ট্রেন দুর্ঘটনা : বাবা-মাকে হাসপাতালে রেখেই আদিবার লাশ দাফন

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি

শিশু আদিবার লাশ দাফন
ছবি : সংগৃহিত

সোমবার দিবাগত রাতে বাবা-মার সাথে শিশু আদিবা উদয়ন ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল। হঠাৎ রাত পৌনে ৩টার দিকে সিলেট-চট্টগ্রাম পথের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনের ক্রসিংয়ে আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ও তূর্ণা নিশীথার মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে শিশু আদিবা আক্তার ছোঁয়াসহ অন্তত ১৬ জন নিহত হন।

ছোঁয়ার নিথর দেহ কয়েক ঘণ্টার জন্য ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হাসপাতালের লাশ ঘরে। আর ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তার বাবা সোহেল মিয়া ও মা নাজমা বেগম। তার গ্রামের বাড়ি বানিয়াচং উপজেলার বড় বাজার এলাকায়।

universel cardiac hospital

জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে আসা হয় ছোঁয়ার নানা বাড়ি সৈদারতুলা এলাকায়। বরই পাতার গরমজলে গোসল করানো পর মঙ্গলবার রাত প্রায় ৯ টায় পারিবারিক কবর স্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। কিন্তু গুরুতর অসুস্থ থাকায় চিরনিদ্রায় যাওয়া আদরের ছোঁয়ার সাথে শেষ দেখা হলো না তার বাবা-মায়ের।

জানাজায় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেমসহ হাজার হাজার মানুষ। সকলের চোখে মুখেই ছিল বিষাদের ছায়া। এ বিষয়টি যেন সবার মনে বেশি আঘাত করেছে। ছোঁয়ার মৃত্যুতে হবিগঞ্জজুড়ে শোকের ছায়া নেমেছে।

পঙ্গু হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সাধ্যমতো তাদের (নাজমা বেগম ও সোহেল মিয়া) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ছোঁয়ার বাবা-মা হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত রয়েছে।

মামা মো. জামাল মিয়া বলেন, ছোঁয়ার বাবা সোহেল মিয়া ও মা নাজমা বেগমের সঙ্গে উদয়ন এক্সপ্রেসে করে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল। পথে দুর্ঘটনা হলো। তাদের আর গন্তব্যে যাওয়া হলো না। ছোঁয়াকে যেত হলো এ পৃথিবী ছেড়ে। আর তার বাবা-মার অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাদের পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব দৃশ্য মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। অবশেষে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে এসে নিজ হাতে ছোঁয়াকে দাফন করেছি।

এদিকে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বহুলা গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আলমগীর আলম তার একমাত্র ছেলে সন্তান ইয়াসিনকে কোলে বসিয়ে যাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম। দুর্ঘটনার সময় তিনি ছিটকে পড়ে গুরুতর আহত হন। যখন জ্ঞান ফিরে তখন তিনি খুঁজতে থাকেন আদরের সন্তান ইয়াসিনকে। উদ্ধারকারীরা আলমগীরকে নিতে চাইলেও ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে তিনি খুঁজতে থাকেন ইয়াসিনকে।

দুই ঘণ্টা পর উদ্ধারকারীরা ইয়াসিন হাসপাতালে আছে বললে তিনি উদ্ধারকারীদের সাথে যান হাসপাতালে। পরে যখন জানতে পারেন ইয়াসিন আর নেই। তখন ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে আর বুকে পাথর বেঁধে তিনি হাসপাতাল থেকে চলে আসেন ছেলেকে দাফন করতে।

ইয়াসিন ছিল বহুলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র। সেই স্কুলের সামনেই হাজার হাজার জনতার উপস্থিতিতে হয় জানাজা। পরে বাড়ির পাশেই দাফন করা হয় ইয়াসিনকে। আলমগীর আলম এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি। তিনি কান্না করে বলেন, এর চেয়ে আমার নিজের মৃত্যু হলে ভালো হতো। আমি এক বছরের মধ্যে বাবাকে হারালাম, একমাত্র ছেলেকে নিজ হাতে দাফন করলাম। আমার ইচ্ছা ছিল আমার ছেলে বড় হয়ে মাওলানা হবে এবং আমার জানাজা পড়বে।

হবিগঞ্জের নিহত আদিবা ও ইয়াসিনসহ আট জনেরই দাফন সম্পন্ন হয়েছে। জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি আলী মো. ইউসুফ এর দাফন মঙ্গলবার বিকেলে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামে সম্মন্ন হয়। চুনারুঘাট উপজেলার উলুকান্দি গ্রামের ফটিক মিয়ার ছেলে রুবেল মিয়া (২০) এর দাফনও হয় ওই দিন বিকেলে।

ওই উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের আবুল হাসিম মিয়ার ছেলে সুজন মিয়া (৩০) ও তার খালা রাজারবাজার গ্রামে কুলসুমা বেগম (৪৫) এর দাফন সম্পন্ন হয় মঙ্গলবার সন্ধ্যায়।

বানিয়াচং উপজেলার মুরাদপুর গ্রামের আইয়ূব হোসেনের ছেলে আল-আমিন (৩৫)-এর দাফন হয় মঙ্গলবার রাতে। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার সৈয়দাবাদ গ্রামের আজমত উল্লার পুত্র রিপন মিয়ার দাফন সম্পন্ন হয় মঙ্গলবার রাতে।

আহত ২৪ জন আছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল নিহতের পরিবারকে প্রদান করা হয়েছে ১৫ হাজার করে টাকা। আহতদেরকেও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে