হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের এক ট্রাস্টির নানা অপকর্ম এবং তার সঙ্গে লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সেই গোয়েন্দা প্রতিবেদন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমাও দেয়া হয়। তবে প্রতিবেদনটির কপি চলে যায় অভিযুক্ত ট্রাস্টি (কিশোরগঞ্জ) রিপন রায় লিপুর কাছে।
শুধু তা-ই নয় প্রতিবেদনটি যুক্ত করে রিপন রায় ওই গোয়েন্দা সংস্থাটির মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠান। সেখানে তিনি গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি ‘মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেন।
এ অবস্থায় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ঘটনাটি উল্লেখ করে গোয়েন্দা সংস্থাটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। সেখানে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে গোয়েন্দা প্রতিবেদন সুরক্ষায় ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন ফাঁস হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে এর সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আনিছুর রহমান একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রিপোর্টটি আনফরচুনেটলি তার (ট্রাস্টি রিপন রায়) হাতে চলে গিয়েছিল যেভাবেই হোক। তিনি (রিপন) গোয়েন্দা সংস্থাটির স্থানীয় উপ-পরিচালককে হুমকি-ধামকি দিয়েছেন বলেও শুনেছি। সংস্থাটি থেকে বিষয়টি আমাকে জানানোর পর আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি। তদন্তে প্রতিবেদনটি ফাঁস করার সঙ্গে যাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যেটুকু বুঝতে পারছি, এখান থেকেই রিপোর্টটি কেউ ফাঁস করে থাকতে পারে। তদন্ত শেষ হলে পুরোপুরি বুঝা যাবে বলে আশা করছি।’
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সংস্থা) মু. আ. হামিদ জমাদ্দার বলেন, ‘উপসচিব মো. সাখাওয়াৎ হোসেনকে বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তিনি কাজ করছেন। বিষয়টি (প্রতিবেদন ফাঁস) দুঃখজনক। আমরা রিপন রায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি রিপোর্টটি কোথা থেকে পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটি তার বাসায় কেউ ফেলে রেখে গেছে। বিষয়টি হাস্যকর।’
‘সরকারি গোপনীয় তথ্য ফাঁস, নিরাপত্তা হুমকি এবং গোয়েন্দা কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি প্রসঙ্গে’ শিরোনামে এক গোপনীয় প্রতিবেদনে গোয়েন্দা সংস্থাটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জানায়, “বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাটি থেকে পাঠানো ‘গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন’ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা বা কর্মচারীর মাধ্যমে ফাঁস হচ্ছে। ১৯৭৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা স্মারক অনুযায়ী সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গোপনীয়তা এবং কর্ম-পরিবেশ নিরাপদ রাখতে এ দফতর থেকে পাঠানো ‘গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন’ যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও হেফাজতের নির্দেশনা দেয়া হয়। গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন ফাঁস করার ফলে সংস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন এবং মাঠপর্যায়ে এ দফতরের নিয়োজিত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের কর্ম-পরিবেশ বিনষ্ট হওয়াসহ ব্যাপক নিরাপত্তাহীন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
এতে আরও বলা হয়, গোয়েন্দা সংস্থাটি থেকে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর গত ২৯ মে ‘কিশোরগঞ্জ জেলার হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি রিপন রায় লিপুর বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড ও তারেক রহমানের সঙ্গে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা থাকায় ট্রাস্টি হিসেবে পুনঃনিয়োগ না করা প্রসঙ্গে বিশেষ প্রতিবেদন’ শিরোনামে গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাঠানো হয়। পরে ধর্ম সচিব যুগ্ম সচিবকে (সংস্থা) উপস্থাপন করুন নির্দেশনার পর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কোনো অসাধু কর্মকর্তা/কর্মচারী রিপন রায় লিপুর কাছে গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন ফাঁস বা পাচার করে দেয়। ফাঁস করা এ গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কপি সংযুক্ত করে গত ১৩ জুন রিপন রায় সংস্থাটির মহাপরিচালকের কাছে একটি আবেদন দাখিল করেন।
আবেদনপত্রে তিনি সংস্থাটি থেকে পাঠানো গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি ‘মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন’ বলে উল্লেখ করেন এবং তিনি সংস্থাটির কিশোরগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালককে এ গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রেরণ করেছেন কি-না, জিজ্ঞাসা করেন। যা এ সংস্থার ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন করেছে এবং মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের নিরাপত্তাহীন পরিবেশ সৃষ্টিসহ কর্ম-পরিবেশ বিনষ্ট করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংস্থাটি থেকে পাঠানো গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন ফাঁস/পাচারের কারণে এ দফতরের বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। সরকারি গোপনীয় তথ্য বেহাত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত গোপনীয় তথ্য বেহাত বা স্বার্থান্বেষী পক্ষের কাছে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে বলে সংস্থাটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত সংস্থার কর্মকর্তা/কর্মচারীদের নিরাপত্তাহীন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত অত্র সংস্থার কর্মকর্তা/কর্মচারীদের কর্ম-পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। সংস্থাটির ভারমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতি সংস্থাটির আস্থাহীনতা তৈরির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
‘ধর্ম মন্ত্রণালয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনের গোপনীয়তা রক্ষা করতে ব্যর্থ’- প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করে আরও বলা হয়, সরকারি গোপনীয় তথ্যের সংরক্ষণ ও হেফাজতকরণ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের মাঝে স্পষ্ট রূপে দায়িত্ব অবহেলা রয়েছে বা অবৈধ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে তথ্য ফাঁস বা পাচার করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দেয়া গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করা প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনের সুপারিশে উল্লেখ করে সংস্থাটি।
সুপারিশে আরও বলা হয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ এবং সকল দফতরকে সংস্থাটি থেকে পাঠানো গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও হেফাজত করা এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন। সংস্থাটির মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে মাঠ প্রশাসনের সব দফতরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন- জানতে চাইলে হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি রিপন রায় লিপু বলেন, ‘আমি ফোনে কথা বলতে চাচ্ছি না, সরাসরি কথা বলতে চাই। এরপর বলেন, আমার সাথে তারেকের সম্পর্ক আছে, আপনার সঙ্গে খালেদা জিয়ার সম্পর্ক আছে- এটা তো মুখে বললে হবে না। গোয়েন্দা সংস্থা বলেন আর যাই বলেন, সঠিক তথ্য তো বের করতে হবে।’
হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব (উপসচিব) বিষ্ণু কুমার সরকার বলেন, ‘সর্বশেষ ট্রাস্টি বোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১৩ জুন। নতুন ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী ট্রাস্টিদের মেয়াদ তিন বছর।’
গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন হেফাজতের অনুরোধ
গোয়েন্দা সংস্থাটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ‘সরকারি গোপনীয় তথ্য ফাঁস, নিরাপত্তা হুমকি এবং গোয়েন্দা কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি প্রসঙ্গে’ একটি চিঠি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠানো হয়। সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও সংশ্লিষ্টদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে পাঠানো ‘গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন’ যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং হেফাজতের নির্দেশনা প্রদানের অনুরোধ জানানো হয় ওই চিঠিতে।
গত ৮ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সব মন্ত্রণালয়/বিভাগ, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠির বরাত দিয়ে বলা হয়, ‘গোপনীয় তথ্য ফাঁস, নিরাপত্তা হুমকি এবং গোয়েন্দা কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি-সংক্রান্ত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গোপনীয় প্রতিবেদন যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং হেফাজত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো।
যদিও এর আগে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে কয়েক দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছিল।