২০১৭ সালে ব্রিটেনে রেকর্ড সংখ্যক নারী রাজনীতিবিদ পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন। কিন্তু মাত্র দু’বছর পরে তাদের অনেকেই এখন নির্বাচনে অংশ নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কারণ এই সময়ের মধ্যে তাদের নানা ধরণের কটূক্তির এবং ভীষণ অমানবিক নিপীড়ন এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।
আসন্ন ১২ই ডিসেম্বর ব্রিটেনের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৫৭ জন এমপি ঘোষণা করেছেন যে তারা এবারের নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। তাদের মধ্যে ১৮ জনই নারী। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অফ কমন্সে ৬৫০ জন এমপির মধ্যে ৩২ শতাংশ বা ২১১ জন নারী- যা সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
তবে লিবারেল ডেমোক্র্যাট এমপি সারাহ ওল্লাস্টন বলেছেন যে, অবসর গ্রহণের বয়সে থাকা পুরুষদের তুলনায় কনজারভেটিভ পার্টি ছেড়ে যাওয়া এই নারীরা অনেক কম বয়সী এবং প্রতিনিধি হিসাবে কম সময় ব্যয় করেছেন। বেশ কয়েকজন হাই-প্রোফাইল নারীকে তাদের এমন সিদ্ধান্তের কারণে নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অ্যামনেস্টি ইউকের হিসাব অনুযায়ী, ব্রিটেনে সর্বশেষ নির্বাচনের সময় নারী এমপিরা ২৫ হাজারেরও বেশি আপত্তিকর টুইট পেয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি এসেছে লেবার পার্টির ডায়ান অ্যাবোটকে লক্ষ্য করে। তিনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী এমপি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পার্লামেন্টে নারীদের ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করেছেন লেবার এমপি রেচেল রিভস। তার মতে- গালাগালি, মৃত্যু এবং ধর্ষণের হুমকি ‘নারী এমপিদের জন্য নিত্যদিনের ঘটনা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এই সমস্যা পার্টির সীমা অতিক্রম করেছে।
রিভস বলেন, ‘আমি যখন আমার বইয়ের জন্য টেরিজা মের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তখন তিনি বলেছিলেন যে এরা হল সেইসব ছোকরা যারা প্রতি রাতে পানশালার কোণায় বসে নিজেদের বিয়ারের সাথে গজগজ করে, এখন তারা সোশ্যাল মিডিয়াতে সেই একই কাজ করতে পারছে’।
যারা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদের মধ্যে কনজারভেটিভ কালচার সেক্রেটারি নিকি মরগানও রয়েছেন। তাকে বেশ কয়েকবার হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এরমধ্যে এক ব্যক্তি অসংখ্য ফোন কল করেছে যিনি বারবার তাকে বলতেন যে তার দিন ফুরিয়ে আসছে।
মরগান ঘোষণা করেন যে তার পরিবারের উপর নির্যাতন এবং হুমকির স্পষ্ট প্রভাব থাকার কারণে তিনি আরও পাঁচ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবেন না। মরগানকে হুমকি দেওয়া ওই ব্যক্তিকে আগস্টে ১৮ সপ্তাহের জন্য কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর কারণে, আমি মনে করি এ ধরনের নিপীড়নের প্রকৃতি সেইসঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষ কতো দৃঢ়ভাবে ভাবে, সেটা আমি রাজনীতি শুরু করার পর গত প্রায় দশ বছরে ব্যাপকভাবে বদলে হয়েছে।’
বর্তমানে ব্রিটিশ রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় আবেগের জায়গা জুড়ে রয়েছে যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি। ২০১৫ সালের গণভোটে প্রায় ৯০ শতাংশ এমপি ব্রেক্সিটের বিপক্ষে ছিলেন, যেখানে ভোটাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করতে হবে।
লিবারেল ডেমোক্র্যাট এবং সাবেক টরি এমপি হেইডি অ্যালেন সাতজন ক্রস-পার্টি এমপিদের মধ্যে একজন ছিলেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন নারী ছিলেন, যারা তাদের ব্রেক্সিট অবস্থানের কারণে হুমকি দেয়া ইমেইল পেয়েছিলেন- তারা সবাই ছিলেন ইইউ এর সঙ্গে ব্রিটেনের থেকে যাওয়ার পক্ষে।
ওইসব হুমকি বার্তায় তার বাড়ি সম্পর্কে খুব বিস্তারিত তথ্য ছিল এমনকি আকাশ থেকে ধারণকৃত ছবিও ছিল। যার কারণে তিনি তার বাড়িতে প্যানিক অ্যালার্ম বসানোর পাশাপাশি সুরক্ষা জোরদার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
নিজ নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দাদের লেখা একটি চিঠিতে অ্যালেন বলেছিলেন: ‘যে কোনো পেশার কাউকেই হুমকি, আক্রমণাত্মক ইমেইল, রাস্তায় চেঁচামেচি, বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দোহাই দেয়া সহ্য করতে হবেনা অথবা বাড়িতে প্যানিক অ্যালার্মও বসাতে হবে না। অবশ্যই ধারণা করা যায় যে, জনগণের কাছ থেকে এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসবে কিন্তু কিছু ঘটনা প্রায়ই নিয়মিতভাবে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং যার প্রভাব খুবই অমানবিক’।
সাত এমপিকে হয়রানির অভিযোগে ‘হার্ড-ব্রেক্সিট, ডানপন্থী নেটওয়ার্ক’ এর সাথে জড়িত ৫১ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে ৪২ সপ্তাহের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
ব্রিটিশ রাজনীতিতে অন্যতম দুঃখজনক ঘটনা হল,লেবার এমপি জো কক্সের হত্যাকাণ্ড। ২০১৬ সালের জুনে ব্রেক্সিট গণভোটের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা ডানপন্থী মতাদর্শের এক ব্যক্তি জো কক্সকে খুন করেন। জো কক্স ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। তবে এই নিপীড়ন শুধুমাত্র যারা ইইউতে থেকে যেতে চান তাদেরকে টার্গেট করে হয়নি।
টরি ব্রেক্সিটায়ার আন্দ্রে জেনকিন্সকে এমন নানা আপত্তিকর আচরণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। ইমেইলে হুমকি থেকে শুরু করে, তার নির্বাচনী দপ্তরে আত্মহত্যা-সম্পর্কিত গ্রাফিতির মাধ্যমে তাকে যৌন বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে জেনকিন্স বলেছেন যে তিনি এখনও তার আসনের জন্য দাঁড়াবেন।
তার কথায়, ‘আমি এখানে একটি কাজ করতে এসেছি এবং আমি আমার এলাকাকে প্রতিনিধিত্ব করতে পছন্দ করি। যদি আমি হাল ছেড়ে দিতাম তাহলে আমি তাদেরকেও এভাবে জয়ী হতে দিতাম।’
পুলিশ ওল্লাস্টনকে পরামর্শ দিয়েছে যে তিনি যেন তার অবস্থান সম্পর্কে কিছু প্রচার না করেন, তিনি যেন তার নির্বাচনী এলাকার জনসভায় যাওয়া বন্ধ করে দেন। তবে তিনি বলেছেন যে, ‘আপনি হাল ছেড়ে দিয়ে এসব নিপীড়নের জবাব দিতে পারবেন না। আপনাকে এসব মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হবে’।
রিভস বলেছেন, নারী এমপিদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন এবং শত্রুতা নতুন কিছু নয়। তিনি ইতিহাসের কথা মনে করেন বলেন, ১৯১৯ সালে প্রথম নারী এমপি ন্যান্সি অ্যাস্টার কীভাবে তার আসনটি গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে যাওয়ার জন্য ন্যান্সি অ্যাস্টারকে তার চেম্বারের পুরুষ সহকর্মীদের ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপকে ধাক্কা দিতে যেতে হয়েছে।
রিভস বলেন, ‘তবে আমি মনে করি বর্তমানে যা ঘটছে তা দেখলে তিনি হতবাক হয়ে যেতেন। এখন এটা নিশ্চিত করার সময় এসেছে যে আমরা সাধারণ নির্বাচনে নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে এগিয়ে যেতে পিছ পা হবো না।’
- আরও পড়ুন >> ট্রাভেল পারমিট পেতে আবেদন করেছে খোকার পরিবার
হাউস অফ কমন্সের একজন মুখপাত্র বলেছেন, তারা সংসদ সদস্যদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করেছে এবং নিয়মিত পর্যালোচনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করছে। সূত্র: বিবিসি