এবার তিস্তা ইস্যুর দ্রুত সমাধান চাই

আহমদ রফিক

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক। ফাইল ছবি

তিস্তা নদীর পানি তথা ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের মনোযন্ত্রণা বেড়েই চলেছে এবং সেটা শুধু রাষ্ট্রিক-রাজনৈতিক পর্যায়েই নয় বা শুধু তিস্তাপারের লোকজনের মধ্যেই নয়, তা বাংলাদেশের সর্ব শ্রেণির মানুষের মধ্যে তিস্তা নিয়ে ভারতের দ্বিমুখী আচরণের কারণে এ দেশের শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে যে ভারতবিরোধী তিক্ত মনোভাব ক্রমেই বেড়ে চলেছে, এটা ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন উপলব্ধি করে কি না এবং সেই সূত্রে ভারতীয় আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক রাষ্ট্রযন্ত্র অনুভব করে কি না, তা আমার নিশ্চিত জানা নেই।

তবে তাদের রাজনৈতিক চেতনার পরিমাপে আমার বিশ্বাস, তারা তা ভালোভাবেই জানে ও বোঝে। জেনে-বুঝেই তারা এ বিষয়ে রাজা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। এ জানার অন্তত একটি উৎস বা সূত্র তো জনাকয় অভিজ্ঞ ভারতীয় (বাঙালি) সাংবাদিক, যাঁরা তিস্তা নিয়ে এ উপলক্ষে ভারত-বাংলাদেশ জনভিত্তিক সম্পর্ক নিয়ে নির্মোহ, নিরপেক্ষ ও যুক্তিনিষ্ঠ প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকেন।

universel cardiac hospital

এখানেই বাংলাদেশের দেশপ্রেমী শিক্ষিত শ্রেণির সান্ত্বনা। এ মনোভাব পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছুসংখ্যক ধীমানের মধ্যেও লক্ষ করা যায়। কিন্তু সান্ত্বনায় তো লক্ষ্য অর্জনের চিঁড়ে ভিজে না। পূর্বোক্ত দ্বিমুখী নীতির অবসান ঘটারও সম্ভাবনা তৈরি হয় না। দ্বিমুখী নীতির অর্থ হলো একদিকে মধুর বচনে আশ্বাসের পর আশ্বাস, অন্যদিকে আলোচনার প্রস্তুতি নিয়ে দিনগত পাপক্ষয়—ইস্যুটিকে সময়ের দৈর্ঘ্যে ঝুলিয়ে প্রলম্বিত ও বিলম্বিত করা।

সেই কবে কংগ্রেসি শাসনামল থেকে বর্তমান বিজেপি শাসনামল পর্যন্ত একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি আমরা দেখে আসছি। মনে হয়, এই সেই দিনের কথা। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা সফরে এলেন। তাঁর ব্রিফকেসে তিস্তাবিষয়ক প্রত্যাশায় ঢাকার মানুষের মুখ উজ্জ্বল—দৃশ্যটি ভুলতে পারছি না। কিন্তু মমতাদির বিরোধিতার অজুহাতে কথিত ‘ভদ্র মানুষ, ভালো মানুষ’ প্রধানমন্ত্রী ব্রিফকেস না খুলেই সভার মৌখিক আশ্বাস শেষে ফিরে গেলেন। বিদায়ক্ষণের কথাগুলোও ভুলিনি : তিস্তা চুক্তি হবে, এটা সাময়িক সমস্যা, সমাধানের অপেক্ষা মাত্র।

দুই.

এর পর গঙ্গায় অনেক জল, পদ্মায় অনেক পানি বয়ে গেল। সময়ও কম গেল না। নানা ইস্যুতে ভারত-বাংলাদেশের চুক্তি, বিনিয়োগ, ট্রানজিট-সুবিধার মতো কত কিছু ঘটে গেল, মৈত্রীবন্ধন সুদৃঢ় হলো—দুই প্রধানমন্ত্রীর মুখে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে অমিয় বাণী উচ্চারিত; কিন্তু যে তিস্তা সে তিস্তা একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে। সেসব বাণীর টানে কখনো তিস্তায় প্রবলবেগে জল আসছে (বন্যার প্লাবনে), কখনো, প্রায়শ তিস্তা খরায় মরুভূমিসদৃশ।

সেই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাল থেকে তিস্তা নিয়ে অনেক লেখাই তো পত্রস্ত্র হলো, আমার এবং অনেকের। সেসবের পরিণাম দেখে বেশ কিছুদিন তিস্তা নিয়ে আর লিখিনি। এরই মধ্যে এ বিষয়ে বাংলাদেশবান্ধব কয়েকটি লেখা, ভারতীয় সাংবাদিকের হাতে, বিশেষ করে সম্প্রতি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষার যুক্তি শুধু তিস্তা’ শীর্ষক নিবন্ধটি পড়ে কিছু লেখার কথা মনে হলো।

উল্লিখিত লেখাটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহু আলোচিত ভারত সফর উপলক্ষে রচিত। এর শিরোনাম থেকেই লেখক-সাংবাদিকের মূল বক্তব্য আঁচ করতে পারা যায়। তিনি এ ঐতিহাসিক সফর উপলক্ষে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের তরফে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশিত এক দীর্ঘ প্রতিবেদনের একরাশ ইতিবাচক দিক উল্লেখ করে তিস্তা সম্পর্কে যে ছোট্ট মন্তব্যটি করেছেন, তা বলাবাহুল্য অতীব তাৎপর্যপূর্ণ।

সৌম্য লিখেছেন : “হাসিনার সফরের আগে দীর্ঘ ছয় পৃষ্ঠার ‘ব্যাকগ্রাউন্ড পেপারে’র উল্লেখ করার একমাত্র কারণ দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে খরচ হয়েছে মাত্র ৯০টি শব্দ। এবং সেই শব্দগুলোর মধ্যে বিস্ময়জনকভাবে অনুপস্থিত তিস্তা। এই সফরে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে তেমন ইতিবাচক কিছু আশা করা যে ঠিক হবে না, সেটাই কি এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট করা হলো?”

অবশ্য এর দিন কয়েক আগে আরেক ভারতীয় সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল তাঁর ‘দিল্লির চিঠি’ কলামে (৩০.৯.২০১৯) লেখেন : ‘এবার শেখ হাসিনা ভারতে আসছেন বেশ কিছুদিন পর। বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন যে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে তিস্তা নিয়েও ঢাকা আলোচনা করবে। আমিও ভারতের বিদেশ মন্ত্রক থেকে যা জানতে পারছি তা হলো, বাংলাদেশ উত্থাপন করলে ভারতও তিস্তা নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত। তিস্তা চুক্তি এ সফরে ঘোষণা না হলেও এই চুক্তির পক্ষে ইতিবাচক লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করা দুই দেশের লক্ষ্য।’ বিষয়টি ভারতের দিক থেকে যে এত সহজ-সরল ছিল না, তার প্রমাণ মেলে বৈঠকে মোদির তিস্তাবিষয়ক একটি ছোট্ট বক্তব্যে।

তিন.

দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে এবারের দিল্লি সফরে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ ঐকমত্যে পৌঁছেছে। আনন্দঘন পরিবেশে দুই প্রধানমন্ত্রী তিনটি প্রকল্প উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা : ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে।’ ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশ্বে দৃষ্টান্ত।’ মোদির বক্তব্য : ‘বন্ধুত্বের লক্ষ্য কল্যাণ ও অগ্রগতি।’ আর ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম জয়শঙ্করের ঘোষণা : ‘বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় ভারত।’ মতামতটা শ্রী মোদিরও।

এমন এক কূটনৈতিক-রাজনৈতিক পরিবেশের চুক্তিগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ‘ফেনী নদী থেকে ভারতকে পানি দেবে বাংলাদেশ।’ ত্রিপুরার জন্য মানবিক বোধে পানীয় জলের ঘাটতি মেটানোর উদ্দেশ্যে। বিস্ময়কর যে তিস্তাহীন আলোচনায় ফেনীর পানি অগ্রাধিকার পেল।

অবশ্য একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ‘বৈঠকে বাংলাদেশ প্রায় ৯ বছর ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির প্রসঙ্গ তুলেছে। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা সব পক্ষের মত নিয়ে তিস্তা চুক্তি সই করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।’ ভালো কথা; কিন্তু কত দিন চলবে এ প্রক্রিয়া?

আমাদের প্রশ্ন : ‘সব পক্ষ মানে কারা? অনুমান করা চলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মমতাময়ী না হওয়া পর্যন্ত এ ঝুলন্ত অবস্থার অবসান ঘটবে না। পিংপং কূটনীতি একদা সফল হলেও সাম্প্রতিক ইলিশ-কূটনীতি বোধ হয় ব্যর্থতায়ই পর্যবসিত হবে। তবু বাংলাদেশের জনগণ তিস্তা সম্পর্কে আশা করে আছে তাঁর সদিচ্ছার।

এখানে আরো একটি প্রশ্ন কি অবান্তর যে ভারত-বাংলাদেশসংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো তো কেন্দ্রীয় শাসনভিত্তিক। এখানে রাজ্যের মতামত নেওয়ার উদাহরণ কি খুব একটা আছে? এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ আমলাতন্ত্রের হস্তক্ষেপ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার ছায়াপাত দেখতে পান। ভারতের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রীও তো একজন মেধাবী ও দক্ষ আমলা।

প্রাসঙ্গিক যৌথ বিবৃতি নিয়ে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও তিস্তা চুক্তি সম্পর্কে কিছুটা ধোঁয়াশার মধ্যেই বাংলাদেশের বেশির ভাগ দৈনিকগুলোর প্রতিবেদনে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন যে বাংলাদেশের জনগণ তিস্তা চুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। জবাবে পূর্বোক্ত চেষ্টার আশ্বাস ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির।

তবে এটা ঠিক যে আগেকার মতোই (জাতিসংঘে) আসামের এনআরসি প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বেগ নিরসনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবেই বলেছেন যে এ বিষয়ে উদ্বেগের কারণ নেই। অর্থাৎ তিনি বিষয়টি দেখবেন। এ কথায় কি আস্থা রাখা যাবে?

চুক্তিগুলোর মধ্যে জ্বালানি, বিনিয়োগ, বাণিজ্য, বন্দর ব্যবহার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন এ দেশীয় বিশেষজ্ঞরা। তবে ফেনী নদীর পানি সম্পর্কে সর্বজনীন প্রতিক্রিয়া অপেক্ষার বিষয়। কিন্তু তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষিত শ্রেণি থেকে সাধারণ মানুষ একাট্টা। তারা তিস্তায় ন্যায়সংগত পানি চায়। ভারতকে বাংলাদেশের এই আবেগের গুরুত্ব ও মনস্তাত্ত্বিক দিকটি বুঝতে হবে। মুখে যতই বলি না কেন, মৈত্রী তো একতরফা হয় না। একটি নদীর সমস্যা প্রায় এক দশক ঝুলে থাকাটা যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না। এর দ্রুত সমাধান চাই।

এ আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো যৌথ বিবৃতিতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে না এলেও বৈঠকে প্রকাশ্যে তিস্তা, রোহিঙ্গা ইত্যাদি ইস্যু বাংলাদেশ উত্থাপন করেছে। বাংলাদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে তা জানানো হয়েছে। তথ্য সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষালের। এখন অপেক্ষা।

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে