মানবপাচার মামলায় জামিন পেল কক্সবাজারের রামু উপজেলার কওমি মাদ্রাসাছাত্র শিশু আলাউদ্দিন (১২)। ওই মামলা থেকে শিশু আলাউদ্দিনকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ।
এ সময় আদালত শিশু আলাউদ্দিনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ও তো এখনও মানবই হতে পারেনি, মানবপাচার করবে কীভাবে?’
আদালতে আজ আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জামান আক্তার বুলবুল। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘একদম মাইনর (নাবালক) ছেলে। সর্বোচ্চ ১২ বছর হবে। আদালত তাকে আট সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়েছেন।’
শিশুর আইনজীবী জামান আক্তার বুলবুল বলেন, ঘটনা দেখানো হয়েছে ২০১৪ সালের। মামলা করেছে ২০১৮ সালে। কিন্তু এখন তার বয়স ১২ বছরের মতো।
গত বছর থেকে মানবপাচার মামলার আসামি হয়ে বিভিন্ন আত্মীয়ের বাড়িতে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল শিশু আলাউদ্দিন।
যে বয়সে বিদ্যাপীঠে গিয়ে পাঠে মননিবেশ করার কথা, সেই বয়সে ভয়ঙ্কর মানবপাচার মামলার ফেরারি আসামি আলাউদ্দিন। আলাউদ্দিন রামু উপজেলার চাকমারপুল এলাকার মৃত ইলিয়াসের দ্বিতীয় ঘরের রিজিয়া বেগমের সন্তান। রিজিয়া বেগমের সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে আলাউদ্দিন চতুর্থ।
স্থানীয় জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসার কওমি ইয়াজদাহুম বিভাগের ছাত্র সে।
২০১৮ সালে মানবপাচার মামলায় আসামি করা হয় ছোট্ট আলাউদ্দিনকে। মামলার এজাহারে তার বয়স দেখানো হয় ২২ বছর। এর পরই শিশুতোষ জীবন নষ্ট হয়ে যায় আলাউদ্দিনের। আজ এই আত্মীয়ের বাসায় তো কাল ওই আত্মীয়ের বাসায়। এভাবেই প্রতিদিন এখানে-সেখানে মামলা কাঁধে নিয়ে পালিয়ে বেড়ায় আলাউদ্দিন। মাদ্রাসায় যাওয়ার সুযোগই পায়নি এতদিন সে।
এদিকে মামলার খরচ চালাতে অসহায় ও অসমর্থ হয়ে পড়েন আলাউদ্দিনের মা রিজিয়া বেগম।উপায়ন্তর না পেয়ে আজ সোমবার সন্তানকে নিয়ে জামিন নিতে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন রিজিয়া বেগম।
রিজিয়া বেগম গণমাধ্যমকে জানান, আলাউদ্দিনের সৎভাইয়েরা শত্রুতা করে নিষ্পাপ ছেলেটির বয়স বাড়িয়ে মানবপাচার মামলা দিয়ে জীবন শেষ করে দিয়েছে।
তার অভিযোগ, সতীনের ছেলেরা আলাউদ্দিনকে ঢাকার মামলাবাজ সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। ওই সিন্ডিকেটের কাজ হলো মানবপাচারের মামলা সাজিয়ে নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসানো। তার পর সহায় সম্পদ কেড়ে নেয়া।
ঘটনার বিবৃতি দিয়ে তিনি বলেন, অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চালাই। ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই নেই আমাদের। আলাউদ্দিনের বাবা দুই বিয়ে করেন। প্রথম ঘরের স্ত্রীর বড় ছেলেদের সঙ্গে শত্রুতার জেরে আলাউদ্দিনকে মানবপাচার মামলায় আসামি করা হয়।
আপ্লুতকণ্ঠে রিজিয়া বেগম বলেন, ‘একবেলা ভাত নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাওয়াই আমি। ছেলেমেয়েরা যখন খায়, তখন আমি পেটে কাপড় বেঁধে রাখি যাতে আমার পেট উঁচু থাকে। সন্তানরা যাতে বুঝতে পারে যে, আমিও খেয়েছি। এমন অভাবের সংসারেও চোখ পড়েছে আমার স্বামীর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর সন্তানদের। তারা সম্পত্তির লোভে আমার নিষ্পাপ ছেলেটির বয়স বাড়িয়ে মানবপাচার মামলা দিয়ে জীবন শেষ করে দিয়েছে।’
আলাউদ্দিনের মা বলেন, ‘ছেলের মামলার খরচ চালানোর মতো টাকাও আমার হাতে নেই। আমি আর পারছি না, ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার!’
এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কিনা প্রশ্নে রিজিয়া বেগম অভিযোগ করেন, মামলার বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলায় গত ১৫ অক্টোবর আমার খুপড়িঘর ভেঙে দেয় সতীনের ছেলেরা। আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড়, থালাবাসন লুট করার পাশাপাশি ভাঙচুরও করে। ভয়ে আর আতঙ্কে বাড়িছাড়া হয়েছি আমরা।
মামলাটি কে করেছে প্রশ্নে রিজিয়া বেগমের সতীনের ছেলে রফিক জানান, হারুন নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে এ মামলা করা হয়েছে।
কে এই হারুন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাদের নির্দেশে মামলা করা হয়েছে, তাদের নাম বললে আমার ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারে।
মামলার বাদী নুরুল ইসলাম জানান, আমি কোনো আসামি চিনি না। ঢাকা থেকে যেভাবে মামলা সাজানো হয়েছে, সেভাবেই আসামিদের নামে মামলা দিয়েছি।
আলাউদ্দিনকে কেন মামলার আসামি করেছেন প্রশ্নে অবাক করা তথ্য দেন তিনি।
তিনি বলেন, শিশু আলাউদ্দিন যে এ মামলার আসামি তাও আমি জানি না। আমাকে বলা হয়েছে আলাউদ্দিনের বয়স ২২ বছর। ১২ বছরের শিশু আলাউদ্দিন তো দূরে থাক, কোনো আসামিকেই আমি দেখিনি।’
একই মামলার অপর আসামি মীর আহমেদ মিলনকে দেখে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ওনাকেও চিনি না।’
কেন এমন মিথ্যা মামলা করলেন প্রশ্নের জবাবে নুরুল ইসলাম জানান, ‘এমন সাজানো বাদী তিনি একা নন, শুধু কক্সবাজার জেলাতেই ২০ জনের মতো এমন বাদী আছেন। পাশের গ্রামের হারুনও এমন সাজানো মানবপাচার মামলার বাদী। ’
মামলা করলে এককালীন ও মাসিকভিত্তিতে একটি চক্র টাকা দেয় বলে জানালেন তিনি। এ মামলায় কত পেয়েছেন প্রশ্নে গণমাধ্যমকে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মামলা করে এক লাখ ২০ হাজার টাকা মতো পেয়েছি। তবে মীর আহমেদ মিলন ও শিশু আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা না চালাতে চাইলেও ওই চক্রের কারণে মামলাটি তুলতে পারছি না।’