ঢাকার বিভিন্ন ক্লাব থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণ চাঁদা পেতেন সম্রাট

মহানগর ডেস্ক

সম্রাট
সম্রাট। ফাইল ছবি

ঢাকার জুয়াড়িদের কাছে আলোচিত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত। জুয়া খেলাই তার পেশা ও নেশা।

খবরে প্রকাশ, প্রতিমাসে ঢাকার বাইরেও যান জুয়া খেলতে। বিশেষ করে টাকার বস্তা নিয়ে সিঙ্গাপুরে যান তিনি। সেখানে জুয়ার পাশাপাশি নারীসঙ্গও উপভোগ করেন।

সম্প্রতি চলমান শুদ্ধি অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবের ক্যাসিনো বাণিজ্য।আর ইয়ংমেনস ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে র‌্যাবের অভিযানের পর ক্যাসিনো নিয়ে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে।

ইতিমধ্যে ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।

উদ্ধার হয়েছে পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও সহসাধারণ সম্পাদক রুপন ভূঁইয়ার অঢেল সম্পদ ও ৮ কেজি স্বর্ণ।

গ্রেফতার হয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া।

তবে গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের বড় একটি অংশই মূলত চালাতেন ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট। তার অধীনে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ১৫টিরও বেশি ক্যাসিনো।আর এসব ক্যাসিনো থেকে প্রতি রাতে ৪০ লাখ টাকারও বেশি অর্থ জমা হতো সম্রাটের ভাণ্ডারে!

১৫ ক্যাসিনোর মধ্যে কোনোটি থেকে প্রতি রাতে ২ লাখ টাকা, কোনোটি থেকে ৩ লাখ টাকা, কোনোটি থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্তও চাঁদা জমা হতো সম্রাটের ভাণ্ডারে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীর মতিঝিল-বনানী থেকে শুরু করে উত্তরা পর্যন্ত এলাকায় সম্রাটের অধীনে রয়েছে- ভিক্টোরিয়া ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, সৈনিক ক্লাব, ঢাকা গোল্ডেন ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, দিলকুশা ক্লাব, আরামবাগ ক্লাব, মোহামেডান ক্লাব, ফুয়াং ক্লাব,মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, ইয়াংমেন্স ক্লাব, এজাক্স ক্লাব ও উত্তরা ক্লাব।

এসব ক্লাবে প্রতিদিনই কোটি কোটি টাকার জুয়া খেলা চলত।

গোয়েন্দা সূত্র ও ভিক্টোরিয়া ক্লাবের বেশ কয়েকজন জুয়াড়ির বক্তব্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবটিতে অবৈধভাবে প্রথম ক্যাসিনো খোলা শুরু হয়। খেলাটি নিয়ে আসে নেপালের ক্যাসিনো ব্যবসায়ী দীনেশ ও রাজকুমার। তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন বিনোদ মানালী। ভিক্টোরিয়ায় ক্যাসিনো চালুর কয়েক মাসের মধ্যেই বাবা নামের এক নেপালি নাগরিকের কাছে ক্যাসিনোটি বিক্রি করে দেন তারা। তখন থেকে বাবা ও তার ম্যানেজার হেমন্ত মিলে ক্যাসিনোটি চালাতে থাকেন।

এরপর ভিক্টোরিয়া ক্লাবের সভাপতি কাজল ও সাধারণ সম্পাদক তুহিন প্রতিদিন ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা হিসেবে ভাড়া নেন।

ক্লাবের সিসি টিভি ক্যামেরা পরীক্ষা করে জানা যায়, প্রতিদিন ক্লাবটি সম্রাটের সহযোগী যুবলীগ নেতা আরমান ও খোরশেদ আসতেন আর ভাগের টাকা নিয়ে যেতেন।সম্রাটের চাঁদা হিসেবে দৈনিক ৪ লাখ টাকা দেয়া হতো ক্লাবটির পক্ষ থেকে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কলাবাগান ক্লাবের ক্যাসিনো থেকে দৈনিক ২ লাখ টাকা করে চাঁদা নিতেন সম্রাট। এ চাঁদাও বহনকারী ছিলেন আরমান।

২০১৬ সালে কলাবাগান ক্লাবে ঢাকার নামকরা জুয়াড়ি সেন্টু ক্যাসিনো খুললেও পরে ক্ষমতাবলে সম্রাটের অধীনে চলে আসে।

জানা যায়, বিষয়টি সেন্টু প্রায়ই মানতেন না। জুয়া খেলায় লাভের ভাগ থেকে প্রতিদিন ২ লাখ টাকা করে চাঁদা সম্রাটকে দিতে রাজি ছিলেন না তিনি। পরে চাঁদার অঙ্কে বনিবনা না হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ওই ক্লাব বন্ধ করে দেন সম্রাট।

মালিবাগ-মৌচাক প্রধান সড়কের পাশের একটি ভবনে রয়েছে সৈনিক ক্লাব। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের নামে এই ক্লাবটি চললেও এটি নির্ধারিত টাকায় ভাড়া নিয়ে ক্যাসিনো খোলেন যুবলীগ নেতা জসিম উদ্দিন ও এ টি এম গোলাম কিবরিয়া।

অভিযোগ রয়েছে, এই ক্লাব থেকে সম্রাটের ভাণ্ডারে প্রতিদিন ৪ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয় যুবলীগ নেতা জসিম উদ্দিনকে।

বনানী আহমেদ টাওয়ারের ২২ তলায় রয়েছে ঢাকা গোল্ডেন ক্লাব। ক্লাবটি প্রথমে চাঁদপুরের ব্যবসায়ী আওয়াল পাটোয়ারি ও আবুল কাশেম চালু করলেও কৌশলে তা নিজের অধীনে নিয়ে আসেন সম্রাট। জোর করে মালিকানায় ঢোকান আরমানকে। এরপর নেপালি নাগরিক অজয় পাকরালের তত্ত্বাবধানে এর ভেতরে জমজমাট ক্যাসিনো ব্যবসা চালু করেন সম্রাট। এখান থেকে সম্রাটের জন্য প্রতিদিন ৪ লাখ টাকা চাঁদা তুলে দিতেন আরমান।

সম্রাটের সরাসরি তত্ত্বাবধানে চলত ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনোটি। নেপালি নাগরিক হিলমিকে দিয়ে ক্যাসিনোটি চালাতেন তিনি।

এছাড়াও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোবাশ্বের অংশীদারিত্বে ছিলেন। যুবলীগ নেতা আরমান, খোরশেদ ও জাকির এখান থেকে প্রতিদিন ৫ লাখ টাকা চাঁদা সম্রাটকে দিতেন।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দিলকুশা ক্লাবের মালিক নেপালি নাগরিক দীনেশ, রাজকুমার ও ছোট রাজকুমার। সম্রাটকে অগ্রিম ৪০ লাখ টাকা উপঢৌকন দিয়ে ক্লাবটি চালু করে তারা। বর্তমানে প্রতিদিন ৪ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে সম্রাটকে।

ফুটপাত হকার থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন মতিঝিল থানা যুবলীগ নেতা জামাল। সম্রাটের ছত্রচ্ছায়ায় আরামবাগ ক্লাবে ক্যাসিনো খুলে আঙুল ফুলে কলা গাছ তিনি।

সূত্র জানায়, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ তার অলিখিত অংশীদার। ক্যাসিনোটির খরচের খাতা থেকে পাওয়া গেছে, এখান থেকে প্রতিদিন সম্রাটকে ৩ লাখ চাঁদা টাকা দিতে হয়।

তেজগাও লিংক রোডের ফুওয়াং ক্লাবে একসময় মদ বিক্রির পাশাপাশি নিয়মিত বসত ডিজে গানের আসর। তেজগাঁও জোনের এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ক্লাবের দোতলার হল রুমে ক্যাসিনো ব্যবসা খুলে বসেন এর মালিক। এখানেও হানা দিয়েছেন সম্রাট। এই ক্লাব থেকে দিনে ২ লাখ টাকা পান তিনি।

বনানীর ঢাকা গোল্ডেন ক্লাবের মালিক ব্যবসায়ী আবুল কাশেম ও মতিঝিলের স্থানীয় যুবলীগ লীগ নেতা ইমরানের মালিকানায় মোহামেডান ক্লাবে চলছিল ক্যাসিনো। এটি রাজধানীর সবচেয়ে অত্যাধুনিক ক্যাসিনোটি। এখানে অভিযান চালানোর জানা গেছে, এখান থেকে প্রতিদিন আরমানের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করতেন সম্রাট।

সম্রাটের চাচা হিসেবে পরিচিত পুরনো ঢাকার ব্যবসায়ী আলী হোসেন মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে ক্যাসিনো চালু করেন। কাগজে-কলমে সম্রাটের নাম না থাকলেও এর মূল মালিক তিনি বলেই জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। প্রতিদিন এ ক্লাব থেকে ৫ লাখ ঢোকে সম্রাটের পকেটে।

ফুটবল, ক্রিকেটের উন্নয়নের কথা বলে চালু হলেও দিনরাত জুয়া খেলা হতো ফকিরাপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাবে। অভিযোনের পর গ্রেফতার হয়েছেন ক্লাবটির পরিচলক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।সূত্র জানায়, এখান থেকে দিনে ৪ লাখ টাকা চাঁদা নিতেন সম্রাট।

এছাড়া যুবলীগ নেতা আরমান, তছলিম ও খোরশেদের তত্ত্বাবধানে চালু হওয়া এলিফেন্ট রোডের এজাক্স ক্লাব থেকে দৈনিক ৩ লাখ টাকা এবং উত্তরায় এপিবিএন অফিসের উল্টো পাশের একটি ভবন ভাড়া করে চালু করা উত্তরার ক্যাসিনো থেকে দৈনিক ২ লাখ চাঁদা আদায় করতেন সম্রাট।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে