তফসিলি ব্যাংকের বিনিয়োগ-আমানত অনুপাত নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তবে এই নির্দেশনার বালাই নেই শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে। কয়েক বছর ধরে ব্যাংকটি আমানত সংগ্রহের তুলনায় বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এভাবে ঋণ বিতরণে ব্যাংকটি গ্রাহকঝুঁকি তৈরি করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মে বলা আছে, দেশে কার্যরত প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো সংগৃহীত মোট আমানতের মধ্যে সিআরআর ও এসএলআর বাবদ জমা রেখে সর্বোচ্চ ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থাৎ ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে সর্বোচ্চ ৮৩.৫০ টাকা ঋণ বিতরণ করতে পারবে। আর ইসলামী ব্যাংকগুলো ৮৯ শতাংশ অর্থাৎ ১০০ টাকা সংগ্রহ করলে সর্বোচ্চ ৮৯ টাকা ঋণ দিতে পারবে।
কিন্তু শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সীমা মানেনি। তারা ২০১৯ সালের জুন শেষে মোট আমনতের ৯৯.০২ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। এর প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদেরকে নির্দেশনা পরিচালনের জন্য তাগিদ দিয়েছে।
আর চলতি বছরের জুন শেষে এ ব্যাংকের মোট আমনত সংগ্রহ ছিল ১৮ হাজার ৬৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আন্তঃব্যাংক চ্যানেলের মাধ্যমে আসে ১৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। আর এ সময়ে ব্যাংকটি মোট ঋণ বিতরণ করেছে ১৮ হাজার ৪৮৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১৮ সালের জুন ভিত্তিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এ সময়ে শাহজালাল ব্যাংকের মোট আমানত ছিল ১৬ হাজার ১২ কোটি ৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে আন্তঃব্যাংক লেনদেন থেকে নেওয়া ২৪২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
এসময়ে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ করেছে ১৬ হাজার ৬৪৫ কোটি ৮ লাখ টাকা। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকটি আমানতের চেয়ে ৬৩৩ কোটি টাকা বেশি বা ১০৩.৯৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। এ কারণে ব্যাংকের আমানতকারীরা ঝুঁকিতে রয়েছে।
২০১৭ সালের জুন ভিত্তিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকটি ঝুঁকির মধ্য দিয়ে ঋণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম লঙ্খনের মধ্যে পড়ে। ২০১৭ সালের জুন শেষে ব্যাংকের মোট আমানত ছিল ১৩ হাজার ২২৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আর এ সময়ে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ করেছে ১৩ হাজার ৪৪৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা অর্থাৎ ২২১ কোটি টাকা বেশি বা ১০১.৬৭ শতাংশ দাঁড়ায় এডিআর রেশিও।
এদিকে ঋণ সম্পর্কিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন শেষে শাহজালাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১১৬১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, যা ২০১৭ সালের জুনে ছিল ৬৩৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। শতাংশীয় হিসাবে বৃদ্ধি ৮১ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
বছরভিত্তিক হিসাবে ২০১৭ সালের জুন থেকে ১৫২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা বেড়ে ২০১৮ জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৭৯২ কোটি ১১ লাখ টাকা, যা শতাংশীয় হিসাবে প্রায় ২৪ শতাংশ।
এ থেকে গত এক বছরে ৩৬৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা বেড়ে খেলাপি ঋণের প্রবৃদ্ধি ঘটে প্রায় দ্বিগুণ- ৫০ শতাংশ। চলতি বছরের জুন শেষে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১১৬১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর ঋণের ঝুঁকি বিবেচনা করে তার বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। চলতি জুন শেষে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১০০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শাহাজালাল ইসলামী ব্যাংক ঋণ আমানতের যে হার বাড়িয়েছে, তার যুক্তি দিচ্ছে ভিন্নভাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যা চাওয়ার জবাবে তারা বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে মুদ্রাবাজারে মেয়াদি ও তলবি আমানতের স্বল্পতার এবং আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে মেয়াদি আমানতের চাহিদা ও সুদ হার ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।’
‘ব্যাংকটি থেকে বলা হচ্ছে, এর পাশাপাশি গত বছরে অনুমোদন দেয়া ঋণ এবার বিতরণ করা হয়েছে। একই সাথে নন ফান্ডেড ঋণের একটি বড় অংশ ফান্ডেড হওয়ায় ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।’
এসব বিষয়ে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বক্তব্য নিতে কয়েক দফা মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তাকে পাওয়া যায়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আগ্রাসী ব্যাংকিং করার অভিযোগ উঠেছে কিছু কিছু ব্যাংকের বিরুদ্ধে। তারা যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করছে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু বিতরণকৃত এসব ঋণ আদায় না হওয়ায় খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আমানত না বাড়ায় বেড়ে যাচ্ছে তারল্য সঙ্কট। এ সঙ্কট মেটাতে আবার এসব ব্যাংক উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। আর কিছু কিছু ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এতে ব্যাংকিং খাতে দায় ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।