এক সিস্টেমেই কমেছে লক্ষাধিক সরকারি চাকরিজীবী ও পেনশনারের সংখ্যা!

মত ও পথ প্রতিবেদক

সরকারি লগো

হঠাৎ করে কমে গেছে প্রায় ৬০ হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা। একই সময়ে ভুতুড়ে পেনশনারের সংখ্যাও কমেছে প্রায় ৫০ হাজার।

জানা যায়, সরকারি চাকুরেদের বেতন এবং পেনশন দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প ‘আইবাস প্লাস প্লাস’ সফটওয়্যার চালু হওয়ার পরই মূলত চাকরিজীবী ও পেনশনারের এই সংখ্যা অবিশ্বাস্যভাবে কমে গেছে। অনলাইনে বেতন ও পেনশন দেওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিবছর এ খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে তুলে নিত জালিয়াতচক্র।

universel cardiac hospital

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইবাস প্লাস প্লাসের আওতায় আনার পর অর্থাৎ চলতি বছরের জুলাই থেকে এ জালিয়াতি বন্ধ হয়েছে। বেশ কয়েকজন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

আইবাস প্লাস প্লাসের হিসাব অনুযায়ী, ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৬০৬ জন চাকুরে এবং ৭ লাখ ৪১ হাজার ৭০৩ জন পেনশন নিচ্ছেন। অথচ অ্যানালগ পদ্ধতিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ। আর পেনশনার ধরা হতো প্রায় ৮ লাখ।

সরকারি চাকুরে ও পেনশনার কমায় এখন বেতন ও পেনশন খাতে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। আইবাস আসার পর হঠাৎ করে উভয় খাতে চাকরিজীবী ও পেনশনার কমে যাওয়ায় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের চোখ কপালে উঠেছে।

কর্মকর্তারা জানান, অ্যানালগ পদ্ধতিতে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসাবরক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে একাধিক অফিস থেকে বেতনভাতা তুলতেন। আবার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মৃত্যুর পরও তাদের নামে বছরের পর বছর পেনশন তোলা হতো।

এসব জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতিবছর রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতচক্রের পকেটে ঢুকত। কিন্তু যখনই আইবাস প্লাস প্লাস চালু হলো, তখন প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিয়েই আইবাসে বেতন নির্ধারণ (ফিক্সেশন) করতে হচ্ছে। ফলে এক ব্যক্তি একাধিকবার বেতন তুলতে পারছেন না। এ ছাড়া মৃত পেনশনারের নামেও পেনশন তোলা বন্ধ হয়ে গেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আইবাসে যাওয়ার আগে কঠোর তদারকি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পেনশনারের সঠিক হিসাব না থাকায় ভুয়া পেনশনাররা বছরে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন।

কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অন্যান্য দপ্তরের চাকরিজীবী এবং পেনশনারের প্রকৃত সংখ্যা কেন্দ্রীয়ভাবে হিসাব রাখা হয়নি। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অন্যান্য দপ্তরের এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনভাতা ও পেনশনের আলাদা আলাদা হিসাব রাখা হতো। কেন্দ্রীয়ভাবে হিসাব না থাকায় জালিয়াতচক্র ভুয়া পেনশনার ও চাকরিজীবীর নামে রাষ্ট্রীয় অর্থ হাতিয়ে নিত।

২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে অনলাইনে বেতন ও পেনশন দিতে আইবাস প্লাস প্লাস নামে একটি সফটওয়্যার চালু করে অর্থ মন্ত্রণালয়। চলতি বছরের জুলাই থেকে এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৬০৬ জন চাকুরে এবং ৭ লাখ ৪১ হাজার ৭০৩ জন পেনশনার তাদের পেনশন পাচ্ছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফ ২০১৮’ অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মোট সংখ্যা ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৫৫। অথচ আইবাস প্লাস প্লাসের হিসাব অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসিত ও করপোরেশন ছাড়াই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১২ লাখ ৪৪ হাজার। এখানে স্বায়ত্তশাসিত ও করপোরেশনকে হিসাবে আনা হয়নি। অবশ্য সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে আইবাস প্লাস প্লাসের আওতায় আনা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সফটওয়্যারের মাধ্যমে বেতন ও পেনশন নিতে হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে বেতন ও পেনশন নির্ধারণ (ফিক্সেশন) করতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় কেউ একাধিকবার বেতন কিংবা ভুয়া পেনশন তুলতে পারেন না। কিন্তু অ্যানালগ পদ্ধতিতে কেউ কেউ একাধিক জায়গা থেকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বেতন তুলতেন। আবার অনেকে ভুয়া পেনশন তুলতেন। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মারা যাওয়ার পরও তাদের নামে পেনশন তোলা হতো।

এসব জালিয়াতি চলেছে বছরের পর বছর। কিন্তু সরকার আইবাস সফটওয়্যারের মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতনভাতা ও অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন দেওয়া চালুর ফলে এখন আর ভুয়া বেতন কিংবা পেনশন তুলতে পারেন না। ফলে সরকারের বেতন ও পেনশন খাতে বছরের পর বছর চলে আসা ভুতুড়ে ব্যয় কমেছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সচিবালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আইবাস প্লাস প্লাস নামের এই সফটওয়্যার উদ্বোধন করেন। এটি হচ্ছে কেন্দ্রীভূত সমন্বিত বাজেট প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও হিসাবরক্ষণ পদ্ধতির সফটওয়্যার।

এতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও পেনশন নির্ধারণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী এই সফটওয়্যারে ঢুকে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) নম্বর, কর্মরত পদ, চাকরিতে যোগদানের তারিখ, কতগুলো টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড পেয়েছেন- তার তথ্য এবং সর্বশেষ স্কেলের তথ্য দিলেই নতুন স্কেলে তার বেতন কত দাঁড়াচ্ছে তা চলে আসবে। একই ভাবে মিলবে পেনশনের তথ্য। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই কর্মকর্তা-কর্মচারী বেতনভাতা নির্ধারিত হয়ে যাবে এর মাধ্যমে।

এ প্রসঙ্গে আইবাস সফটওয়্যারের উদ্যোক্তা সাবেক অর্থ সচিব মুসলিম চৌধুরী (তিনি এখন মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।) গণমাধ্যমকে বলেন, আইবাসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও পেনশন দেওয়ার ফলে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা বেঁচে যাচ্ছে।

জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের এখন ধরা সম্ভব কিনা- এমন প্রশ্নে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক বলেন, বিষয়টি খুবই কঠিন। মুসলিম চৌধুরী আরও বলেন, অ্যানালগ পদ্ধতিতে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী জালিয়াতি করতেন, তারা নিশ্চয়ই এখনো সক্রিয় থাকবেন। সুতরাং আমাদের সফটওয়্যার সিস্টেমকে আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, সরকার ডিজিটাইজেশনে যাওয়ার আগে আমরা ভুয়া চাকরিজীবী ও পেনশনারদের বিষয়ে সতর্ক করে আসছিলাম। কিন্তু দেরিতে হলেও সরকার ডিজিটাইজেশনে যাওয়ায় প্রতারকচক্রের তৎপরতা বন্ধ হচ্ছে। এটা ডিজিটাইজেশনের সুফল।

তিনি বলেন, যারা রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিষয়টি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে