সৌদি আরবের দুটি তেল স্থাপনায় ভয়াবহ হামলার পর দেশটির ক্ষমতাসীন রাজপরিবার ও ব্যবসায়ী অভিজাতদের কয়েকজন সদস্য সিংহাসনের উত্তরসূরি মোহাম্মদ বিন সালমানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন।
তাদের শঙ্কা পশ্চিমাবিশ্বে এমবিএস নামে পরিচিত এই যুবরাজ রাজপরিবারকে সুরক্ষা দিতে পারবেন না। এ নিয়ে তারা হতাশা ব্যক্ত করেছেন বলে খবরে বলা হয়েছে।
আল-সৌদি পরিবারের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য তাদের দেশের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পরিবারটিতে অন্তত ১০ হাজার সদস্য রয়েছেন।
রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত কূটনৈতিক সূত্রের বরাতে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলি মেইল ও বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে এমন তথ্য জানা গেছে।
বিশ্বের শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী দেশটির দুটি স্থাপনায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে সৌদি রাজকীয় অভিজাত পরিষদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। তারা মনে করেন, যুবরাজ ক্ষমতাকে কঠোরভাবে আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছেন।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন পরিবারটির মধ্যে যারা মনে করেন, ইরানের বিরুদ্ধে যুবরাজ অতিরিক্ত আগ্রাসী অবস্থান নিয়েছেন, হামলার ঘটনার পর তাদের মধ্যে যুবরাজের সমালোচনা বাড়ছে।
রাজপরিবার সম্পর্কিত অভিজাত পরিষদের একটি সূত্র জানায়, যুবরাজের নেতৃত্ব নিয়ে এখানে প্রচুর অসন্তোষ রয়েছে। তাদের প্রশ্ন- এটি কীভাবে সম্ভব যে হামলাটি কোথা থেকে হয়েছে, তা শনাক্ত করতে পারেননি তারা?
সূত্রটি আরও জানায়, অভিজাত পরিষদের কয়েকজন বলছেন- যুবরাজের প্রতি তাদের কোনো আত্মবিশ্বাস নেই।
আরও চারটি সূত্র ও জ্যেষ্ঠ কূটনৈতিকের কাছ থেকে একই কথার পুনরাবৃত্তি শোনা গেছে। তবে এর পরও সৌদি আরবে যুবরাজের ঘোর সমর্থক রয়েছেন।
যুবরাজের অনুগত চক্রের একটি সূত্র জানায়, একজন সম্ভাব্য শাসক হিসেবে সাম্প্রতিক ঘটনায় ব্যক্তিগতভাবে তার ওপর ক্ষতিকর কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে তিনি ইরানি প্রভাব বিস্তার রোধ করতে চাচ্ছেন। এটি অবশ্যই দেশপ্রেমের ইস্যু। কাজেই তিনি ঝুঁকিতে পড়বেন না। অন্তত যতদিন তার বাবা জীবিত থাকবেন।
দ্বিতীয় এক জ্যেষ্ঠ বিদেশি কূটনীতিক বলেন, এমবিএসের পেছনে সাধারণ সৌদিরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে চাচ্ছেন। কারণ তিনি একজন বলিষ্ঠ, স্থিতিশীল ও গতিশীল নেতা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সৌদি সরকারের গণমাধ্যম শাখার কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
মার্কিন সম্প্রচার মাধ্যম সিবিএসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে যুবরাজ বলেছেন, আয়তনে বড় ও যে ধরনের হুমকির মুখোমুখি, সেই মানদণ্ডের হিসাবে সৌদি আরবের সুরক্ষা দেয়া কঠিন।
তিনি বলেন, পুরো রাজ্যটিকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের কাজ। কাজেই ইরানকে প্রতিরোধে কঠোর ও জোরালো বৈশ্বিক পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
এ ছাড়া সামরিক উপায়ে বদলে শান্তিপূর্ণ সমাধানেই তার বিশ্বাস বলে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রফতানিকারক দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র।
৮৩ বছর বয়সী বাবা বাদশাহ সালমানের পরেই সিংহাসনের অধিকারী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে রয়েছেন তিনি। দেশটির এই কার্যত নেতা সৌদি আরবকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তরুণ সৌদিদের মধ্যে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। রক্ষণশীল মুসলমান দেশটিতে বিধিনিষেধ শিথিল করে দিয়ে তিনি বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছেন।
নারীদের তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি অধিকার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এবং সৌদির তেলনির্ভর অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করার প্রত্যয়ের কথা জানিয়েছেন।
কিন্তু দেশটির গণমাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড়ে তার উদ্যোগের প্রতি আগ্রহের মাত্রা পরিমাপ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
১৪ সেপ্টেম্বরের হামলায় তেল জায়ান্ট আরামকোর দুটি স্থাপনায় বিস্ফোরণ ঘটেছে। এতে সৌদির তেল উৎপাদন অর্ধেক ও বিশ্বের ৫ শতাংশ কমে গিয়েছিল।
ইরানকে এ হামলায় দায়ী করছে সৌদি ও তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। তেহরান বরাবরই সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে আসছে।
লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি সম্পর্কিত থিংকট্যাংক চ্যাথাম হাউসের গবেষক নেইল কুইলিয়াম বলেন, হামলার ব্যাপকতা ছিল সৌদি জনগণ কিংবা প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে যুবরাজ ও তার ভাই উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রীর ধারণার বাইরে। যুক্তিযুক্তভাবেই দেশটি এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় হামলায় আক্রান্ত হয়েছে।
সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশবিষয়ক এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সৌদির নিরাপত্তা দিতে তার সক্ষমতার ওপর আত্মবিশ্বাস কমে গেছে। আর এটা তার পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নীতিরই ফল।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুচ্ছ করে বছর দুয়েক আগে সিংহাসনের উত্তরসূরি হওয়ার পর থেকে তার বিরুদ্ধে ফুঁসতে থাকা অসন্তোষে ইন্ধন জুগিয়েছে এ হামলা।
দুর্নীতির অভিযোগে সৌদি আরবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তিনি ধরপাকড় ও গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছেন।
প্রতিবেশী ইয়েমেনে ইরানসংশ্লিষ্ট হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যয়বহুল যুদ্ধের কারণে দেশের বাইরে সুনাম খুইয়েছেন এমবিএস। হুতিদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান হামলায় হাজার হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন।
এতে দেশটিতে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। অর্থনীতি ভেঙে পড়ায় দুর্ভিক্ষের কিনারে গিয়ে ঠেকেছে ইয়েমেন।
এর পর বছরখানেক আগে ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটে মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে নির্মমভাবে হত্যার পর আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েন যুবরাজ। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বলছে, মোহাম্মদ বিন সালমানই এ হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে সিবিএসকে তিনি বলেন, খাসোগিকে হত্যায় তিনি নির্দেশ দেননি। তবে সৌদির কার্যত নেতা হিসেবে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ দায়ভার তার কাঁধেই পড়ে।
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবায়ের বলেন, কর্তৃত্ব ও অনুমতির বাইরে গিয়ে সৌদি এজেন্টরা খাসোগিকে হত্যা করেছেন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন থিংকট্যাংক আয়োজিত একটি আলোচনাসভায় তিনি এ কথা বলেন।
সৌদি আরবের কয়েকজন সমালোচক বলেন, ইরানের প্রতি এমবিএসের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি এবং ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িত হওয়ার সুবাদে সৌদি আরব হামলার শিকার হয়েছে।
পাঁচটি সূত্র ও এক জ্যেষ্ঠ কূটনৈতিক সূত্র জানায়, প্রতিরক্ষা খাতে কোটি কোটি ডলার খরচ করেও হামলা থেকে সৌদিকে যুবরাজ রক্ষা করতে না পারায় তারা হতাশার কথা জানিয়েছেন।
সাম্প্রতিক নিউইয়র্কে দেয়া বক্তব্যে জুবায়ের বলেন, সৌদি আরবের দিকে ধেয়ে আসা শত শত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করেছে আমাদের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। ১৪ সেপ্টেম্বরের হামলা শনাক্ত করতে ব্যর্থতার ঘটনা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ৩০০ ফুট উচ্চতা দিয়ে উড়ে আসা ছোট বস্তু শনাক্ত করা খুবই কঠিন। কয়েকজন সৌদি অভিজাত বলেন, ক্ষমতায় নিজের নিয়ন্ত্রণ সংহত করতে যুবরাজের চেষ্টা দেশটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
সরকারি চক্রের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, এমবিএস এমন সব কর্মকর্তাকে বসিয়েছেন, যারা আগের লোকদের তুলনায় কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন।
সিংহাসনের উত্তরসূরি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ। বছর দুয়েক আগে তাকে সরিয়েই পদটি দখল করেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান।
মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দুই দশকের অভিজ্ঞতা ছিল সাবেক যুবরাজ নায়েফের। দেশের পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এ কাজে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ৩৩ বছর বয়সী এক চাচাতো ভাইয়ের নাম ঘোষণা করেছেন এমবিএস।
এর আগে গোয়েন্দা ও সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ আওতাগুলোকে রাজকীয় আদালতের আওতায় তিনি নিয়ে এসেছেন।
১৯৯৬ সাল থেকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী সৌদি অ্যারাবিয়ান ন্যাশনাল গার্ডের দেখভাল করতেন প্রিন্স মিতেব বিন আবদুল্লাহ। যুবরাজ তাকেও সরিয়ে দিয়েছেন।
গত বছর তার স্থলাভিষিক্ত করেন তখনকার ৩২ বছর বয়সী প্রিন্স আবদুল্লাহ বিন বন্দর বিন আবদুল আজিজকে। ব্যক্তিগত ব্যবসায় জড়িত থাকার পর দুই বছরেরও কম সময়ে মক্কার উপ-গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
সৌদি আরবের ভেতরের লোকজন ও পশ্চিমা কূটনীতিকরা বলছেন, যুবরাজের বাবা বাদশাহ সালমান জীবিত থাকাকালে তার বিরোধিতা করা রাজপরিবারের পক্ষে অসম্ভব। বাদশাহ তার প্রিয় পুত্রের বিরুদ্ধে যাবে এমন সম্ভাবনা কম।
ইতিমধ্যে তার শাসনের অধিকাংশ দায়িত্ব ছেলের হাতে তিনি অর্পণ করেছেন। কিন্তু সাপ্তাহিক মন্ত্রিসভায় এখনও সভাপতিত্ব করছেন ও বিদেশি অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছেন।
বাদশাহর ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় না নিয়েই কূটনীতিকরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ তাকে দেয়ার পর এমবিএসের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করা কঠিন।
সালমানের একমাত্র আপন ভাই ৭৭ বছর বয়সী প্রিন্স আহমেদ বিন আবদুল আজিজ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারেন বলে মনে করছেন রাজপরিবারের কয়েকজন সদস্য।
নিরাপত্তা বাহিনী, রাজপরিবার ও পশ্চিমা শক্তিও তাকে সমর্থন করতে পারেন বলে পাঁচটি সূত্র জানিয়েছে।
একজন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী বলেন, তিনি কী করেন; তা দেখতে সবাই আহমেদের দিকে তাকিয়ে আছেন। রাজপরিবার ভাবছে, একমাত্র তিনিই তাদের রক্ষা করতে পারবেন।
তবে আহমেদ এমন কোনো ভূমিকা রাখতে ইচ্ছুক কিনা, তার কোনো প্রমাণ নেই। আড়াই বছর বিদেশে অবস্থানের পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে রিয়াদে ফিরে অপেক্ষাকৃত কম পদমর্যাদার দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি।
বিদেশে থাকার সময় লন্ডনের একটি আবাসিক এলাকার বাইরে সৌদি রাজপরিবারের পতনের দাবিতে বিক্ষোভে সাড়া দেয়ার সময় দেশের নেতৃবৃন্দের সমালোচনা করেছেন তিনি।
সৌদি শাসক পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের নিয়ে গঠিত হাইয়াতুল বাইয়া বা আনুগত্য পরিষদের তিন ব্যক্তির মধ্যে তিনিও একজন, যারা ২০১৭ সালে মোহাম্মদ বিন সালমানকে সিংহাসনের উত্তরসূরি মনোনয়নের বিরোধিতা করেছিলেন।
তখন সৌদি আরবের দুটি সূত্র এমন তথ্য জানিয়েছিলেন। তবে এ বিষয়ে জানতে প্রিন্স আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
একটি সূত্র জানিয়েছে, এমবিএসকে চ্যালেঞ্জ করবেন কিনা এ বিষয়ে প্রিন্স আহমেদের অবস্থান হচ্ছে, যখন এ ইস্যুটি সামনে আসবে, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন।