফেশনাল শ্রম আমদানি বন্ধ রয়েছে। যুগ যুগ ধরে আমদানিকৃত এ সকল দক্ষ ও প্রফেশনালদের একটি অংশ দ্বারা গড়ে উঠেছে হাজার হাজার মালয়েশিয়ান পারিবারিক বুনিয়াদ। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ বুনিয়াদের অবদানকে খাটো করে দেখার মতো নয়। বর্তমানে এ বুনিয়াদের জনসংখ্যা প্রায় ৪৮ হাজারেরও অধিক।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রম ব্যবসায়ী ও এক শ্রেণির শ্রমিকদের দ্বারা, বাংলাদেশিয় রাজনৈতিক চর্চার ডামাঢোল বাজলেও, ওই বুনিয়াদের উন্নয়নে, ঐক্য গঠনে ও জাতীয় চেতনা বোধ সৃষ্ঠির লক্ষ্যে, কোনো কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দীর্ঘদিন থেকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক আসতে থাকলেও ১৯৯৩ থেকে মালয়েশিয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে শ্রমিক আমদানি শুরু হয়। বিগত ২০১১ সনে জি-টু-জি চুক্তি হওয়ার পূর্বে আরও ৫টি চুক্তি হয় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানির। কিন্তু প্রতি বারই চুক্তি অনুযায়ী শ্রম আমদানি সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই দুর্নীতির কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে একদিকে যেমন দুর্নীতির দায়ে দুর্নীতিবাজদের বিচার এবং জনগণ, দল ও এনজিও প্রতিষ্ঠানের কাছে কারণ দর্শাতে সরকারকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
অপরদিকে, রফতানি কার্যক্রমে নেতৃত্ব দানকারী গুটি কয়েক রিক্রুটিং এজেন্সি ছাড়া বাকী সকল রিক্রুটিং এজেন্সিগুলিকে ভিসা কেনার জন্য দেয়া শত শত কোটি টাকা প্রতারিত হয়। বিদেশগামী শ্রমিকদের টাকা প্রতারণার দায়ে, লাইসেন্স বাতিলের নোটিশ, আদালতের নোটিশ, অফিসে তালা দিয়ে পালানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয়, প্রতারিত শ্রমিকদের আর্থচিৎকার শ্রম আমদানিকারক এবং রফতানিকারক কোনো কর্তৃপক্ষের অন্তরে কখনও দাগ কাটতে পারেনি।
বিগত কয়েক বছর আগে মালয়েশিয়া তার চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিক আমদানি করতো ১৯টি দেশ থেকে। ন্যূনতম বেতন কাঠামো, অনুন্নত বাসস্থান, পুলিশি হয়রানি, শ্রমিক নির্যাতন ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে বেশ কয়েকটি দেশ, শ্রম রফতানিতে অনাগ্রহ ও সিমিত করে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এ সকল অভিযোগ উপেক্ষা করে তার বন্ধুপ্রতিম দেশ মালয়েশিয়ার শ্রম সমস্যা সমাধানে এবং অবকাঠামো উন্নয়নে ২০২০ ভীষন বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করতে জি-টু-জি চুক্তি সম্পাদন করে।
কিন্তু এ জি-টু-জি, জি-টু-জি প্লাস চুক্তিতে শ্রম রফতানির সর্বক্ষেত্রে সরকারের একক নিয়ন্ত্রণ এবং রিক্রুটিং এজেন্সি ও দেশি-বিদেশি এজেন্টদের দৌড়-ঝাঁপের কারণে সফল হতে পারেনি। ফলে মালয়েশিয়াকে পড়তে হয় আরও এক ধাপ সমস্যার সম্মুখীন।
মালয়েশিয়ার সরকার নিরূপায় হয়ে তার সমস্যার সমাধানে বিকল্প প্রস্তাবে সম্মত হয়। শুরু হয় ডিপি-১০ এবং ডিপি-১১ এর কলিং। তার পরে শুরু হয় জি-টু-জি প্লাস। দুর্নীতির কারণে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। দু’দেশের সম্পর্ক অটুট রাখতে এ সমস্যার সংগত সমাধান এবং সাধারণ শ্রমিক আমদানি সম্পর্কিত অন্যান্য সমস্যা সমূহ দূরীকরণে যৌথ উদ্যোগ গৃহীত হবে, এটাই সকলের আশা।
- জিএস থেকে পদত্যাগ চাওয়ায় ভিপি নুরকে রাব্বানীর হুঁশিয়ারি
- খালেদা জিয়াকে সরকার অন্যায়ভাবে বন্দি করে রেখেছে : ফখরুল
বর্তমানে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি প্রায় ৮ লাখেরও অধিক সাধারণ শ্রমিক রয়েছে। তার মধ্যে প্রায় সাড়ে চার লাখ শ্রমিক বৈধ এবং বাকি সকল শ্রমিকই অবৈধ বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। এ অবৈধ শ্রমিকদের মধ্যে রি-হিয়ারিং বৈধতার প্রোগ্রাম ও ভিসা নবায়নে প্রতারিত বা ব্যার্থ, প্রায় ২৩ হাজার স্টুডেন্ট ভিসা, ট্রেনিং ভিসা ও শিপিং ভিসায় এসে অবৈধ এবং প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার ভিজিট ভিসা ও ট্রানজিটে ডুকে অবৈধ, বাকী প্রায় ৮ হাজার নৌ ও জঙ্গল পথে অবৈধভাবে প্রবেশ করে।
মালয়েশিয়ার সরকার এ পর্যন্ত ৩ বার বিদেশি শ্রমিকদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এই ৩ বারের পরিসংখ্যানেই বাংলাদেশিরা আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি বৈধ হয়েছে এবং আনুপাতিক হারে এজেন্ট ও তাদের সাব এজেন্ট কর্তৃক প্রতারিতও হয়েছে বেশি।