জাতিসংঘে জাতির জনক

তোফায়েল আহমেদ

জাতিসংঘে জাতির জনক
ছবি : সংগৃহিত

যেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক অনন্য ও মহত্তর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন সেদিনটি ছিল বুধবার। বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে যোগদানের দুর্লভ সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

বছর ঘুরে দিনটি এলে অনুপম সেই স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা মানসপটে ভেসে ওঠে। আমাদের জাতীয় জীবনে এদিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এবারও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে যোগদান করছেন।

জাতির জনকের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করেছেন। প্রিয় মাতৃভাষার প্রতি আমাদের এ প্রগাঢ় ভালোবাসার ফলেই ১৯৫২-এ সংঘটিত মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত শহীদ দিবস ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ১৯৯৯ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ রূপে উদযাপিত হয়। এর শুভ উদ্বোধনটি হয়েছিল মূলত মানবজাতির সর্বোচ্চ ফোরাম জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণের মধ্য দিয়ে।

ঐতিহাসিক এ দিনটির সূচনা হয় একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর, বুধবার। বাংলাদেশ সময় ভোর ৪টায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য রাষ্ট্ররূপে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়।

এ ঘোষণাটি শোনার অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘আমি সুখী হয়েছি যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ন্যায্য আসন লাভ করেছে। জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে, যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন; সেই শহীদদের কথা জাতি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।’

স্বাধীন বাংলাদেশের এ অর্জন মূলত বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্যেরই প্রতিফলন। এ শুভ সন্ধিক্ষণকে সামনে রেখেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানে বঙ্গবন্ধুর সফরসূচি ঠিক করা হয়। সেই হিসেবে ২৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার সকাল সাড়ে সাতটায় বাংলাদেশ বিমানের লন্ডন ফ্লাইটে আমরা ঢাকা ত্যাগ করি।

সর্বমোট ২৪ সদস্যের সফরসঙ্গীর মধ্যে ছিলেন- পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. নূরুল ইসলাম, গ্যাস ও ওয়েল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ড. হাবিবুর রহমান, এমআর সিদ্দিকী এমপি, আসাদুজ্জামান খান এমপি, দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং আরও অনেকে।

লন্ডনে যাত্রাবিরতির পর ওইদিন রাতে প্যান অ্যামের নিউইয়র্ক ফ্লাইটে স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৮টায় আমরা কেনেডি বিমানবন্দরে অবতরণ করি। বিমানবন্দরে সংবর্ধনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এসএ করিম। বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু এবং কামাল হোসেনকে হোটেল ‘ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া’য় আর আমাদের অন্য এক হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হোটেল কক্ষে প্রবেশ করে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোফায়েল কোথায়?’ কর্মকর্তারা জানান, ‘স্যার এটা তো খুব এক্সপেনসিভ হোটেল, তাই তাদের অন্যত্র রাখা হয়েছে।’ তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কেন, তোমরা জানো না তোফায়েল তো মন্ত্রীর পদমর্যাদায়?

যাও তাকে নিয়ে এসো এবং আমার কাছাকাছি তোফায়েলকে জায়গা দাও।’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো দূতাবাসের কর্মকর্তারা দ্রুতগতিতে আমাকে বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থাকার ব্যবস্থা করেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধু অপার পিতৃস্নেহে আমাকে দেখেছেন। সবসময় নিজের কাছাকাছি চোখে চোখে রেখেছেন।

‘ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া’য় বঙ্গবন্ধুর হোটেল কক্ষে দর্শনার্থীর আগমন ছিল চোখে পড়ার মতো। অধিবেশনে আগত প্রতিনিধি দলের নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ লোকজনও বঙ্গবন্ধুর দর্শনপ্রার্থী ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার হোটেল কক্ষে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর আসে প্রতীক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সদ্য সদস্যপদপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা।

নিউইয়র্ক সময় বিকাল ৩টায় এবং বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় (২৫ সেপ্টেম্বর) যখন বক্তৃতা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষিত হয়, তখন বিশ্ব নেতাদের মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চতুর্দিকে তাকিয়ে পরিষদে সমাগত বিশ্বনেতাদের সম্বোধন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘকে ‘মানবজাতির মহান পার্লামেন্ট’ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতা শুরু করেন। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘শান্তি ও ন্যায়ের জন্য পৃথিবীর সব মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বিমূর্ত হয়ে উঠবে এমন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আজ পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ।’

তিনি আরও বলেন, ‘জাতিসংঘের সনদে যেসব মহান আদর্শ উৎকীর্ণ রয়েছে তারই জন্য আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষ চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে।’ সেদিন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন আলজেরিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী-যিনি কিছুদিন আগেও দেশটির রাষ্ট্রপতি ছিলেন- আবদুল আজিজ বুতাফ্লিকা। তাকে আমি ইতিপূর্বেই কাছ থেকে দেখেছিলাম।

বঙ্গবন্ধুকে ওআইসি সম্মেলনে নেয়ার জন্য ’৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারে বুমেদিনের বিশেষ বিমান নিয়ে যে পাঁচজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসেছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। বক্তা হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পরিষদের সভাপতি স্বীয় আসন থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে নিয়েছিলেন।

পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৪৫ মিনিট বক্তৃতার শেষে সভাপতি নিজেই যখন দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছেন, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বিপুলভাবে করতালি দিয়ে আলিঙ্গন করে অভিনন্দিত করলেন বঙ্গবন্ধুকে। অভাবনীয় সেই দৃশ্য।

নিজ চোখে না দেখলে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বনেতাদের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন তিনি। মনে পড়ে, অধিবেশনে আগত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা আমাদের কাছে এসে বলেছিলেন, ‘সত্যিই তোমরা গর্বিত জাতি। তোমরা এমন এক নেতার জন্ম দিয়েছ, যিনি শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, এশিয়ার নেতা নন; তিনি সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা।’

বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন।’ কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ সিদ্ধান্তটি তিনি আগেই নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলা বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করার গুরুদায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল ফারুক চৌধুরীর ওপর। তিনি ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার।

ছুটিতে দেশে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ, ‘ফারুক, তোমার ছুটি নেই। তোমাকে এখানে কাজ করতে হবে।’ কাজগুলো হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর আসন্ন বাংলাদেশ সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ; বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করতে প্রতিনিধি দল নিয়ে বার্মায় গমন। বার্মা থেকে ফেরার পর বঙ্গবন্ধু ফারুক চৌধুরীকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমার লন্ডন যাওয়া চলবে না।

তুমি আমার সঙ্গে নিউইয়র্ক যাবে এবং জাতিসংঘে আমি বাংলায় যে বক্তৃতাটি করব, তাৎক্ষণিকভাবে তুমি সেই বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করবে।’ ফারুক ভাই সুন্দর ইংরেজি বলেন ও লেখেন। প্রথমে ফারুক ভাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তখন পরিস্থিতি সহজ করতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রিহার্সাল দাও। বক্তৃতা ভাষান্তরের সময় ভাববে যেন তুমিই প্রধানমন্ত্রী। তবে, পরে কিন্তু তা ভুলে যেও।’

মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা প্রদানের বঙ্গবন্ধুর এ সিদ্ধান্তটি ছিল তার সমগ্র জীবনের স্বাভাবিক ও যৌক্তিক পরিণতি। সেদিন বক্তৃতারত বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে কেবলই মনে হয়েছে, তিনি যেন বহুযুগ ধরে এমন একটি দিনের অপেক্ষায় নিজকে প্রস্তুত করেছিলেন। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ, ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন সর্বাগ্রে।

তার নেতৃত্বেই সেদিন অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ সফল ধর্মঘট পালন করেছিল। এরপর ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি, মহান ভাষা আন্দোলনের ২য় পর্বে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তিনি কারাগারে বন্দি অবস্থাতেই আমরণ অনশন শুরু করেছিলেন।

সম্প্রতি প্রকাশিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ১৯৪৮ সালে ছাত্ররাই এককভাবে বাংলা ভাষার দাবির জন্য সংগ্রাম করেছিল। এবার আমার বিশ্বাস ছিল, জনগণ এগিয়ে আসবে। কারণ জনগণ বুঝতে শুরু করেছে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করতে পারলে তাদের দাসত্বের শৃঙ্খল আবার পরতে হবে’ (পৃষ্ঠা-১৯৭)।

সংগ্রামী এ বোধ থেকে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিব মাতৃভাষার শৃঙ্খল মোচনে অনশনরত অবস্থায় দৃপ্ত অঙ্গীকারে স্বীয় অভিপ্রায় ব্যক্ত করে লিখেছেন, ‘ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব, হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায়, না হয় মৃত অবস্থায় যাব। Either I will go out of the jail or my dead body will go’ (পৃষ্ঠা-১৯৭)। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় এমনই মরণপণ অঙ্গীকার ছিল তার। এ প্রতিজ্ঞার বলে বলীয়ান হয়েই তিনি জাতিসংঘের শীর্ষ নেতাদের দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন নিজ ইচ্ছার কথা তথা মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা প্রদানের কথা।

মাতৃভাষায় বঙ্গবন্ধু মুজিবের এ ঐতিহাসিক বক্তৃতার পর অধিবেশনে সমাগত পাঁচটি মহাদেশের প্রতিনিধি এবং সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহুল পঠিত জাতিসংঘের ‘ডেলিগেট বুলেটিন’ বঙ্গবন্ধুকে ‘কিংবদন্তির নায়ক মুজিব’ বলে আখ্যায়িত করে। বুলেটিনটিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, ‘এযাবৎ আমরা কিংবদন্তির নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছি। এখন আমরা তাকে কাজের মধ্যে দেখতে পাব।’ জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘বক্তৃতায় ধ্বনিত হয়েছে মুজিবের মহৎকণ্ঠ।’ জাতিসংঘের মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইম তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় আমি আনন্দিত ও গর্বিত। বক্তৃতাটি ছিল সহজ, গঠনমূলক ও অর্থবহ।’

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভূয়সী প্রশংসা করে বুলেটিনটির ভাষ্য ছিল, ‘অতীতের অনগ্রসরতা, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং প্রতিকূল বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহ ফল হিসেবে যে অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে, তা বাংলাদেশের নেতা মুজিব তার বক্তব্যে বিশেষ গুরুত্বসহকারে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন।’

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস কালাহান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে। বাস্তবিকই তিনি এক শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব।’ বেলজিয়ামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যান এল স্লেন্ড বলেন, ‘শেখ মুজিবের মহৎকণ্ঠ আমি গভীর আবেগ ভরে শুনেছি।’ যুগোস্লাভিয়ার উপরাষ্ট্রপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. মিনিক জাতির জনকের বক্তৃতার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘অতীতের অনগ্রসরতা, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং প্রতিকূল বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহ ফল হিসেবে যে অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তা বিশেষ গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়েছে।’

এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতিজনিত সমস্যা এবং বাংলাদেশে সর্বনাশা বন্যার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনায় জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনায় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল অংশগ্রহণের। কাছ থেকে দেখেছি অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে স্বদেশের প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার পর জাতিসংঘ বাংলাদেশের ত্রাণকার্যে ৭০ লাখ ডলার সহায়তা প্রদান করেছিল এবং উপমহাসচিব ড. ভিক্টর উমব্রাইখটকে বাংলাদেশের সমস্যার প্রতি বিশেষ নজর রাখার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠকে অংশগ্রহণের উদ্দেশে অক্টোবরের ১ তারিখ সকাল ১০টায় আমরা নিউইয়র্ক থেকে ওয়শিংটনের এন্ড্রুজ বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করি।

ওয়াশিংটনে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অতিথিশালা ব্লেয়ার হাউসে। বেলা ১১টায় ব্লেয়ার হাউসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম স্যাক্সবি।

বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা স্থায়ী উভয়পক্ষের সফল বৈঠকের পর বিকাল সাড়ে ৪টায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। বিকাল ৫টায় সাক্ষাৎ করেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা। বঙ্গবন্ধুর সম্মানে নিউইয়র্ক সিটি হলে আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় নিউইয়র্কের মেয়র বঙ্গবন্ধুকে নগরীর চাবি উপহার দেন এবং বলেন, ‘এ উপহার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জনগণের প্রতি আমেরিকার জনগণের শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের নিদর্শন।’

প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে যারা আত্মদান করেছেন সেসব শহীদের আর সাড়ে সাত কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে এ চাবি গ্রহণ করে তিনি সম্মানিত বোধ করছেন।’ বক্তৃতায় তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামে আমেরিকার জনগণ যেভাবে সমর্থন জুগিয়েছিল আমি চিরকাল তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করব।’

নিউইর্য়ক নগরীর মেয়রের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘নিউইর্য়ক নগরীতে জাতিসংঘের সদর দফতর অবস্থিত বিধায় এ নগরীর বিশ্বের সব দেশের প্রতি এক বিশেষ দায়িত্ব আছে।’ পরদিন অক্টোবরের ২ তারিখ সকালে সিনেটর কেনেডি ও জর্জ ম্যাকভার্ন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পৃথক পৃথক সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। বিকাল ৪টায় বঙ্গবন্ধুর সম্মানে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির পক্ষে নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর এ সফর ছিল অসংখ্য কর্মসূচিতে ঠাসা। সদ্যস্বাধীন একটি দেশের জাতির জনকের আগমনকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্ক নগরীর বিদ্বৎসমাজে বিশেষ ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয়েছিল। মনে পড়ে, হোটেল ‘ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া’র রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছি। আমার সামনেই উপবিষ্ট একটি পরিবার।

পরিচয়ের শুরুতেই তারা আমায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ?’ আমি বললাম, বাংলাদেশ থেকে। আমাকে অবাক করে দিয়ে তখন তাদের মুখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি কথাই উচ্চারিত হয়, ‘ও, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব! তিনি একজন মহান নেতা।’ পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি তার পলিটিক্যাল সেক্রেটারি। কিন্তু তারা বিশ্বাস করতে পারলেন না।

আমার মতো অল্পবয়সী একজন কী করে বিশ্বখ্যাত নেতা শেখ মুজিবের পলিটিক্যাল সেক্রেটারি হতে পারে! কেবল বললেন, ‘আর ইউ শিওর?’ আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালাম। তখন তারা বলেছিলেন, ‘আমরা মুজিবকে শ্রদ্ধা করি।’ তারপর যখন বঙ্গবন্ধুকে আমি ঘটনাটি ব্যক্ত করি তিনি বললেন, ‘তাদেরকে নিয়ে এসো।’ তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে এলাম। অপার বিস্ময়ে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে আমাকে অভিবাদন জানিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপে মগ্ন হলেন। শুধু বাঙালিদের কাছে নয়, বিদেশিদের কাছেও বঙ্গবন্ধু পরম শ্রদ্ধার আসনে আসীন।

অথচ এক সময় স্বদেশের কিছু ব্যক্তি ও শাসক ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দেয়ার অপচেষ্টা করেছেন। কিছু বই লিখে অসত্য তথ্য পরিবেশন করে মহান জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন। স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রীমহলের সেসব ষাড়যন্ত্রিক প্রয়াস সফল হয়নি।

ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মহত্তম ভূমিকার কারণে, তথা সব রকমের ভয়ভীতি, লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে জীবন-যৌবনের ১২টি বছর যিনি কারান্তরালে থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে আপসহীন অবস্থান গ্রহণ করে; ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে; সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে দৃঢ় কণ্ঠে-‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি আমার মানুষের অধিকার চাই’-মানুষের অধিকারের কথা ব্যক্ত করে হিমালয়সম উচ্চতায় আরোহণ করেন, কিছু ষড়যন্ত্রকারী চাইলেই তাকে হত্যা করে ইতিহাসের পাতা থেকে তার অবদান মুছে দিতে পারেন না; এটিই ইতিহাসের বিধান।

ইতিহাসের বিধান মোতাবেক জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। বিশ্বের নির্যাতিত-শোষিত মানুষের মহান নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বমহিমায় স্বীয় আসনে অধিষ্ঠিত আছেন। বরং যারা তাকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করেছেন, তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন।

আজ পেছনপানে চাইলে দেখি, শুধু স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই নয়, সেই সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন একটি দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, শতাধিক দেশের স্বীকৃতি আদায় এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে তথা জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন, কমনওয়েলথ, ওআইসি এবং মানবজাতির সর্বোচ্চ পার্লামেন্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ও সদস্যপদ অর্জনে বঙ্গবন্ধুর নিরলস কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।

তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ

tofailahmed69@gmail.com

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে