স্বাধীন বাংলাদেশে আমার বড় একটি প্রত্যাশা ছিল, অতিদ্রুত বাংলাদেশের গোটা জনসংখ্যা শিক্ষিত হয়ে উঠবে। এ বিষয়ে আমি বরাবর উদাহরণ দিই লেনিনের রাশিয়া অর্থাৎ সোভিয়েত রাশিয়ার। সদিচ্ছা থাকলে অনেক আপাত অসম্ভব যে সম্ভব করা যায় তার প্রমাণ লেনিনাদর্শে পরিচালিত লেনিনোত্তর রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিপুলসংখ্যক নিরক্ষর, অশিক্ষিত কৃষকসমাজ অধ্যুষিত রাশিয়ার শিক্ষা পরিস্থিতি দেখে অভিভূত হয়েছিলেন ১৯৩০ সালে রাশিয়া সফররত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধু তাদের শিক্ষিত দেখেই নয়, তাদের সংস্কৃতিমনস্কতা দেখেও বিস্মিত হন রবীন্দ্রনাথ। দ্রষ্টব্য তাঁর লেখা ‘রাশিয়ার চিঠি’ বইটি।
এ ক্ষেত্রে শিক্ষার গুণ বর্ণনার প্রয়োজন বোধ করছি না এ কারণে যে শিক্ষিত মাত্রেই জানেন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থানে শিক্ষার গুরুত্ব কতখানি। একটি নীতিনিষ্ঠ সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে ব্যাপকভিত্তিক শিক্ষার হার অর্জন যেমন জরুরি, তেমনি উন্নয়নকে অর্থবহ করে তুলতে শিক্ষার প্রয়োজন অতি গুরুত্বপূর্ণ। জবাবদিহির শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতেও শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
শুধু কী তাই? ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, নাগরিকাধিকার ও মানবাধিকারের মতো মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো সম্পর্কে সচেতনতা এবং সেগুলোর দাবি ও অধিকার অর্জনের বিষয়াদিতে শিক্ষাজীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট। একজন শিক্ষিত মানুষই জানেন তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক মৌলিক অধিকার কী কী এবং কিভাবে তা রক্ষা করা সম্ভব।
তবু একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষার এই তাৎপর্য জানা সত্ত্বেও দেশের মোট জনসংখ্যাকে শিক্ষিত করে তোলার পরিকল্পনা বা কর্মসূচির দিকে প্রয়োজনীয় মাত্রার গুরুত্বে নজর দিই না, রাষ্ট্রযন্ত্র সম্পর্কেও একই কথা খাটে। বরং আন্তর্জাতিক মহলের হিসাব-নিকাশমাফিক আমরা সাক্ষরতাকে শিক্ষার বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করে খুশি। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে হিসাব করতে বসে যাই বিশ্বপরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অবস্থান কোথায় এবং তা নিয়ে আলোচনা এবং নিবন্ধাদি রচনায় পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলি। সম্প্রতি কয়েকটি দৈনিকে সাক্ষরতাবিষয়ক কিছু সংবাদ প্রতিবেদনে সাক্ষরতাবিষয়ক কিছু আলোচনা এবং দু-একটি নিবন্ধ পড়েই শিক্ষার প্রসঙ্গটি মনে এলো।
দুই.
সাক্ষরতা বলতে আমরা কী বুঝব তা নিয়েও রয়েছে কিছু প্রশ্ন। সাক্ষর শব্দটির আভিধানিক অর্থ যদিও ‘অক্ষরজ্ঞানবিশিষ্ট’, কারো মতে নিজের নাম লিখতে, পড়তে বা নাম সই করতে পারা। যদিও আন্তর্জাতিক বিচারে সাক্ষরতার অভিধা এখন ভিন্ন, তাদের চিন্তাভাবনাপ্রসূত সংজ্ঞা। সে বিচারে সাক্ষরতা মানে লিখতে ও পড়তে পারা, গুনতে পারা, হিসাব রাখতে পারা এবং যোগাযোগ রক্ষার সক্ষমতা।
আমার এক ঘনিষ্ঠ সমাজসেবীর ভাষায়: ‘খবরের কাগজ গড়গড় করে পড়া এবং সেখান থেকে দুই লাইন শুদ্ধভাবে লিখতে পারাই সাক্ষরতা।’ তাতে তাঁর মতে, জীবনযাত্রার ন্যূনতম প্রাথমিক প্রয়োজন মিটে যায়। অবশ্য হিসাব-নিকাশ বোঝা ও রাখতে পারাটাও জীবনযাপনের পক্ষে খুবই জরুরি বিষয়।
বাংলাদেশের মতো একটি সমস্যা জটিল ভাষিক জাতিরাষ্ট্রের জন্য সাক্ষরতার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তাই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আমাদের সাক্ষরতাবিষয়ক অবস্থান নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন। এ সম্পর্কে যথারীতি সরকারি ও বেসরকারি ভাষ্য ভিন্ন। কেন জানি, একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে গোটা জাতিকে শিক্ষিত করে তোলার মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকটি নিয়ে উল্লিখিত ধীমানরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন না, আলোচনা করে দাবি তোলেন না এ বিষয়ে। জাতি হিসেবে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির প্রশ্নে আমি বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
যা হোক, সাক্ষরতা প্রসঙ্গেও হিসাব-নিকাশে আমাদের অবস্থান খুব একটা উচ্চমানের নয়। অথচ অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন আবশ্যিক। বেসরকারি হিসাবে আমাদের সাক্ষরতার হার এখন ৫৭, যদিও সরকারি হিসাবে অনেক বেশি। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাবে অবশ্য এই হার ৬১.৫ শতাংশ। কিন্তু সবাই আবার তা মানতে নারাজ।
হয়তো তাই একটি দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম : ‘সাক্ষরতার হার বাড়াতে শুধুই ফাঁকা বুলি’। উল্লেখ্য যে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস এলেই বিষয়টি নিয়ে হিসাব-নিকাশের তোড়জোড় পড়ে যায়, বিচার-বিশ্লেষণ এবং লেখালেখিও শুরু হয়ে যায়। এরপর সব পক্ষেই অদ্ভুত নীরবতা। যেমন—একুশে নিয়ে, ফেব্রুয়ারি মাস নিয়ে। এটা কি আমাদের জাতীয় স্বভাব বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য?
সাক্ষরতা বিষয়ে রাশেদা কে. চৌধূরী বলছেন, ‘ছয় মাস পড়লেই সাক্ষরতা অর্জন হয় না।’ তাঁর মতে, সাক্ষরতা বাড়ানোর কর্মসূচিতে অনেক সমস্যা রয়েছে। কারণ প্রাথমিক শিক্ষা পর্বের কথা বাদ দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়স্করা তাদের দৈনিক উপার্জন (৩০০-৫০০ টাকা) বর্জন করে সংগত কারণে সাক্ষরতা কর্মসূচিতে যোগ দেবে না। তাদের টানতে হলে ভর্তুকির প্রয়োজন হবে।
একই প্রশ্ন পূর্বোক্ত রাশেদা চৌধূরীর। কত বছর বয়স্ক মানুষকে সাক্ষরতা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে? তা যদি হয় ৪৫ বছর, তাহলে ওপরে উল্লিখিত সমস্যার কথা তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে। তা ছাড়া এসেছে প্রকল্পে এমন এনজিওদের যুক্ত করার কথা, গণসাক্ষরতা অভিযানে যাদের কোনো আগের অভিজ্ঞতা নেই বলে অভিমত তাঁর। অর্থাৎ চেনামুখ নির্বাচন, যা কার্যকর না-ও হতে পারে। এ ছাড়া তাঁর মতে, ‘সাক্ষরতার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষতা উন্নয়নও থাকতে হবে।’
পূর্বোক্ত প্রতিবেদনেও (ফাঁকা বুলি) দেখা যাচ্ছে সঠিক কর্মদক্ষতার অভাব। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষাদানে দক্ষতার অভাব। এ বিষয়টি নিয়ে এর আগেও আমরা একাধিকবার আলোচনা করেছি যে আমাদের শিশুদের সুশিক্ষার সূচনা প্রথম পরিবারে, দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রাথমিক শিক্ষায়তন। সেখানে একটি কথাই মর্মবস্তু হিসেবে উল্লিখিত বারবার, আর তা হলো—‘উত্তম শিক্ষক না হলে উত্তম ছাত্র তৈরি হয় না।’ সরকারি ব্যবস্থায় ওই বিশেষ স্থানে ঘাটতি রয়েছে।
এ প্রতিবেদনেও ওই একই সমস্যার প্রকাশ। তাদের তথ্য-উপাত্ত এবং বিশ্লেষণ মতে, ‘২০০২ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই ছিল অসাক্ষর। ২০১৬ সালে এসেও এ অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।’ ভাবা যায় কী এমন একটি প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ও তার করুণ শিক্ষাগত মান যে সেখানে এক-তৃতীয়াংশই সাক্ষরতার চৌকাঠ পার হতে পারছে না। প্রশ্ন করতে হয়, প্রাথমিক শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে যে সাক্ষরতার মতো আটপৌরে স্তরও তারা অতিক্রম করতে পারছে না।
গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রকল্প নিয়েও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এবং বিশেষজ্ঞ নানাজনের নানা মত, কারো কারো অভিযোগও রয়েছে। রয়েছে পূর্বোক্ত ছয় মাসের কোর্স নিয়ে, যে কথা এর আগে বলা হয়েছে। এই প্রতিবেদনেও ‘নামকরা এনজিওদের কাজ না দিয়ে ভুঁইফোড় ও কাগজে-কলমে নাম থাকা এনজিওদের আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে কাজ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।’ ফলে প্রকল্পটি মূলত ব্যর্থ প্রকল্পে পরিণত হয়েছে।
অবস্থা যদি এমনই হয়ে থাকে, তাহলে বলার অপেক্ষা রাখে না যে এখানেও সরষের মধ্যে ভূতের অস্তিত্ব কাজ করছে। সে ক্ষেত্রে টার্গেট তারিখ শেষে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে বলা হলেও দেখা যায়, সংখ্যাগত দিক থেকে লক্ষ্য অর্জিত হলেও মানগত দিক থেকে হচ্ছে না। নামে সাক্ষর, আসলে সাক্ষর নয়।
সাক্ষরতা অভিযানের সাফল্যের হিসাবটা তাই বড় গোলমেলে। আর সে জন্যই সংবাদপত্রের পাতায় দেখতে হচ্ছে নানা ধরনের অভিযোগ বা মন্তব্যের শিরোনাম। বড় সমস্যা বয়স্কদের সাক্ষরতাদান সম্পর্কে। বিবিএসের প্রকাশিত তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমান জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি, অন্য কারো কারো মতে, তা ১৭ কোটি। এর মধ্যে অপরিণত বয়সীদের বাদে নিরক্ষরতার সংখ্যা বেসরকারি হিসাবে সাড়ে পাঁচ কোটি, যদিও সরকারি হিসাবে তা অনেক কম (সোয়া তিন কোটি)।
এ হিসাব পূর্বোক্ত সাক্ষরতার হিসাব-নিকাশ প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। মোটকথা ফলাফল আশানুরূপ নয়। যারা সাক্ষরতা নিয়ে মোটামুটি আশাবাদী, তাদেরও কারো প্রশ্ন : ‘শতভাগ সাক্ষরতা’ কত দূর। এ শিরোনামের প্রতিবেদনে আশা-হতাশার মধ্যে ব্যক্ত অভিমত হচ্ছে, সাক্ষরতা অভিযান সফল করতে এ খাতে সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আমরা বরাবর একই কথা বলে এসেছি, গোটা জাতিকে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সাক্ষরতার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের ক্ষেত্রে পূর্বোক্ত শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তার মূল কথা : ‘প্রকল্পের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সবাইকে নিয়ে সাক্ষরতা অভিযান পরিচালনা করলে দ্রুত সময়ে সুফল পাওয়া যাবে। ২০১৪ সালে যেখানে শতভাগ সাক্ষরতার অঙ্গীকার ছিল, সেখান থেকে যখন আমরা পিছিয়ে পড়েছি, কয়েক বছর হাতে রেখে নতুন আরেকটি অঙ্গীকার নিয়ে নবোদ্যমে কাজ করলেই আমরা দেখব—শতভাগ সাক্ষরতা বেশি দূর নয়।’
‘সবাইকে’ বলতে লেখক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষার্থীদের এ অভিযানে ব্যবহার করার কথা বলেছেন ছোট একটি মন্তব্য সহযোগে। কথাটা হলো ‘সদিচ্ছা’। কথাটা আগেও বহুবার বলেছি আমরা। সরকারি সঠিক সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সদিচ্ছা লক্ষ্য অর্জনের পক্ষে খুবই জরুরি। ইউনেসকোর ঘোষণা বড় কথা নয়। অন্তর থেকে কঠোর তাগিদ দরকার। আপাতত এটাই চাই। জাতিকে অতিদ্রুত সাক্ষর করে তুলতে হবে। সে জন্য সর্বাত্মক তৎপরতা চাই, যা হবে দুর্নীতিমুক্ত।
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী