অক্টোবর মাসের ২ তারিখ ছিল ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন। ভারতে এ বছর অক্টোবর মাসজুড়ে তাঁর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে। বিস্ময়ের কথা; ক্ষমতাসীন বিজেপি দলও এবার জাতির জনক হিসেবে গান্ধীর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করেছে। এ উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গে তারা ১৫ থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত গান্ধী দর্শন প্রচারের জন্য ছয় হাজার কিলোমিটারজুড়ে পদযাত্রার ব্যবস্থা করেছিল। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘গান্ধী সংকল্প যাত্রা’।
যা হোক, এটা নিয়ে আমি ঢাকার আরেকটি দৈনিকে আমার কলামে আলোচনা করেছি, এখানে তার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। আমার আজকের আলোচ্য বিষয় গান্ধী দর্শন এখন পর্যন্ত উপমহাদেশের রাজনীতিকে কতটা প্রভাবিত করছে। তাঁর দর্শনের ঘোরবিরোধী এবং তাঁকে হত্যাকারীদের দল বিজেপি পর্যন্ত আজ তাঁর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী পালন করেছে। এটা অনেকটা ব্রিটেনের টোরি পার্টির কার্ল মার্ক্সের জন্মদিন পালনের মতো, যা তারা কোনো দিন করবে না।
গান্ধী শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, ছিলেন একটি রাজনৈতিক দর্শনের জন্মদাতা। এটি অসাম্প্রদায়িক ও অহিংসার দর্শন। এই দর্শন সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। বিশ্বের বহু মনীষী, যেমন—রোমা রোঁলা, বার্ট্রান্ড রাসেল, বার্নার্ড শ, মার্টিন লুথার কিং তাঁর দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। গান্ধীজির নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বার্নার্ড শর মন্তব্য— ‘it is too dangerous to be too good.’ ‘ বেশি ভালো হওয়া খুবই বিপজ্জনক। অবশ্য গান্ধীজি টু গুড বা বেশি ভালো লোক ছিলেন কি না তা নিয়ে বর্তমানে বিতর্ক আছে।
গান্ধীর মৃত্যুর পর বিশ্বজুড়ে মার্ক্সবাদের প্রবল জোয়ারে একসময় মনে হয়েছিল, গান্ধী-দর্শন অচল এবং মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত একটি দর্শন। গান্ধীর নিজের দল কংগ্রেস নেহরুর নেতৃত্বে ক্ষমতায় এসে তাঁর অহিংসা নীতির অনুসারী থাকেনি। ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন অবসানের জন্য গান্ধীজির মূল রাজনৈতিক দর্শন—অহিংস অসহযোগ আন্দোলন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পুনরুজ্জীবিত করেন বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তার ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বাংলাদেশ বা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করার জন্য শেখ সাহেব নিরস্ত্র বাঙালিকে নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তার নাম ছিল অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলনের উদ্ভাবক গান্ধী। এই অহিংস অসহযোগ দ্বারা ব্রিটিশদের তেমন ঘায়েল করতে তিনি পারেননি। কারণ তাঁর কংগ্রেস দলেই অনেক বড় বড় নেতা ছিলেন, যাঁরা অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন না। যেমন—দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ। এমনকি রবীন্দ্রনাথও এই অসহযোগ আন্দোলনে সম্পূর্ণ সায় দেননি।
অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে সারা ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেননি গান্ধী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সশস্ত্র সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করা সম্ভব করেছিল। তাই বলা হয় এই আন্দোলনে বাংলাদেশের ‘চাপরাশি থেকে চিফ জাস্টিস’ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। গান্ধীজি বেঁচে থাকলে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের এই অভূতপূর্ব সাফল্য দেখে শেখ মুজিবকে আশীর্বাদ জানাতেন।
কিন্তু দর্শন হিসেবে বঙ্গবন্ধু অহিংসায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বদেশি আন্দোলনের এবং সুভাষচন্দ্রের ‘অস্ত্র দ্বারা শত্রুপক্ষকে আঘাত করার’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে তৈরি হও।’ তাঁরই নির্দেশে মুক্তি আন্দোলন সশস্ত্র যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।
মহাত্মা গান্ধীর সার্ধশততম জন্মবর্ষ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু গান্ধীজির অহিংসার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।’ আমার কাছে শেখ হাসিনার সম্পূর্ণ বাণীটি পৌঁছেনি। তাই এখানে তা নিয়ে আলোচনা করতে পারছি না। শুধু আমার বিশ্বাসটুকু বলতে পারি। আমার বিশ্বাস, অহিংস-দর্শনে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না, অহিংস আন্দোলনকে তিনি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাই বাংলাদেশের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল।
মহাত্মা গান্ধী নিজেও বলতেন, ‘ভারতবর্ষের মানুষের হাতে যদি অস্ত্র থাকত, তাহলে তিনি অহিংস আন্দোলনের কথা বলতেন না।’ বঙ্গবন্ধুও বাংলাদেশে সশস্ত্র বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথমে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে অস্ত্র ধারণে প্রস্তুত হওয়ার জন্যও জাতিকে ডাক দিয়েছিলেন। জাতি তাঁর ডাকে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম শুরু করে।
তাই বলা চলে গান্ধীজির কাছে অহিংসা ছিল দর্শন, বঙ্গবন্ধুর কাছে তা ছিল কৌশল। মহাত্মার অহিংসার দর্শন বিশ্বময় ছড়িয়েছে। এই দর্শনকে যিশু এবং বুদ্ধের অহিংসার দর্শনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। মার্টিন লুথার কিং পর্যন্ত তাঁর সংগ্রহশালায় গান্ধীজির ভাঙা চশমা ও লাঠি সযত্নে রেখেছেন। রোমা রোঁলা গান্ধীজিকে পরম শ্রদ্ধা করতেন। গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি গান্ধীজির পরম ভক্ত ছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি আন্দোলনে সশস্ত্র যুদ্ধের পথ গ্রহণ করেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন।
বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুও মহাত্মা গান্ধীকে অবশ্যই শ্রদ্ধা করতেন। ভারত ভাগ হওয়ার প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। এই দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য গান্ধীজি পশ্চিমবঙ্গে তাঁর বেলেঘাটা আশ্রমে আমরণ অনশন শুরু করেন। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি গান্ধীর অনশন ভাঙানোর জন্য বেলেঘাটায় যান। সঙ্গে যান তাঁর রাজনৈতিক শিষ্য শেখ মুজিব। শেখ মুজিবের হাত থেকে গ্লাসে শরবত পান করে তিনি অনশন ভঙ্গ করেন।
সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপর্যয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সমগ্র বিশ্বেই মনন ও দর্শনের ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা দেখা দেয়। গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের দানবের জন্ম হয়। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ তার কোলে আশ্রয় নিয়ে আবার বিশ্বে হত্যা, রক্তপাত, সংঘাত ও সংকটের সূত্রপাত ঘটায়। নব্য ফ্যাসিবাদের অভ্যুদয় ঘটে। এ সময় গান্ধীবাদের দিকে অনেকের দৃষ্টি পড়ে। একটি বৈশ্বিক মানবিক দর্শন দ্বারা বর্তমানের শূন্যতা পূরণের জন্য গান্ধীর অহিংসার দর্শনের দিকে অনেকের চোখ পড়ে। শুরু হয় বিশ্বে মহাত্মা গান্ধীর রাজনীতি ও দর্শনের নব মূল্যায়ন।
গান্ধীর সার্ধশততম জন্মবর্ষে বাংলাদেশেও তাঁকে যথাযথভাবে স্মরণ করা হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ভারতের সাম্প্রদায়িক সরকারও এই নেতার অসাম্প্রদায়িক দর্শন ও আদর্শের প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। ঘাতকের ছুরি মহাত্মাকে হত্যা করলেও তাঁর জীবনাদর্শ ও দর্শনকে যে হত্যা করতে পারেনি এটা তার প্রমাণ।
বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের দৈত্য মৃত্যুযন্ত্রণায় ভুগছে। কিন্তু একটি মানবতাবাদী বিশ্ব দর্শনের অনুপস্থিতিতে বিশ্ব ‘হিংসায় উন্মত্ত’। ফলে রেমেডি হিসেবে গান্ধীর অহিংস দর্শনের কথা অনেকেই ভাবছেন। কিন্তু শুধু অহিংসা ও শান্তির ললিত বাণী শুনিয়ে বিশ্বে আবার শান্তি ও মানবিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা যাবে, হিংসার দানবকে দমন করা যাবে—এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইছেন না। তবু বিশ্বে হিংসা ও অশান্তি দূর করার জন্য গান্ধী-দর্শনের কৌশলগত প্রয়োগের দরকার আছে। এই দর্শন দ্বারা শুধু ভারতের রাজনীতি নয়, বাংলাদেশে মুজিব-রাজনীতিও প্রভাবিত হয়েছে।
- আরও পড়ুন >> দিশাহারা মেনন ও সময়ের সাবধান বাণী
গান্ধী ঘাতকের গুলিতে নিহত হয়েও যেমন বেঁচে উঠেছেন, শেখ মুজিবও তেমনি ঘাতকের গুলিতে শহীদ হয়েছেন, তাঁর মৃত্যু হয়নি। তিনি আবার জীবিত মুজিবের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে জেগে উঠছেন। আগামী বছর (২০২০) দেশে এবং বিদেশে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের বিশাল আয়োজন তার প্রমাণ। দল-মত-নির্বিশেষে সব মানুষ তাতে যোগদান করেছে। প্রমাণিত হয়েছে গান্ধীর দর্শন এবং মুজিবের আদর্শ সময়ের পরীক্ষা পেরিয়েছিল।
লন্ডন, সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০১৯