প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর, আবরার হত্যা ও সামাজিক মূল্যবোধ

সম্পাদকীয়

মত ও পথ

চারদিনের সফর শেষে রোববার রাতে ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এটাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম দিল্লি সফর। এর আগে ২০১৭ সালে তিনি সর্বশেষ দিল্লি সফর করেন। এই সফরে সাতটি চুক্তি ও তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে দুই দেশের মধ্যে৷ সেগুলোতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা সমালোচনা চলছে। কেননা প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের দিকে বাংলাদেশের মানুষ নানা কারণে নজর রাখছিল। বিশেষ করে তিস্তা চুক্তি ও ভারতের বিতর্কিত এনআরসি বিষয়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে কি আলোচনা হয় তা ছিল মূল আকর্ষণ। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে সেগুলোর ভালো দিক থাকা সত্ত্বেও তিস্তা চুক্তি, রোহিঙ্গা ইস্যু ও বিতর্কিত এনআরসি নিয়ে জোড়ালো ঘোষণা না থাকায় কড়া সমালোচনা হচ্ছে।

তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের সাথে ১৯৮৭ সালের পর থেকে কোনো চুক্তি নেই বাংলাদেশের৷ একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে দেশটি৷ ফলে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় পানিসংকট চলছে৷ ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরে তিস্তা পানি চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তখন ঢাকায় আসার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আসেননি, তিস্তা চুক্তিও তাই হয়নি৷ এরপর ২০১৫ সালে ঢাকা সফরকালে তিস্তার পানি দেয়া যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন মমতা৷ পরিবর্তে তিনি তোর্সা নদীর পানিবণ্টনের প্রস্তাব দেন৷

universel cardiac hospital

প্রত্যাশিতভাবেই তিস্তা নিয়ে আলাদা কোনো সমঝোতা বা চুক্তি এই সফরে স্বাক্ষরিত হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী মোদীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, “তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে ২০১১ সালে দুই দেশের সরকার যে অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামোয় একমত হয়েছিল, কবে তার বাস্তবায়ন হবে বাংলাদেশের জনগণ কিন্তু অধীর আগ্রহে সেই অপেক্ষায় আছে।”

যৌথ বিবৃতিতে আরও জানানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী মোদী জবাবে বলেছেন, তার সরকার তিস্তায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের (স্টেকহোল্ডার) সঙ্গে নিরন্তর কাজ করে চলেছে যাতে যত দ্রুত সম্ভব একটি তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করা যায়।

এগুলো অবশ্য বিশেষ নতুন কোনো কথা নয়। আগেও বহুবার এই ধরনের কথাবার্তা দু’দেশের পক্ষ থেকে শোনা গেছে। নতুন যেটা তা হলো, তিস্তা ছাড়াও আরও ছয়টি অভিন্ন নদীর (মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, দুধকুমার) পানি কীভাবে ভাগাভাগি করা যায়, অবিলম্বে তার একটি খসড়া কাঠামো প্রস্তুত করতে দুই নেতা যৌথ নদী কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন।

এ ছাড়াও ফেনী নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়েও অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামো তৈরি করতে কমিশনকে বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত, এই ফেনী নদী থেকেই ১.৮২ কিউসেক পানি নিয়ে ত্রিপুরার সাবরুম শহরে পানীয় জল সরবরাহেও বাংলাদেশ রাজি হয়েছে।

প্রতিবেশী ভারতের অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে পানীয় জল সরবরাহে আমরা দ্বিমত পোষণ করছি না। সাবরুমের মানুষও তো আমাদের প্রতিবেশী৷ তাদের বিপদ আমরা দেখব৷ পাশাপাশি চাইব যেন আমাদের সমস্যাগুলোও সমাধান হোক৷ কিন্তু তিস্তার মতো বহুপ্রতিক্ষীত পানিবন্টন চুক্তি নিয়ে আভ্যন্তরীণ সমঝোতার অজুহাতে চুক্তি না করতে পারার ব্যর্থতা সত্যিই দুঃখজনক।

আমরা মনে করি- এতে করে বাংলাদেশের জনমনে এক ধরনের মিশ্র এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। যদিও একথা সত্য- কী পেলাম আর কী দিলাম, বিবেচনাটা এভাবে হওয়া উচিৎ নয়৷ কিন্তু তিস্তার পানি আমাদের প্রয়োজন৷ এটা দেশের মানুষ চায় এবং এটা আমাদের ন্যায্য দাবি। আমরা আশা করব- এটা নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বেশি জোরালো হবে।

আমাদের একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, যেগুলো আমাদের জীবন মরণ সমস্যা, সেগুলো যদি না পাই তাহলেতো প্রশ্ন উঠবেই৷ রোহিঙ্গা ইস্যুতে শক্তভাবে পাশে দরকার ভারতকে৷ এনআরসি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী আশ্বস্ত করলেও তাঁর মন্ত্রীরা প্রতিনিয়তই হুমকি দিচ্ছেন৷ এগুলোর সুরাহা হওয়া দরকার৷ পাশাপাশি সাবরুমের মানুষের খাবার পানির সংকট সেটা পূরণ হোক৷ আমাদের দাবিওতো পূরণ হতে হবে৷ আশা করি ভারত এ বিষয়গুলো দ্রুত বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের জনমনের দাবির প্রতি একাত্ম হবে।

০২.

সাম্প্রতিক সময়ে নানা কারণে ছাত্রলীগ আলোচনা ও সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যদিও অবিভক্ত পাকিস্তানের সর্বপ্রথম ছাত্র সংগঠন এটি। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে যাত্রা শুরু এই সংগঠনটির। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর নাম হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সঙ্গে এ সংগঠনটির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী ও সংগঠক হিসেবে এ গৌরবের অংশীদার হতে পেরে আমি গর্বিত। কিন্তু গত এক দশকে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড সংগঠনটিকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে। সারাদেশে একটিই প্রশ্ন এর শেষ কোথায়? এ সময়ে ছাত্রলীগ  টেন্ডারবাজি, মাদক ও অস্ত্রসহ নানা গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। এমনকি বিশ্বজিৎ হত্যার মতো জঘন্য কাণ্ডেও তাদের নাম জড়িয়েছে। সর্বশেষ জড়িয়েছে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের বিদ্যাপীঠ হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে। সংগঠনের একজন সাবেক কর্মী হিসেবে এসব মেনে নিতে পারছি না। তার মৃত্যুর নির্মম সংবাদটি সারাদেশের মানুষের মতো আমাকেও মর্মাহত করেছে। কিন্তু ছাত্রলীগ তো এমন হবার কথা ছিল না। ৭৫ পরবর্তী সময়ে জীবন বাজি রেখে আমরা যে কয়েকজন ছাত্রলীগকে পুনর্গঠন করেছি সেদিন আমরা একটি স্বপ্নকেই বুকে ধারণ করেছি যে, জাতির পিতা যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে ছাত্রলীগ প্রতিটি মুহূর্তে সে স্বপ্নকে লালন করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ছাত্রলীগ সে আবেগের জায়গা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে- কী ছিল আবরারের অপরাধ? বিভিন্ন সামাজিক ও গণমাধ্যম বলছে- বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক কিছু চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে আবরারের কিছু স্ট্যাটাস এ হত্যার কারণ। সোমবার (৭ অক্টোবর) দিনভর বুয়েটের ক্যাম্পাসেও এ ধরনের আলোচনা ছিল। তাঁর সর্বশেষ স্ট্যাটাস ছিল শনিবার বিকেল ৫টা ৩২ মিনিটে। তাতে ভারতকে মোংলা বন্দর ব্যবহার ও গ্যাস রপ্তানির সমালোচনা ছিল। এর পরদিন রোববার রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা আবাসিক হলের নিজ কক্ষ থেকে আবরারকে ডেকে নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেন। এরপর রাতে হলে খবর ছড়ানো হয়, ‘শিবির’ সন্দেহে আবরারকে পেটানো হয়েছে। যদিও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুষ্টিয়ায় আবরারের পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

আমরা আবরারের রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাই না। কেননা যে অজুহাতে তাকে হত্যা করা হয়েছে তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তার মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে।তার মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার বহু মাধ্যম রয়েছে। তাই বলে হত্যা? আমাদের ভাবতেই গা শিরশির করে- কোথায় যাচ্ছি? কী আমাদের ভবিষ্যত? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, সমাজ, সংস্কৃতি আর রাজনীতির এতটা অধঃপতন কোনোভাবেই কাম্য নয়।

সংবাদ মাধ্যমের বিবরণে জানা যায়, রোববার দিবাগত রাত তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা হলের একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মাঝ থেকে আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বুয়েটের শের-ই বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে পেটান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা।

এ ঘটনার সিসিটিভির সব ফুটেজ প্রকাশ করতে শিক্ষার্থীরা দাবি তোলেন। কিন্তু শের-ই বাংলা হল প্রশাসন ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করতে অনীহা দেখায়। তারা বলেন, পুলিশ ভিডিও ফুটেজ নিয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে সম্পূর্ণ ভিডিও দেয় প্রশাসন। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে সিসিটিভির ফুটেজ নিয়ে প্রশাসনও কেন এমন আচরণ করলো? প্রশাসনকে কে এমন লাইসেন্স দিয়েছে হত্যার মতো জঘন্য ও নির্মম বিষয়ে ভিডিও ফুটেজ নিয়ে সত্য ধামাচাপা দেবার? আমরা মনে করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এ বিষয়ে শের-ই বাংলার হল প্রশাসনকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা। একই সঙ্গে আবরারকে পিটিয়ে হত্যায় বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ যে ১৪ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদেরকে ছাত্রলীগ থেকে শুধু বহিষ্কার নয়- দৃষ্টান্তমূলক এবং সর্বোচ্চ আইনি বিচারও দেখতে চাই।

আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে অগ্রগতির মহাসড়কে ক্রমন্বয়ে এগিয়ে চলছে তা কতিপয় দুষ্টচক্রের কারণে ম্লান হতে পারে না। এই সব দুষ্টুদের আইনের আওতায় এনে যেমন সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, তেমনি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও মূল্যবোধ, সহনশীলতা ও যুক্তিনির্ভর প্রজন্ম কিভাবে গড়ে তোলা যায় তা নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে