লবণ ও পেঁয়াজ রহস্যের উদ্‌ঘাটন জনস্বার্থেই দরকার

আহমদ রফিক

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক। ফাইল ছবি

পেঁয়াজ নিয়ে সংবাদপত্রে তোলপাড়। ভাবা যায়, পেঁয়াজ নিয়ে এক দিনের প্রতিটি সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পাতাটিতে মোটা মোটা হরফে (কোনোটিতে সচিত্র) সরস-বিরস নানা ব্যঞ্জনায় শিরোনাম (গত শুক্রবার ১৫.১১.২০১৯)। কয়েকটি উদ্ধার করা অপরিহার্য বিবেচনা করছি : ‘২২০ টাকায় উঠে কাঁদাচ্ছে পেঁয়াজ’, ‘আশ্বাস উড়িয়ে পেঁয়াজের কেজি এখন ২০০ টাকা’, ‘পেঁয়াজের ডাবল সেঞ্চুরি’/ঝাঁজে উত্তপ্ত সংসদ’, ‘পেঁয়াজের ডাবল সেঞ্চুরি’/‘পাইকারি বাজারে উধাও, খাতুনগঞ্জে বিক্রি বন্ধ’/‘এক দিনেই বেড়েছে ৫০-৬০ টাকা’/‘সরকারের সব উদ্যোগ ব্যর্থ’, ‘লাগামহীন ডাবল সেঞ্চুরি’/‘এত সরবরাহ গেল কোথায়’, ‘পেঁয়াজ ২৩০ নট আউট’/‘সংসদেও ঝাঁজ’, ‘পেঁয়াজের ঝাঁজে উত্তপ্ত সংসদ’/‘বাজারে সক্রিয় সিন্ডিকেট, পেঁয়াজের ডাবল সেঞ্চুরি!’/‘পেঁয়াজে নাভিশ্বাস’ ইত্যাদি।

অবিশ্বাস্য ঠেকছে নাকি ঘটনা? রান্নাঘরে সমান উত্তাপ ও ক্ষোভ মধ্যবিত্ত থেকে সর্বনিম্নবিত্ত শ্রেণি পর্যন্ত। কারো মন্তব্য : পেঁয়াজ খাওয়া বন্ধ করে দাও। কারো পরামর্শ, দিনে একটার বেশি নয় পেঁয়াজ ব্যবহার, সেই সঙ্গে টুকরো কথা নিচুস্বরে—তাও পাঁচ টাকা। এমন সব বিচিত্র প্রতিক্রিয়া গৃহকর্তাদের, মুখভার গৃহকর্ত্রীদের, তবে অবস্থাদৃষ্টে নীরব।

এসবের কিছু নানা সূত্রে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, কিছু শোনা। কিন্তু সর্বত্রই প্রচণ্ড সমালোচনা এবং ক্ষোভ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে বিস্ময় সরকারি ভূমিকায়। ব্যবসায়ী মুনাফাবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে উদাসীনতায়। কারণ এরই মধ্যে আমদানীকৃত পেঁয়াজের পরিমাণ কম নয়। তার পরও দাম কমার পরিবর্তে তা ঊর্ধ্বমুখী এবং তা এতটাই যে ১২০ থেকে একলাফে ২০০ টাকায় উন্নীত।

স্বভাবতই পরদিনের একটি দৈনিকের প্রথম পাতায় ব্যঙ্গাত্মক সচিত্র সংবাদ পেঁয়াজ নিয়ে, অনেকটা কার্টুনের ভঙ্গিতে লেখা—পেঁয়াজের হালি ২০ টাকা। শিরোনাম : ‘এক দিনে কেজিতে পেঁয়াজের দাম বাড়ল ৩০-৫০ টাকা’। এটা কি স্বাভাবিক ঘটনা? ঘাটতিতেও এমনটা ঘটতে দেখা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আগ্রাসী ষড়যন্ত্রে সবই সম্ভব।

তাই একই দিনের অন্য একটি কাগজে শিরোনাম প্রথম পাতায়, সাংবাদিকতার ভাষায় যাকে বলে ‘লিড নিউজ’ : ‘পেঁয়াজ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড’/‘এক মণ ধানের দামে ২ কেজি পেঁয়াজ’। এর পর তো প্রশ্ন উঠতেই পারে : পেঁয়াজ না খেলে কী হয়? তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? ঘটনা এখানে শেষ নয়, শেষ নয় মুনাফা ষড়যন্ত্রের। তাই একটি দৈনিকে শিরোনাম : ‘পেঁয়াজের ঝাঁজ বাড়ছেই/সঙ্গে চালও’/‘চালের দাম বাড়ল কেজিতে ৫-৭ টাকা’। বুঝতে কি খুব কষ্ট হচ্ছে মুনাফাবাজ ব্যবসায়ীদের কারসাজি? বছর দুই আগেও চালের দাম বাড়ানো হয়েছিল কেজিপ্রতি ৮ টাকা, পরে কমিয়ে ৬ টাকা। স্বভাবতই মানুষের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, দেশের বাজার, মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করছে কারা? সরকার, না ব্যবসায়ীকুল। বৃহৎ ব্যবসায়ীকুল তথা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কি বাংলাদেশি মানুষের জীবন যাপনের হর্তাকর্তা বিধাতা? অবস্থাদৃষ্টে তো তাই মনে হচ্ছে।

আমাদের এ আলোচনাটা পুরোপুরি সংবাদপত্রের শিরোনামভিত্তিক, এর তাৎপর্যভিত্তিক। তাই আমরা বিশদ প্রতিবেদনে না গিয়ে শুধু শিরোনামগুলোই তুলে ধরছি এবং সেগুলোর তাৎপর্য বিশ্লেষণে পণ্য বাজার ও তত্সংক্রান্ত সামাজিক অবস্থার চিত্রচরিত্র বোঝার চেষ্টা করছি। তাতেই ঘটনাবলির রাজনৈতিক চরিত্রও আপসে-আপ স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

এরপর আরেকটি দৈনিকের শিরোনাম : ‘পেঁয়াজের কেজি ২৫০/লাগাম টানবে কে? ‘সংকট মোকাবেলায় উড়োজাহাজে আমদানির সিদ্ধান্ত’। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন : এরই মধ্যে আমদানি তো কম হয়নি? গুদাম বন্ধ করে বা সরিয়ে বা খাতুনগঞ্জে বিক্রি বন্ধ করে যদি কৃত্রিমভাবে বাজারে সংকট সৃষ্টি করে পেঁয়াজের দাম লাগামহীন বাড়ানো হয়, তাহলে উড়োজাহাজের পেঁয়াজও তো উড়ে যাবে ‘অন্য খানে, অন্য কোনোখানে’।

আসল সমস্যা তো সিন্ডিকেট। সেখানে হাত দিতে না পারলে, গুদামে অভিযান চালাতে না পারলে, পণ্যদ্রব্যের দাম নিয়ে ষড়যন্ত্র রুখতে না পারলে সমস্যা সমাধানের কোনো সম্ভাবনা নেই। সেই মূলকেন্দ্রে হাত না দিয়ে আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণে কোনো সুফল মিলবে না।

আরেকটি দৈনিকের শিরোনাম : ‘বাড়ছেই পেঁয়াজের ঝাঁজ’/‘ভোক্তা দিশেহারা : কেজি ২৫০ টাকা’। ভোক্তারাই শুধু নন, দিশেহারা আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরাও এবং দৈনিক পত্রিকার সংবাদ-সম্পাদকরা পেঁয়াজের ঝাঁজে, ঘটনার চাপে। নাকি প্রকাশ-অযোগ্য কোনো কারণের চাপে। সংবাদ ভুবনের এসব রহস্য আমাদের জানা নেই। সমস্যার সমাধান হচ্ছে না বলেই মনে প্রশ্ন।

পূর্বোক্ত সংবাদের পাশে সংবাদ : ‘পেঁয়াজ আনা হচ্ছে কার্গো বিমানে’। আমরা আবারও বলছি, এ সদিচ্ছা ফলপ্রসূ হবে না যদি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বাজারের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যক্ষভাবে হাতে না নেয়। এর আগে একই ধরনের খবর সম্পর্কে আমরা আগেও বলেছি, বাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে থাকলে পেঁয়াজের দামও তাদেরই হাতে থাকবে। যখন মুনাফার বস্তা তাদের ইচ্ছাপূরণ করবে, ওদের পরিতৃপ্তি ঘটাবে, তখনই পেঁয়াজের দাম কমবে।

দুই.

সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশ সব ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার। এবং তা নিজ সহযোগী সংগঠনের বিরুদ্ধেও। শোনা যাচ্ছে, নেপথ্য নায়করাও নাকি এবার জালে ধরা পড়তে পারেন। তাহলে পেঁয়াজ নিয়ে ষড়যন্ত্রকারী সিন্ডিকেট বাদ যাচ্ছে কেন?

এর আগে যত পেঁয়াজ-সংক্রান্ত শিরোনাম তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলোর কোনো কোনোটিতে সমস্যার ইঙ্গিতও রয়েছে। যেমন খাতুনগঞ্জের খবরটি। দাম বাড়াতে বিক্রি বন্ধের যে পরিকল্পনা, যা ষড়যন্ত্রেরই শামিল, তার কিছু আলামত এরই মধ্যে বেরিয়ে আসছে। আমরা এর আগে একটি কলামে লিখেছিলাম ভোক্তাদের উদ্দেশে : কিছুদিন পেঁয়াজ খাওয়া বন্ধ রাখুন, পেঁয়াজ বাজারে বেরিয়ে আসবে গুদাম থেকে। কারণ পেঁয়াজ চাল নয়, পেঁয়াজ পচনশীল পণ্য।

একটি দৈনিকে সংগতিপূর্ণ খবর : ‘খাতুনগঞ্জে আড়ত থেকে বের হচ্ছে পচা পেঁয়াজ’। প্রতিবেদনে যা প্রকাশ তার মর্মার্থ হলো, পেঁয়াজের দাম বাড়ার আশায় গুদামে মজুদ করে রাখা হয়েছিল। এখন তাতে পচন ধরায় সে পচা পেঁয়াজই আড়ত থেকে বের করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। নিম্ন আয়ের মানুষ অপেক্ষাকৃত কম দামে তাই কিনে নিচ্ছে। কী অমানবিক আচরণ খাতুনগঞ্জের!

এ অবস্থায়ও আমদানিকারকরা অনড়, অটল! তাই পাইকারি বাজারে দাম কমছে না। তাদের যুক্তি, বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করা যায় না। ভারত ছাড়া অন্যত্র পেঁয়াজের দাম বেশি। ঠিক আছে, সে ক্ষেত্রে পেঁয়াজ ধরে রাখা কেন, পেঁয়াজ মুক্তবাজারে ছেড়ে দিতে অসুবিধা কোথায়? এসব যুক্তি-তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে একই দৈনিকে হতাশাব্যঞ্জক খবর : ‘শিগগির কমছে না পেঁয়াজের দাম’।

অবস্থাদৃষ্টে, ঘটনাক্রমে যে যার মতো পেঁয়াজ সমস্যার সমাধানে নানা ধরনের ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। একটি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে পেঁয়াজের বিকল্প ব্যবহারের কথা। তবে সবারই কমবেশি একরকম কথা—পেঁয়াজ ব্যবহার রান্নাঘরে কমিয়ে আনা হোক। তাতে আর্থিক সমস্যার কিছুটা সাশ্রয় তো হবে।

তিন.

আমরা জানি না, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পেঁয়াজের দামের এই ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের কার্যকারণ বিশ্লেষণ করে কী সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। তারা হয়তো ঘাটতির বিষয়টিতেই জোর দিচ্ছে। কিংবা জোর দিচ্ছে আমদানীকৃত পেঁয়াজের দাম সম্পর্কে ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের ওপর। প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘আগে ব্যবস্থা নিলে এমন হতো না।’

আমাদের বক্তব্য বর্তমান অবস্থার সঠিক ব্যবস্থাপনাটা আপাতত খুবই জরুরি। জরুরি ভিত্তিতে বিমানে আনা পেঁয়াজও আমরা মনে করি, সরকার নিজ তত্ত্বাবধানে বাজারে ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখলে সর্বনাশের কিঞ্চিৎ রক্ষা বা অর্ধেক রক্ষা হতে পারে। সেই সঙ্গে অপরিহার্য সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ। বৃহৎ ব্যবসায়ীদের গুদাম নিয়ন্ত্রণ। সরকারের আমদানীকৃত পেঁয়াজ টিসিবির মাধ্যমে কড়া নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে বিক্রির ব্যবস্থা এবং বাড়তি নিয়ন্ত্রণাধীন বাজারে ছাড়া হলে কিছুটা সুফল মিলতে পারে।

টিসিবির ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে একটা অপ্রিয় কথা বলি, দীর্ঘকাল থেকে এ সম্পর্কে শুনে এসেছি, সরষের মধ্যে ভূত। সে জন্যই ‘কড়া নিয়ন্ত্রণের’ কথাটা বলা হয়েছে এর আগে। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মানুষের অন্তহীন অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কয়েক দিন থেকে দৈনিকগুলোতে খবর : ‘পেঁয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালের দামও বাড়ছে’।

আমাদের প্রশ্ন, কেন? এর কি কোনো যুক্তিসংগত কারণ আছে? হঠাৎ করে কি চালের মজুদে ঘাটতি পড়ে গেল যে চালের দাম বেড়ে যাবে? আর যদি কিছু ঘাটতি থাকেও, তাতে হঠাৎ করে দাম বাড়ানোর অর্থ সীমাহীন মুনাফাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। আর দুই দিন আগে লবণ নিয়ে যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেল সারা দেশে তারই বা যুক্তি কী? ব্যবসায়ীরাও বলছে, দেশে পর্যাপ্ত লবণ মজুদ আছে। তাহলে গুজব ছড়াল কারা? নেপথ্যের কারিগরদের তো খুঁজে বের করা দরকার। আরেকটি খবর : সবজির দামও একই সঙ্গে বাড়ছে? আবারও প্রশ্ন : মূল্যবৃদ্ধি কি সংক্রামক রোগ যে বিশেষ কারণে একটি পণ্যের দাম বাড়লে অন্যটির বা অন্যগুলোর দাম বাড়বে?

ঘটনা আসলে ভিন্ন। যতটা যুক্তিগ্রাহ্য, তার বাইরে অবিশ্বাস্য মূল্যবৃদ্ধির সবটাই ব্যবসায়ীদের কারসাজি, মুনাফার দুরন্ত লোভ। এর নিয়ন্ত্রণ একমাত্র সরকারই করতে পারে। শেষ প্রশ্নটা হলো, কী করছে ক্যাব, ভোক্তা স্বার্থ রক্ষার সংগঠনটি? তাদের দাবি হতে পারত পেঁয়াজ রহস্যের সুষ্ঠু তদন্ত এবং সম্ভাব্য অপরাধের বিচার ও শাস্তি। তারা কি ভোক্তা স্বার্থের দায়িত্ব পালন করছে?

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে