বছর দুই-তিন আগে বৃহৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রে হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যায় কেজিপ্রতি আট টাকা। ‘বেড়ে যায়’ কথাটির পরিবর্তে বাড়ানো হয় কথাটাই যথার্থ। সমাজে আলোড়ন। কারণ চাল অর্থাৎ ভাত শ্রেণি-নির্বিশেষে বাঙালির প্রধান খাদ্য। বলতে হয় প্রিয় খাদ্য। যুক্তিসংগত ভিত্তিতে ভাতের বিকল্প অনুরূপ পুষ্টির উপাদান খাওয়ার পরামর্শ দিলে বাঙালির মস্তিষ্কে উত্তাপ-উত্তেজনা বাড়ে। একবার ষাটের দশকে এ ধরনের কথা বলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব মহা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন।
সেই চালের দাম অযৌক্তিক বাড়ার অর্থ মধ্যবিত্ত থেকে সর্ব নিম্নবিত্ত তথা শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক বিচারে মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা। হয়তো তাই অবস্থাদৃষ্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য : ‘চাল নিয়ে চালবাজি চলছে।’ দৈনিক পত্রিকাগুলোতে অনেক লেখালেখি, টিভিতে টক শো। সরকার বিব্রত। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক শেষে চালের দাম কমানো হলো কেজিপ্রতি দুই টাকা। অর্থাৎ আতরওয়ালার ভাষায় ‘ছয় টাকা নাফা হ্যায়’। আতরের গল্প আপাতত মুলতবি থাক।
জয় হলো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটেরই। আমার বড় বিস্ময়—এত বড়, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু নিয়ে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো কোনো প্রতিবাদী আন্দোলনে নামেনি। শ্রমজীবী জনতার স্বার্থবিরোধী ঘটনাটিও তাদের জন্য কোনো রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়নি। এমনই তাদের শ্রমিক-কৃষকবান্ধব রাজনীতি! এবারও দেখছি তাদের একই রকম মনোভাব, একই ধারার রাজনীতি।
এবার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বেছে নিয়েছে পেঁয়াজ নামক রান্নাঘরের একটি অপরিহার্য উপাদানকে। যা মধ্যবিত্ত থেকে শ্রমিক-কৃষক-দিনমজুর সবাইকে স্পর্শ করে। ভাতের সঙ্গে সুস্বাদু কিছু তরকারি না থাকলে শ্রমজীবীদের জন্য পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ তো আছে। তাতেই ক্ষুধার নিবারণ। অথচ এ দুটোই দামে নাগালের বাইরে।
পেঁয়াজের হঠাৎ দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে আবারও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া—‘রাঁধুনিকে পেঁয়াজ ব্যবহার করতে মানা করে দিয়েছি।’ কিন্তু তাতে তো সমস্যার সমাধান হওয়ার কথা নয়। আমাদের ব্যবসায়ীদের মুনাফাবাজি এই পরোক্ষ বক্তব্যে বন্ধ হওয়ার নয়। এবং তা হয়নি। গুদামে-মোকামে সত্যিই কি পেঁয়াজের ঘাটতি ছিল? শুরুতে ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানির বিশেষ ঘোষণার সুযোগ নেয় মুনাফাবাজ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।
এক লাফে পেঁয়াজের দাম ৪০-৪৫ থেকে খুচরা বাজারে প্রথমে ৮০ টাকা, পরে শত টাকা ছাড়িয়ে গেল। খাদ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীর বিবৃতি কোনো কাজে এলো না। একপর্যায়ে কাগজে খবর—মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আসছে, কিন্তু বাদ সাধছে বিশেষ মহল। এরপর ভারত থেকে যখন জরুরি ব্যবস্থায় ৮০ ট্রাক পেঁয়াজ এলো, তা বিন্দুমাত্র প্রভাব রাখেনি পেঁয়াজের বাজারে। বৃথাই ছোটাছুটি পেঁয়াজ আমদানিকারকদের।
দুই.
অবাক হয়ে লক্ষ করছি, সংবাদপত্রের কলামে পেঁয়াজ নিয়ে মাতামাতি সত্ত্বেও পেঁয়াজের ঝাঁজ কমছে না। দামের ঝাঁজ বেড়েই চলেছে। আবার বৃহৎ ব্যবসায়ী থেকে খুচরা ব্যবসায়ী সবার থলি বা বস্তা মুনাফার সোনা-রুপায় ক্রমেই দিনের পর দিন ফুলে-ফেঁপে উঠছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোনো বিকার আছে বলে মনে হচ্ছে না।
একটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম : ‘পেঁয়াজ সিন্ডিকেটে জিম্মি পুরো দেশ’। রিপোর্টে বলা হয়েছে : ‘দেড় মাস আগে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৫০ টাকা। চার ধাপে দাম বেড়ে তা এখন ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অথচ নতুন করে পেঁয়াজের আমদানি খুবই সামান্য। ভারতের বাজারের দোহাই দিয়েই এ দাম বাড়ানো হয়েছে।’
এ সংবাদ থেকে একটি ইঙ্গিত স্পষ্ট যে গুদামে বা বাজারে পেঁয়াজের ঘাটতি সামান্য। সে ঘাটতি পূরণে জরুরি ভিত্তিতে আমদানির ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। যা হচ্ছে সবই মুনাফাবাজির ষড়যন্ত্র বৃহৎ ব্যবসায়ীদের। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কি কেউ নেই? ‘শিগগিরই দাম কমবে’ বলে দায়মুক্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এসব দেখেশুনেই বোধ হয় মেজাজ খারাপ সাংবাদিকদের। কারণ পেঁয়াজের ঝাঁজটা তাঁদের রান্নাঘরেও লাগছে। হয়তো তাই এমন সংবাদ-শিরোনাম : ‘পাগলা পেঁয়াজ খেপেছে’। টিসিবির তৎপরতার কোনো প্রভাব নেই খুচরা বাজারে। একসময় শোনা গেল, পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু তার কোনো প্রভাব নেই খুচরা বাজারে।
আরো একটি দৈনিকে ক্ষুব্ধ সংবাদ শিরোনাম : ‘পেঁয়াজের বাজার লাগামহীন’। আমরা কি জানতে পারি লাগামটা কার হাতে? জবাব সবারই জানা। সাংবাদিক থেকে রাজনীতিমনস্ক মানুষ মাত্রেরই। লাগামটা বাণিজ্যমন্ত্রীর হাতে নয়, পূর্বোক্ত সিন্ডিকেটের হাতে। তাদের মুনাফাবাজির স্বার্থে। সে মুনাফার কিছু জোটে খুচরা ব্যবসায়ীদেরও। অসহায় শুধু ক্রেতাসাধারণ, অর্থাৎ সাধারণ শ্রেণির ক্রেতা।
আর পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির ‘পাগলা’ রহস্য জানা আছে বলেই একাধিক সংবাদপত্রে প্রায়ই একই রকম সংবাদ শিরোনাম : ‘সিন্ডিকেটের কবলে পেঁয়াজের বাজার’। আমাদের পূর্বোক্ত বক্তব্যই এখানে সংবাদ ভাষ্য : ‘ভারত থেকে রপ্তানি বন্ধের খবরের পরদিনই বেসামাল ‘পেঁয়াজের ব্যবসায়ীরা’। অন্যদিকে বাণিজ্যসচিবের বক্তব্য : ‘মজুদ পেঁয়াজে আগামী দুই মাস ভালোভাবে চলবে। বাজার অস্থির করলে কঠোর ব্যবস্থা।’
বাজার তো অস্থির হয়েই আছে। পাগলা ঘোড়ার মতো লাফাচ্ছে পেঁয়াজের বাজার দাম বাড়ানোর বাড়াবাড়িতে। কর্তৃপক্ষ কেউ বলছে, ‘এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি’। আর এমন আলামত দেখেই একটি দৈনিকে চমকপ্রদ শিরোনাম : ‘ডিম, আপেলকে ছুঁয়ে বাড়ল পেঁয়াজের ঝাঁজ’। ছোট শিরোনাম : ‘পেঁয়াজের দাম বাড়ছেই’।
পূর্বোক্ত সতর্কবাণী এবং তার পরও পেঁয়াজের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ভুক্তভোগী মাত্রেরই প্রশ্ন : কী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বাজার সুস্থির করতে? যদি নেওয়া হয়ে থাকে তাহলে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম কমছে না কেন। বরং তা ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। তাহলে কি বুঝতে হবে বাজারের ওপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই?
পেঁয়াজ রপ্তানি নিয়ে ভারতের এক ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় যদি পেঁয়াজের দাম রাতারাতি আকাশমুখী হতে পারে, তা হলে ‘৬০ হাজার টন পেঁয়াজ আসছে’ এমন আশাপ্রদ সংবাদ সত্ত্বেও পেঁয়াজের দাম কমছে না কেন, কি পাইকারি, কি খুচরা বাজারে। কেন পেঁয়াজের বাজারে চলবে নিয়ন্ত্রণহীন নৈরাজ্য? কেন আমাদের পড়তে হবে এমন সংবাদ শিরোনাম : ‘পেঁয়াজের বাজারে নৈরাজ্য, কেজি ছাড়াল ১২০ টাকা’। তাদের মন্তব্য : ‘সরকারি নজরদারির অভাব’।
তিন.
ভাবা যায়, এক কেজি পেঁয়াজের দাম ১২০ টাকা। ক্ষুব্ধ এক আটপৌরে ক্রেতার মন্তব্য : ‘২০০ টাকা কেজি না হওয়া পর্যন্ত দাম বাড়া বন্ধ হবে না। এবার পেঁয়াজ কেনা বন্ধ করতে হবে।’ এতসব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও সরকার কিভাবে নির্বিকার থাকতে পারে, এটাই আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। তাহলে কি ভাবতে হবে যে ব্যবসায়ী-মুনাফাবাজ সিন্ডিকেট সরকারের চেয়েও শক্তিমান? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য আছে।
প্রকৃতপক্ষে দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা এবং উৎপাদন, পেঁয়াজ আমদানি ইত্যাদি সূত্রের হিসাব-নিকাশ করে দেখলে একটি অবাঞ্ছিত নগ্ন সত্যই প্রকাশ হয়ে পড়ে। আর তা হলো বৃহৎ ব্যবসায়ীদের অস্বাভাবিক মুনাফাবাজির লোভে বাজারে কথিত যে সংকট বা ঘাটতি বা অস্থিরতা—সবই কৃত্রিম, পরিকল্পিতভাবে তৈরি সিন্ডিকেটের হাতে। স্বভাবতই সিদ্ধান্তে আসতে হয়, মূল্যবৃদ্ধিটাও কৃত্রিম, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি।
এ সত্যটা সরকারের অজানা থাকার কথা নয়। এর আগে চালের বাজার যে অন্যায্য মুনাফাবাজির উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল সেই অপরাধের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই প্রতিবছর কোনো কোনো অতি আবশ্যক খাদ্য উপাদানকে জিম্মি করে সাধারণ মানুষকে আর্থিক সংকটে ফেলে মুনাফাবাজ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।
আমরা এটাও দেখেছি, প্রতিবছর ঈদ উৎসব উপলক্ষে কোনো নির্দিষ্ট অপরিহার্য খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যায়। ঈদের আগে আমরা শুনতে পাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সতর্কবাণী—যাতে কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো না হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। দাম ঠিকই বাড়ে, অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়ে।
কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো বৃহৎ ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেটের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে কি? পেঁয়াজের এই যে খবর অনুযায়ী এত আমদানি সত্ত্বেও দাম সেই আকাশছোঁয়া—কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি? একটা সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে : ‘গুদামে পেঁয়াজ মজুদ থাকার পরও বিক্রি করছেন না আমদানিকারকরা। শুধু হুঁশিয়ারি না দিয়ে বাজারে অভিযান চালানো দরকার।’ সরকার কি এজাতীয় সুপরামর্শে পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল করতে পদক্ষেপ নেবে? নাকি চলবে পেঁয়াজের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি? চলবে সিন্ডিকেটের পেট না ভরা পর্যন্ত?
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী
- আরও পড়ুন >> দরকার রটনা-ঘটনার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ