সড়ক দর্ঘটনার কারণে কত মায়ের কোল খালি হয়েছে তার হিসেব অনেক লম্বা। ঘর থেকে হাসিমুখে বের হয়ে আর ঘরে ফেরা হয়নি বহু মানুষের। এই গাড়ির নিচে প্রাণ হারিয়েছে বহু প্রিয়জন। অজস্র দূর্ভাগাদের মতো নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রীও ১৯৯৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। ইলিয়াস কাঞ্চন তখন দেশের ব্যস্ততম নায়কদের একজন।
স্ত্রীকে হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে ইলিয়াস কাঞ্চন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন শুরু করেন। সেই থেকে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে সড়ককে নিরাপদ করার লক্ষ্যে আন্দোলন করে আসছে।
ইলিয়াস কাঞ্চনের হাত ধরেই নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশজুড়ে সচেতনতা এসেছে, আন্দোলনটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তার মতো ব্যক্তিত্ব সড়ক আইন নিয়ে কথা বলেন বলেই সবাই বিষয়টাকে গুরুত্ব দেয়। সরকারও গুরুত্ব দেয়।
১ নভেম্বর থেকে নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হয়েছে। আর এই নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংস্কারের দাবিতে পরিবহন শ্রমিকরা কর্মবিরতিও পালন করেছে। এদিকে কয়েক দিন আগে দেখা গেছে সবাই যেনো এই আইন মেনে চলেন, পথে ঘুরে ঘুরে গাড়ি চালকদের বোঝাচ্ছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। যার ফলাফল হয়েছে উল্টো।
পরিবহন শ্রমিক আর মালিকদের কাছে ইলিয়াস কাঞ্চন বরাবরের মতই চক্ষুশূল হয়েছেন।রাজপথে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে, তার ছবি পোড়ানো হয়েছে। তাকে হেনস্থা করার চেষ্টা করা করেছে। তবুও থেমে নেই সত্যিকারের এই নায়ক।
দেশের মানুষ ইলিয়াস কাঞ্চনকে সমর্থন দিয়েছে। তারাও কাঞ্চনের মতো মনে করে এইসব আইন বাস্তবায়ন হলে দুর্ঘটনা কমবে। চলচ্চিত্র শিল্পীও তার সঙ্গে আছে বলে জানান শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান।
এ ছাড়া অনেক সাধারণ মানুষও সোশ্যাল মিডিয়ায় ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে আছেন বলে সমর্থন জানাচ্ছেন। এক ব্যক্তি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘ইলিয়াস কাঞ্চনের ‘অপরাধ’ একটাই, তিনি পরিবহন শ্রমিক আইনের সংশোধন চেয়েছেন, নিরাপদ সড়কের দাবীতে রাস্তায় নেমেছেন, চালক-যাত্রী-পথচারী সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুর পর থেকেই নিরাপদ সড়কের আন্দোলন গড়ে তুলেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন, আর কেউ যায়ে চালকের অসাবধানতায় মৃত্যুর কোলে ঢলে না পড়ে, কোন মানুষকে যেন তার মতো সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে না হয়, সেজন্যেই নিজের ক্যারিয়ারকে একপাশে ফেলে রেখে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন এই জনপ্রিয় অভিনেতা।’
ইলিয়াস কাঞ্চনের একজীবনের এই আন্দোলনকে ভালোবেসে মানুষ বলে পরিবহন শ্রমিকদের ভিলেন হলেও, আসলেই সত্যিকারের নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। মানুষের কল্যাণে তার এতদিনের পরিশ্রম বৃথা যেতে পারে না।
এদিকে যারা ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। তার কুশপুত্তলিকা দাহ করছে। তাদের উদ্দেশ্যে এই নায়ক বলেছেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, সড়ক পরিবহন আইনটি করা হয়েছে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য, সড়কে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য। জেল বা জরিমানা আদায়ের জন্য নয়।
কাউকে শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে নয়। যদি আপনারা এই আইন সঠিকভাবে মেনে চলেন তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আর যদি সড়কে শৃঙ্খলা ফিরেই আসে তাহলে আইনে জরিমানার ভয় কিসের? আপনি অপরাধ করলেন আপনার জেল জরিমানা হবে। আপনি যদি অপরাধ না করেন তাহলে কেন আপনার জেল জরিমানা হবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিনা নিজেদের সংশোধন না করে, সঠিক লাইসেন্স না নিয়ে, দক্ষতা অর্জন না করে, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস না নিয়ে উল্টো জেল-জরিমানার কথা বলে জনগণকে জিম্মি করে কেন অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে?
অথচ একটু ধৈর্য্য ধরে আইনের ভেতরে গিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই আইনটিতে কাউকে এককভাবে দায়ী বা টার্গেট করা হয়নি। বিশেষ করে চালকশ্রেনীকে নয়। বরং তাদের পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধি, কর্মঘন্টা নির্ধারণ, নিয়োগপত্রসহ গাড়ি চালনায় সঠিক পরিবেশ তৈরির কথাও রয়েছে। তবুও কেন এই বিরোধিতা, কেন এই আইনকে মেনে না নিতে পারার মানসিকতা?’
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আমরা মনে করি নতুন সড়ক পরিবহন আইনটি যদি কোন মহলের চাপের মুখে ব্যহত হয় এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হয় তাহলে আমরা দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ, দারিদ্র্য বিমোচন ও এসডিজি বাস্তবায়নের যে স্বপ্ন দেখছি তা আর পূরণ হবেনা। পূর্বে যেখানে ছিলাম অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল আর অসহায় পরিবারের কান্না চলতেই থাকবে।
তাই আমরা মনে করি, এই আইনের সঠিক প্রয়োগে ও বাস্তবায়নে যদি কোন মহলের চাপের মুখে সরকার মনোভাব পরিবর্তন করে তাহলে হেরে যাবে ১৮ কোটি জনতা।সেইসাথে হেরে যাবে বাংলাদেশ।’