দীর্ঘদিন পর সম্মেলনের তারিখ ঘোষণায় আওয়ামী লীগের অন্যতম সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। নতুন কমিটিতে স্থান পেতে বিভিন্ন পর্যায়ে চলছে পদপ্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ। পছন্দের পদ পেতে তদবির করছেন দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে।
প্রতিদিনই দলটির বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও ধানমণ্ডির সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয় নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর থাকে। কিন্তু সংগঠনটির শীর্ষ দুই নেতৃত্বে কারা আসছেন সেটি কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
তবে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে যে নতুন মুখ আসবে এটি মোটামুটি নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে খুলে যেতে পারেন সাবেক ছাত্রনেতাদের ভাগ্য।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি পদ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে মোল্লা আবু কাওছারকে। যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর পরিণতি বরণ করতে হলো ক্ষমতাসীন দলের অপর সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছারের। তাকেও আজ স্বেচ্ছাসেবক লীগের শীর্ষ নেতার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ক্যাসিনোকাণ্ডে নাম আসায় তার বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেয়া হলো।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মোল্লা আবু কাওছারকে স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে বাদ দিয়েছেন বলে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন।
যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে বাদ দেয়ার পর মোল্লা কাওছারকেও যে পদচ্যুত করা হবে সেটি অনুমিতই ছিল সংগঠনটির নেতাকর্মীদের কাছে। তবে মোল্লা কাওছার পদচ্যুতি থেকে বাঁচতে মরিয়া ছিলেন। গত কয়েক দিন তিনি ক্ষমতাসীন দলের কয়েক নেতার কাছে ধরনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তার চাওয়া ছিল সম্মানজনক বিদায়। স্বেচ্ছাসেবক লীগের আসন্ন কাউন্সিলে সভাপতিত্ব করার সুযোগ চেয়ে দেনদরবার করে যাচ্ছিলেন মোল্লা কাওছার। কিন্তু তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলো।
সংগঠনটির বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ আগামী কমিটিতে থাকছেন না বলে শোনা যাচ্ছে। সংগঠনটির তৃতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি আছে—এমন সৎ ও দলের দুঃসময়ে মাঠে থাকা নেতাদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হবে। নেতাদের নানা অপকর্মে ভাবমূর্তির সংকটে পড়া সংগঠনকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে সত্যিকার অর্থেই ‘স্বেচ্ছাসেবক’ লীগ গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা স্বেচ্ছাসেবক লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথকে আর নেতৃত্বে রাখতে আগ্রহী নন। ফলে সভাপতি সম্পাদক দুই পদেই নতুন নেতৃত্ব খোঁজা হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের বর্তমান কমিটিতে বেশ কয়েকজন তরুণ, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তিসম্পন্ন দক্ষ নেতা রয়েছেন। তাঁদের মধ্য থেকেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হতে পারে। আবার সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্য থেকেও কাউকে বড় দায়িত্ব দেয়া হতে পারে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রথম সভাপতি। স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে তার বিশেষ প্রভাব রয়েছে। এবার সংগঠনটির সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কেমন নেতৃত্ব আসতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে বাহাউদ্দিন নাছিম গণমাধ্যকে বলেন, ‘যারা সৎ, যাদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে, যারা সাহসী ও দুঃসময়ে সংগঠনের জন্য কাজ করেছে, তাদের খুঁজে বের করে নেতা নির্বাচিত করা হবে। যারা দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংগঠনের জন্য কাজ করছে, তাদের মাঝ থেকেই অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতাদের সামনে আনা হবে।’
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন আসছে কি না জানতে চাইলে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘যথাসময়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলন হয়নি, অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে আগামী কমিটিতে নতুন নেতৃত্ব আসার সম্ভাবনাই বেশি।’
আগামী ১৬ নভেম্বর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় এবং ১১ নভেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর ও ১২ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। প্রায় সাত বছর পর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রায় ১৩ বছর পর। ফলে এ সম্মেলন ঘিরে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্রগুলো জানায়, তিন বছর মেয়াদি কেন্দ্রীয় কমিটি এরই মধ্যেই সাত বছর পার করে ফেলায় কেন্দ্রীয় শীর্ষ দুই নেতাকে আর নেতৃত্বে রাখতে আগ্রহী নন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। একজনকে তো অব্যাহতি দেয়াই হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতৃত্বে রয়েছেন। বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে তীব্র কোন্দলে জড়িয়েছেন পঙ্কজ। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই পঙ্কজের ওপর বিরক্ত। ফলে স্বেচ্ছাসেবক লীগে নতুন নেতৃত্ব অবশ্যম্ভাবী।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ত্যাগী ও যোগ্য ব্যক্তিদেরই এবার সুযোগ দেয়া হবে। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই, যাদের বয়স ৫০-এর বেশি নয়, যারা চাঁদাবাজি, ক্যাসিনোর মতো অবৈধ আয়ের সঙ্গে যুক্ত নন- তারাই কমিটিতে জায়গা পাবেন।
তিনি আরও বলেন, কে কার আত্মীয়, কে কোন বড় নেতার কাছের লোক, সেগুলো বিবেচনা করা হবে না। তিন বছর পরপর এই কাউন্সিল হওয়ার কথা। তাতে নতুন নেতৃত্ব আসে।
যারা খারাপ তারাও ভয় পায় যে, আমরা হয়তো আর আগামীতে হতে পারব না। সেজন্য নেত্রী (আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) এবার সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দুর্নীতির বিপক্ষে সঠিক নেতৃত্বের পক্ষে এটা যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।
জানা যায়, ছাত্রলীগের নেতারা রাজনীতির পরের ধাপে মূলত আওয়ামী যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। কিন্তু এই দুটি সংগঠনে দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ায় ছাত্রলীগের অনেক পরীক্ষিত নেতা এসব সংগঠনে ঢুকতে পারেননি।
অল্প কিছু নেতা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উপকমিটির সদস্য হলেও বাকি অনেকেরই পরিচয় এখনও কেবল সাবেক ছাত্রনেতা। ফলে এবারের সম্মেলনে শীর্ষ পদ ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবক লীগের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে ছাত্রলীগের পরীক্ষিত নেতারাই জায়গা পেতে যাচ্ছেন।
১৯৯৭ সালের তৎকালীন সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনকে আহ্বায়ক করে স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রথম কমিটি হয়। পরে ২০০২ সালে প্রথম কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হন বাহাউদ্দিন নাছিম, সাধারণ সম্পাদক হন পঙ্কজ দেবনাথ।
সর্বশেষ ২০১২ সালে মোল্লা মো. আবু কাওছারকে সভাপতি এবং পঙ্কজ দেবনাথকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি হয়েছিল। মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও ওই কমিটিই এখনও কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ও ঢাকার দুই শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হতে লড়াইয়ে অন্তত এক ডজনেরও বেশি নেতা রয়েছেন বলে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের বর্তমান চার সাংগঠনিক সম্পাদক খায়রুল হাসান জুয়েল, শেখ সোহেল রানা টিপু, সাজ্জাদ শাকিব বাদশা ও আবদুল আলীম বেপারী রয়েছেন কেন্দ্রীয় শীর্ষ পদের লড়াইয়ে।
এর মধ্যে টিপু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং সাজ্জাদ শাকিব বাদশা সাধারণ সম্পাদক। চারজনই বিএনপি জামায়াত জোট ও ১/১১ সরকারের আমলে ছাত্রলীগকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এছাড়া কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন সাচ্চু, সহসভাপতি মঈন উদ্দিন, মতিউর রহমান মতি, নির্মল রঞ্জন গুহ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, দফতর সম্পাদক সালে মোহাম্মদ টুটুল কেন্দ্রীয় পদের লড়াইয়ে আছেন।
এছাড়া মনোয়ার হোসেন বিপুল ও ইসহাক মিয়াও রয়েছেন আলোচনায়।
আবার বর্তমান কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথের পুনরায় শীর্ষ পদে থাকতে কোনো আপত্তি নেই।
জানতে চাইলে সোহেল রানা টিপু বলেন, যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে জনগণের কল্যাণে কাজ করবেন তাদেরই নেতৃত্বে আসা দরকার। আমরাও চাই- নেতৃত্ব পাওয়ার প্রধান মানদণ্ড হোক ক্লিন ইমেজ, ত্যাগী মনোভাব, সাংগঠনিক দক্ষতা।
খায়রুল হাসান জুয়েল বলেন- সততা, স্বচ্ছতা, কমিটমেন্ট এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে দলের জন্য সব সময় নিয়োজিত রেখেছি। ১-১১ এর সময় এক বছর জেল খেটেছি। তবে আমি মনে করি নেতৃত্বে যেই আসুক, তার যেন অবশ্যই সততা, স্বচ্ছতা, কনট্রিবিউশন এবং কমিটমেন্ট থাকে।
জানতে চাইলে মেজবাহ উদ্দিন সাচ্চু বলেন, যারা রাজপথে থেকেছেন, আন্দোলন করেছেন, তারা নেতৃত্ব আসুক। এতে সংগঠন যেমন শক্ত হবে; তেমনি জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতও শক্তিশালী হবে। সালেহ মোহাম্মদ টুটুল বলেন, আমরা চাই ত্যাগী, স্বচ্ছ ও ক্লিন ইমেজের নেতারা নেতৃত্বে আসুক।
সম্প্রতি রাজধানীর ক্যাসিনো কারবারে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে বিভিন্ন গণমাধ্যমের শিরোনামে আসেন মোল্লা কাওছার। সে কারণে তাকে আজ স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথও দীর্ঘদিন ধরে (২০০৩ সাল) সংগঠনটির নেতৃত্বে থাকায় সেখানেও এবার নতুন কাউকে জায়গা দেয়া হবে-এমনটি মোটামুটি নিশ্চিত।
এদিকে প্রায় এক যুগ পর স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখার সম্মেলন আগামী ১১ ও ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাজধানীর কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে।
সংগঠনটির ঢাকা মহানগর উত্তর শাখায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মনোরুল ইসলাম বিপুল, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইসহাক মিয়া ও মোহাম্মদপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক বাবু।
এর মধ্যে ইসহাক ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সভাপতি। বিপুল স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহানগরের নেতাদের মধ্যে বেশ সক্রিয়।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগে আলোচনায় রয়েছেন দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তারিক সাঈদ, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি কামরুল হাসান রিপন, দফতর সম্পাদক তৌফিকুল সোহাগ, ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আনিসুর রহমান আনিস ও আনিসুজ্জামান রানা প্রমুখ।