চীনে কমিউনিস্ট শাসনের ৭০ বছর

আন্তর্জাতিক

কমিউনিস্ট পার্টি
কমিউনিস্ট পার্টির শাসনের ৭০ বছর পূর্তিতে দিনটি বিশেষভাবে পালন করছে চীন। এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সি চিন পিং। গ্রেট হল, ৩০ সেপ্টেম্বর। ছবি: এএফপি

চীনে কমিউনিস্ট পার্টির শাসনের ৭০ বছর পূর্ণ হলো আজ। ১ অক্টোবর বিশেষভাবে দিনটি পালন করছে বেইজিং। নানা অনুষ্ঠান, প্যারেড চলবে দিনভর। পিপলস রিপাবলিকান অব চীনের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপনে সাজ সাজ রব কমিউনিস্ট দেশটিতে।

নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে চীন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র, সামরিক বিমান ও সাঁজোয়া যানের মহড়াসহ সামরিক বাহিনীর কসরতের আয়োজন করেছে চীন। আগেই সামরিক শক্তি প্রদর্শনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।

মহড়ায় থাকছে ১৫ হাজার সেনা, ১৬০টি ফাইটার জেট, ৫৮০টি ট্যাংকার এবং অন্যান্য এমন কিছু অস্ত্র, যা আগে কখনো জনসমক্ষে দেখানো হয়নি।

১৯৪৯ সালে যাত্রা শুরুর সময় চীনের অধিকাংশ নাগরিক বিদেশ ভ্রমণের কথা কল্পনাও করতেন না। সেই চীনারা এখন প্রতি ঘণ্টায় ১৯ হাজারবার বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছেন। এই ৭০ বছর পর চীন নিজেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বিশ্বে শীর্ষে সি চিন পিংয়ের দেশ।

আবার বিক্ষোভে-স্লোগানে ফুঁসে উঠছে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকং। তাদের দাবি স্বাধীনতা। আর এ জন্য চীনের বর্ষপূর্তিকেই লক্ষ্য করেছে তারা। চীনের বর্ষপূর্তির আয়োজনকে মাটি করতে গত শনিবার থেকে বিক্ষোভ শুরু করেছে তারা। রোববার থেকে বিশ্বব্যাপী ‘চীনের একনায়কবিরোধী’ বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন হংকংবাসী।

ক্রমপর্যায় দেখে নেওয়া যাক পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার আদ্যোপান্ত

আজকের চীনের অগ্রযাত্রার হাঁটা শুরু হয় মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বেই। ছবি: এএফপি

১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন শুরু হয় চীনে। পরাজিত চিয়াং কাই-শেকের ন্যাশনালিস্ট সরকারকে সেই বছরের ডিসেম্বরে পাঠানো হয় তাইওয়ানে।

‘যেখানেই জনপদ, সেখানেই আইনি সেবা’ স্লোগান ধারণ করে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় চীনের বিচার বিভাগ। সমাজের সব মানুষের ঘরে ঘরে ন্যায়বিচার পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই পথচলা শুরু হয় দেশটির বিচার বিভাগের। ৭০ বছর পরও সেই লক্ষ্য সমুন্নত রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন দেশটির বিচারকেরা।

১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ হয়। দুই কোরিয়ার এই যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার সমর্থনে দাঁড়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উত্তর কোরিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল চীন। সেই যুদ্ধে লাখো চীনা সেনার মৃত্যু হয়েছিল।

১৯৫৭ সালে ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড মুভমেন্টের’ মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দিকে পা বাড়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। এ যাত্রায় মাধ্যম ছিল শিল্পায়ন ও সমবায়ীকরণ। এই সিদ্ধান্তের ফলেই চীনের আজকে এই অবস্থান বলে অনেকেই মনে করেন।

১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তিন বছরের দুর্ভিক্ষে প্রায় কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল দেশটিতে। এ পরিস্থিতির জন্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডকেই দায়ী করেন অনেক অর্থনীতিবিদ।

সীমান্ত নিয়ে বিরোধের জেরে ১৯৬২ সালে প্রতিবেশী ভারত আক্রমণ করে বসে চীন। চীনের সেনারা ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ও লাদাখে ঢোকে। এ নিয়ে যুদ্ধে ভারতের সঙ্গে জয়ী হয় চীন। যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে অরুণাচল ভারতকে ফিরিয়ে দেয় চীন।

মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। চীনকে পুঁজিবাদী ও সাবেকি চিন্তা থেকে মুক্ত করার এই বিপ্লবকে শুদ্ধিকরণের মর্যাদা দেওয়া হয়। এ সময় পুঁজিবাদী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায়।

তাইওয়ান ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। এরপরই চীন স্থায়ী সদস্য হয় জাতিসংঘের। পায় ভেটো ক্ষমতা।

১৯৭৬ সালে চীনের থাংশানে ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ওই বছরটি চীনের জন্য দুঃখের। কারণ, এই বছরই মৃত্যু হয় চীনের প্রেসিডেন্ট মাও সে তুংয়ের। কমিউনিস্ট নেতা দেং জিয়াও পিং চীনের ক্ষমতায় বসেন। দেং জিয়াও পিংয়ের নেতৃত্বেই বাজার অর্থনীতির দিকে ঝুঁকেছিল চীন। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য চীনের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক সংস্কারও।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৭২ সালে চীন সফরে যান। কিন্তু চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন কূটনৈতিক বন্ধন তৈরি হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। এর ছয় বছর পর ১৯৮৫ সালে ইতিহাসে প্রথমবার আমেরিকার সঙ্গে উদ্বৃত্ত সম্পদের বাণিজ্য শুরু হয় চীনের।

রাজনৈতিক সংস্কারের বিরোধিতায় ১৯৮৯ আন্দোলন শুরু করেছিলেন চীনের ছাত্র ও শ্রমিকেরা। ওই আন্দোলন দমাতে ওই বছরের ৪ জুন তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গুলি চালায় দেশটির সেনাবাহিনী।

১৯৯৭ সালে মৃত্যু হয় দেং জিয়াও পিংয়ের। ওই বছরই ব্রিটিশ কলোনি হংকং চীনের অন্তর্ভুক্ত হয়। এর চার বছর পর ২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হয় চীন।

তিব্বতের লাসায় দাঙ্গা হয় ২০০৮ সালে। এ বছরই সিচুয়ানে ভূমিকম্প আঘাত হানে। মৃত্যু হয় প্রায় ৮০ হাজার মানুষের। একই বছর রাজধানী বেইজিংয়ে বসে অলিম্পিকের আসর।

২০১২ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হন সি চিন পিং। পরের বছরই চীনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। ক্ষমতায় বসে তিনি পুরোনো সিল্ক রোড পুনরুদ্ধার করেন।

এর ছয় বছর পর ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ তুলে দিয়ে দেশের সংবিধান সংস্কার করে চীন। ফলে সি চিন পিংয়ের আজীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ খুলে যায়। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুংয়ের পর দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনীতিক হিসেবে আবির্ভূত হন সি চিন পিং। সি চিন পিংকে আরও ক্ষমতাধর করতে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির গঠনতন্ত্রে সংশোধন আনা হয়। এর মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মেয়াদ বেড়েছে। সি চিন পিংয়ের ‘নতুন যুগে সি চিন পিংয়ের চীনা সমাজতান্ত্রিক চিন্তা’ সংযুক্ত করা হয়েছে গঠনতন্ত্রে।

২০১৭ সালে বেইজিং সফরে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর পরের বছরই বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, গার্ডিয়ান

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে