এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে যে দুই ধাপ বাকি

মত ও পথ রিপোর্ট

এ টি এম আজহারুল ইসলাম
জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম। ফাইল ছবি

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের দণ্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এখন জামায়াতের এই কেন্দ্রীয় নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে বাকি থাকল দুটি ধাপ।

নিয়ম অনুযায়ী, আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে পারবেন তিনি। রিভিউ খারিজ হলে শেষ সুযোগ হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ পাবেন এটিএম আজহারুল।

universel cardiac hospital

সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলামের রায় বহাল থাকায় তার দণ্ড কার্যকরে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার অপেক্ষা এখন।

রায় প্রকাশের পর ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ নিষ্পত্তির পর ট্রাইব্যুনাল বিচারিক আদালত থেকে তার মৃত্যুপরোয়ানা জারির পর মার্সি পিটিশন বা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রক্রিয়াটি এর মধ্যে বিদ্যমান।

যদিও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের জানান, রায় লিখেই বিচারপতিরা এটিএম আজহারুল ইসলামের দণ্ড ঘোষণা করেছেন। এখন রায় প্রকাশের অপেক্ষা। তবে, এটাও দেখার পালা যে, রায় প্রকাশের পর আসমিপক্ষ রায়ের রিভিউ আবেদন করবেন কি-না? রিভিউ করার পর তা নিষ্পত্তি এবং রিভিউ নিষ্পত্তির পর পরোয়ানা জারি করবেন ট্রাইব্যুনাল। পরে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিধান রয়েছে। এর পরপরই দণ্ড কার্যকর হবে।

রিভিউ নিষ্পত্তি হলে সরকারের সিদ্ধান্তে কারা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে শুরু হবে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের তোড়জোড়। অবশ্য শেষ আইনি সুযোগ হিসেবে এটিএম আজহারুল ইসলাম তার অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার আবেদন জানাতে পারবেন। সেটি না করা হলে বা প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হলে তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানোর ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা থাকবে না।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী রিভিউর প্রক্রিয়া তুলে ধরে বলেন, আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রিভিউ আবেদনের জন্য ১৫ দিন সময় পাবেন আজহার। এ সময়ের মধ্যেই তাকে রিভিউ আবেদন করতে হবে। রিভিউ আবেদনে যদি দণ্ড বহাল থাকে, তাহলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা বা প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন তিনি। তবে এক্ষেত্রে তাকে অপরাধ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চাইতে হবে।

তিনি বলেন, শেষপর্যন্ত যদি প্রাণভিক্ষার আবেদনও খারিজ হয়, তাহলে সরকার যেকোনো দিন দণ্ড কার্যকর করতে পারবে। কারাবিধির নিয়ম হলো, ২১ থেকে ২৭ দিনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হয়। তবে মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য নয়। এখানে সরকার যখন খুশি দণ্ড কার্যকর করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে জারি করা মৃত্যুপরোয়ানা কারাগারে পাঠানো হবে। এ রায়ের তথ্য জানিয়ে তাকে পরোয়ানা পড়ে শোনানো হবে।

রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান, যেহেতু আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে সেহেতু তার দণ্ড কার্যকর করা যাবে। তবে, ফাঁসি কার্যকরের বিষয়ে আজহারুল ইসলামের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন জানান, আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর তারা রায়ের রিভিউ পুনর্বিবেচনার আবেদন করবেন। রিভিউ নিষ্পত্তির পর দণ্ড কার্যকরের বিষয়।

এরপর জেল কোড অনুযায়ী আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কি-না এবং রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করবেন কি-না, তার ওপর ফাঁসি কার্যকর নির্ভর করবে- যোগ করেন তিনি।

জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাসহ অন্যান্য রায় বাস্তবায়নের আগে পালন করে আসা প্রক্রিয়াগুলো এ রায়ের ক্ষেত্রেও দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকছে।

জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলামের রায়ের পর তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, তারা এ রায়ে সন্তুষ্ট নন। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে ‘অবশ্যই’ রিভিউ আবেদন করবেন। জামায়াতের এ নেতা একাত্তর সালে ১৮ বছর বয়সী ছিলেন। তিনি সেসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। শুনানিতে আজহারুল ইসলাম ‘নির্দোষ’ বলে দাবি করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।

অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আসামিপক্ষের সকল আইনজীবীই রায়ের পর বলেছিলেন, তিনি নির্দোষ। কিন্তু আদালতে ঠিকই প্রমাণ পেয়েছে যে, তিনি দোষী। তাই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আজহারসহ অন্যান্যদের ফাঁসির রায় হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আজহারুল ইসলাম ‘এখন অপরাধী’।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রায়ের সম্পূর্ণ অনুলিপি পেলে তারা চাইলে রিভিউ করতে পারেন। মামলায় রিভিউয়ের সুযোগ রয়েছে। তবে, আমার মনে হয় না, এর মাধ্যমে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। কারণ রিভিউ আপিলের সমকক্ষ নয়। এটাতে কেবল বড় কোনো ভুল হলে সেটা ধরিয়ে দেয়া যেতে পারে।

আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন আরও বলেন, ‘চারজন বিচারকের ভেতরে তিনজন একমত হয়ে ফাঁসি বহাল রেখেছেন, আরেকজন দ্বিমত পোষণ করেছেন। এরপর আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে রিভিউ করব, আমরা আশাবাদী যে রিভিউতে অন্তত ফাঁসির আদেশটা থাকবে না।’

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে। ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, যাতে ৪:১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আসামিকে মৃত্যু পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়।

প্রায় আড়াই মাস পর ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। অনুলিপি পাওয়ার পর ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। দুই পৃষ্ঠার ওই ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ খামে ভরে লাল সালুতে মুড়ানো হয়। পরে তা পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে।

১০ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কথা থাকলেও আসামিপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের (তৎকালীন) চেম্বার জজ আদালত রাতে এক আকস্মিক আদেশে ফাঁসি কার্যকর স্থগিত করে আদেশ দেন। ওই রাতেই কাদের মোল্লার পক্ষে তার আইনজীবীরা আপিল বিভাগের রায়ের রিভিউ পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন।

রিভিউ আবেদনে রায়ের পুনর্বিবেচনা চাওয়া হয় এবং একই সঙ্গে রায় পুনর্বিবেচনা করে কাদের মোল্লার খালাস চাওয়া হয়। এরপর ১১ ও ১২ ডিসেম্বর আসামিপক্ষের আবেদনের শুনানি করে তা নাকচ করে দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।

১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে কাদের মোল্লার সঙ্গে দেখা করেন তার পরিবারের সদস্যরা। রাত ১০টা ১ মিনিটে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ‘রিভিউয়ের সুযোগ’ রয়েছে কি-না, সেই প্রশ্ন সামনে আসে কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায়ের পর। এর মধ্যেই ২৫ নভেম্বর কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাতেও সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া রায়ের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা যাবে বলে মতামত দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

এতে বলা হয়, “আসামি ও রাষ্ট্র- দুপক্ষই ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে রায়ের নির্ভরযোগ্যতায় ‘খাদ আছে’ বা ‘বিচার-বিভ্রাটের’ আশঙ্কা আছে বলে মনে করলেই আদালত তা পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রহণ করবে।”

সেখানে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন অনুযায়ী দণ্ডিতদের ক্ষেত্রেও আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন গ্রহণযোগ্য (মেনটেইনেবল) হবে। তবে, রিভিউ আবেদন আপিল আবেদনের সমকক্ষ হবে না।’ কাদের মোল্লার রিভিউ খারিজের রায়ে আপিল বিভাগ বলেছিলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে আসামি সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পাবেন। তবে, ক্ষমা চাওয়ার জন্য কারাবিধিতে বেধে দেয়া সাত থেকে ২১ দিনের সময়সীমা এ মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আসামি ক্ষমা চাইলে তার নিষ্পত্তির আগে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না।’

কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ গ্রহণ করেননি। এ কারণে রিভিউ খারিজের দিনই তার ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল।

গত ৩১ অক্টোবর জামায়াতের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং একাত্তরে ইসলামী ছাত্রসংঘের জেলা কমিটির সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর রংপুরের কমান্ডার এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ এক মিনিটে রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেন। আপিল আংশিক মঞ্জুর হলেও তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।

সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন রংপুর অঞ্চলে অর্থাৎ বৃহত্তর রংপুরে গণহত্যা চালিয়ে ১৪ শ’র বেশি মানুষকে হত্যা, বহু নারীকে ধর্ষণ ও অপহরণ, নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হয় এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে।

প্রায় পাঁচ বছর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে তিনটি অভিযোগে আজহারের মৃত্যুদণ্ড এবং ধর্ষণসহ অপর দুই অভিযোগে মোট ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আপিলের রায়েও রংপুর অঞ্চলে গণহত্যা ও হত্যার তিন ঘটনায় তার মৃত্যুদণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতের ভিত্তিতে বহাল থাকে।

অপহরণ ও আটক রেখে নির্যাতনের আরেকটি ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের দেয়া পাঁচ বছরের সাজা এবং ধর্ষণের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে আজহারের ২৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হলেও এ অভিযোগ থেকে তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের মতের ভিত্তিতে খালাস দেন আপিল বিভাগ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বহু প্রতীক্ষিত বিচারের পর আপিলে অষ্টম রায় এটি।

২০১২ সালের ২২ আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে আজহারকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার বিচার৷ সবশেষ ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার পর থেকে আজাহারুল ইসলাম গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছেন।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে