রাজধানী ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব (১৭) ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম (১৬) নিহতের ঘটনায় করা মামলায় জাবালে নূর পরিবহনের ২ চালকসহ তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
এছাড়া রায়ে জাবালে নূর পরিবহনের মালিক জাহাঙ্গীর আলম ও বাসের সহকারী এনায়েত হোসেনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।
আজ রবিবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েশ এ রায় ঘোষণা করেন।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- জাবালে নূর পরিবহনের ২ চালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন এবং এক বাসের সহকারী কাজী আসাদ। কাজী আসাদ পলাতক থাকলেও দুই চালক কারাগারে রয়েছেন।
রায় ঘোষণার আগে কারাগার থেকে জাবালে নূর পরিবহনের মালিক জাহাঙ্গীর আলম, দুই চালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন এবং তাদের সহকারী এনায়েত হোসেনকে আদালতে হাজির করা হয়।
এর আগে গত ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েশ ১ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন। এ মামলায় ৪১ সাক্ষীর মধ্যে ৩৭ জন সাক্ষ্য দেন।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে বাসচাপায় নিহত হন শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম।
ঘটনার দিনই নিহত মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন।

২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কাজী শরিফুল ইসলাম অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেন। ২৫ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েশ আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ঘটনার দিন দুপুরে চালক ও তাদের সহকারীরা বেশি লোক ওঠানোর লোভে যাত্রীদের কথা না শুনে এবং তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে জিল্লুর রহমান উড়াল সড়কের ঢালের সামনে রাস্তা ব্লক করে দাঁড়ান। এ সময় আরেকটি বাসের চালক মাসুম বিল্লাহ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ১৪-১৫ শিক্ষার্থীর ওপর গাড়িটি উঠিয়ে দেন। ঘটনাস্থলেই দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। আহত হন নয়জন।
জাবালে নূরের যে তিন বাসের রেষারেষিতে ওই দুর্ঘটনা ঘটে, সেগুলোর নিবন্ধন নম্বর হলো- ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৯২৯৭, ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৭৬৫৭ এবং ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৭৫৮০। এর মধ্যে ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৯২৯৭ নম্বর বাসের চাপায় নিহত হন দুই শিক্ষার্থী। বাসটি চালাচ্ছিলেন মাসুম বিল্লাহ।
ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৭৬৫৭ নম্বর বাসের চালক ছিলেন জুবায়ের এবং ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৭৫৮০ নম্বর বাসের চালক ছিলেন সোহাগ।
মামলায় আসামি করা হয় ছয়জনকে। তাদের মধ্যে জাবালে নূর পরিবহনের মালিক জাহাঙ্গীর আলম, দুই চালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন এবং তাদের সহকারী এনায়েত হোসেন কারাগারে। জাবালে নূর পরিবহনের আরেক মালিক শাহাদাত হোসেন জামিনে। তার পক্ষে মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। চালকের সহকারী কাজী আসাদ এখনও পলাতক।
রাজীব-দিয়ার নির্মম ওই মৃত্যুর প্রতিবাদে এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা শহরের প্রধান সড়কগুলো অবরোধ করেন তারা। এমনকি কীভাবে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে হয় সেটিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তারা।
ওই সময় শিক্ষার্থীদের দাবির অন্যতম ছিল- বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে দুই শিক্ষার্থীকে হত্যাকারী চালকের ফাঁসির দাবি, সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি না চলা, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা এবং হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন বিল-২০১৮ পাস হয়। পাসকৃত আইনে সড়কে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে’ প্রাণহানি ঘটালে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এছাড়া কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এবং সেই দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এবং সেই দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
এক বছর আগে নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাস হলেও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বাধার মুখে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অবশেষে গত ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয় ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’।