আইএসের দৃষ্টি কাড়তেই হলি আর্টিজানে হামলা : আদালত

আদালত প্রতিবেদক

হলি আর্টিজান হামলা
হলি আর্টিজান হামলা। ফাইল ছবি

তিন বছর আগে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলায় ২২ জনকে হত্যার দায়ে সাতজনের মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে খালাস দিয়েছে আদালত।

আজ বুধবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান জনাকীর্ণ আদালতে আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।

universel cardiac hospital

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের দৃষ্টি আকষর্ণ করতেই জঙ্গি নেতা তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে এই হামলা হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতেই হত্যার জন্য বিদেশিদের বেছে নেয়া হয় বলে রায়ে বলেন আদালত।

রায়ে বিচারক বলেন, হলি আর্টিজান মামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও সমন্বয়কারী ছিল তামিম চৌধুরী। আসামি আসলাম হোসেন র‌্যাশ তার দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করে ‘আমি তখন তামিম ভাইয়ের কাছে গুলশান বা কোনো কূটনৈতিক এলাকায় আক্রমণের উদ্দেশ্য জানতে চাই। তামিম ভাই বলে যে, আমাদের সংগঠন নব্য জেএমবি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস দ্বারা অনুপ্রাণিত। আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই গুলশান কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করা প্রয়োজন।’

কাজেই এটা প্রতিষ্ঠিত যে, তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে হলি আর্টিজান হামলা সংঘটিত হয়। বাংলাদেশি তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার জন্য জনমনে আতঙ্ক তৈরি করা ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তামিম চৌধুরীর পরিকল্পনায় নব্য জেএমবি সদস্যরা গুলশান হলি আর্টিজানে হামলা করে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে গ্রেনেড, আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো চাপাতি দিয়ে ১৭ জন বিদেশি, চারজন বাংলাদেশি নাগরিক ও দুজন পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে এবং অনেককে গুরুতর আহত ও জিম্মি করে।

উপরোক্ত আলোচনা এবং সাক্ষ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, আসামি জাহাঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগেন, মো. আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন এর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ৬(২)(অ) ধারার অভিযোগ এবং আসামি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ৬(২)(উ) ধারার অভিযোগ আসামির জাহাংগীর হোসেন, আসলাম হোসেন র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগেন, মোহাম্মদ আবদুস সবুর খান এবং শরিফুল ইসলাম খালেদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ৭ ধারার অভিযোগ, আসামি জাহাঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগেন, শরিফুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ৮/৯ ধারার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং সে জন্য আসামিগণকে উক্ত ধারাগুলোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা প্রদান করা যেতে পারে।

আসামি মামুন রশিদ রিপনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ৭ ধারার অভিযোগ মো. মিজানুর রহমানের সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ৬(২)(অ)/৭/৮/৯/১০/১১/১২/১৩ ধারার অভিযোগ এবং আসামির জাহাঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন র‌্যাশ, আবদুস সবুর খান, মো. হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগেন, শরিফুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ১০/১১/১২/১৩ ধারার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি এবং সেজন্য এই আসামীগণ উক্ত ধারার অভিযোগ হতে খালাস পেতে পারে। বিচার্য বিষয় দুটি প্রসিকিউশন পক্ষের অনুকূলে নিষ্পত্তি  করা হলো।

সাজা আরোপ

বাংলাদেশের তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জেএমবির একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। নিরপরাধ দেশি-বিদেশি মানুষ যখন রাতের খাবার খেতে হলি আর্টিজান বেকারিতে যায় তখনই আকস্মিকভাবে তাদের উপর নেমে আসে জঙ্গিবাদের ভয়াল রূপ। জঙ্গি সন্ত্রাসীরা শিশুদের সামনে হত্যাকাণ্ড চালায়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য জঙ্গিরা নিথরদেহগুলোকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হলো হলি আর্টিজান বেকারি।

কলঙ্কজনক এ হামলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশি বিদেশি নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এর ফলে শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য পরিচিত বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়। সেজন্য সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে আসামিরা কোনো ধরনের অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না। এই ক্ষেত্রে আসামিদের সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ৬(২)(অ) ধারার প্রদত্ত সর্বোচ্চ সাজা প্রদানই ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবে এবং ভাগ্যাহত মানুষের স্বজনেরা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।

আর মামলার অভিযুক্ত আসামি জাহাঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রকিবুল হাসান রিগ্যান, মামুনুর রশিদ রিপন, মো. আব্দুস সবুর খান, শফিকুল ইসলাম খালেদকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ক ধারায় দোষী সাব্যস্থ করা হলো। এবং তাদের প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। তাদের মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের গলায় ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কর্যকর করার নির্দেশ দেয়া হলো।

আসামী জাহাঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান  এবং শরিফুল ইসলাম খালেদকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০১৯-এর সাত ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং দশ লাখ টাকা জরিমান দণ্ডিত করা হলো এবং অনাদায়ে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হলো।

আসামি জাহাঙ্গির হোসেন, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, আব্দুস সবুর খান, মো হাদিসুর রহমান, রকিবুল হাসাদ রিগ্যান, শফিফুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপনকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ৮/৯ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হলো এবং উক্ত আইনের আট ধারায় প্রত্যেককে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড এবং উক্ত আইনের  নয় ধারায় প্রত্যেককে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের দণ্ডিত করা হলো এবং অন্যদের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হলো।

আসামি মামুনুর রশিদ রিপন এর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর সাত ধারার অভিযোগ আসামি মো. মিজানুর রহমান এর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসরিরোধী আইন ২০০৯ এর ৬(২)/(র)/৭/৮/২০/১১/১২/১৩ ধারার অভিযোগ এবং আসামি জাহাংঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন র‌্যাশ, আব্দুস সবুর খান, মো. হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসাদ রিগ্যান, শরিফুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এবং ১০/১১/১৩/১৩ ধরায় অভিযোগ হতে বেকসুর খালাস প্রদান করা হলো।

ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৫৫ ধারা মতে আসামিদের বিচারকালীন হাজতবাস দণ্ডাদেশ হতে কর্তন হবে। দণ্ডপ্রাপ্ত হাজতি আসামিগণের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা ইস্যু করা হোক। জব্দকৃত অস্ত্রগুলোর রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হলো এবং ধ্বংসযোগ্য আালামত বিধি মোতাকেক বিনষ্ট করার নির্দেশ প্রদান করার নির্দেশ প্রদান করা হলো।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মৃত্যুদাণ্ডদেশ হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক অনুমোদনের জন্য অত্র মামলার নথি ফৌজদারী কর্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে প্রেরণ করা হোক।

অত্র রায়ের অনুলিপি বিজ্ঞ চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকা ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকা বরাবরে প্রেরণ করা হোক।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে