দেড় বছর ধরে ব্যাংকঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে চলছে নানা আলোচনা। সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা। তারপরও কাজ হয়নি। ঋণের সুদহার উল্টো বাড়ছে।
জানা গেছে, সুদহার কমাতে মুদ্রাবাজার পর্যালোচনা জরুরি। এজন্য ঋণ ও আমানতের পরিমাণ ও সুদহারসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এগুলো হাতে পেলে তা যাচাই-বাছাই করে সুদহার কমানোর করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।
আজ মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকে সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে গঠিত সাত সদস্যের কমিটির প্রথম বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে বৈঠকে অংশ নেয়া কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সরওয়ার ও এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মেহমুদ হোসেন।
বৈঠকের বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ও এবিবি চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, কিভাবে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা যায় এ বিষয়ে আজকে প্রথম মিটিং হয়েছে। বর্তমানে ঋণ ও আমানতের সুদহার কি অবস্থায় আছে, কোন খাতে কত টাকা ঋণ আছে ও আমানত আসছে, এছাড়া কোন খাতে কত টাকা ঋণের সুদ ধার্য আছে, এসব তথ্য সংগ্রহ করা হবে এবং তা যাচাই-বাছাই করা হবে। এরপর মুদ্রাবাজার পর্যালোচনার পর কমিটি পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
বৈঠকে উপস্থিত কমিটির আরেক সদস্য কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, আমরা চেষ্টা করছি কিভাবে সুদহার কমানো যায়। এখন উভয় দিক বিবেচনা করে বাস্তবমুখী সিন্ধান্ত নিতে হবে। তবে তাৎক্ষণিক ১২ শতাংশ থেকে তিন শতাংশ সুদহার কমানো বেশ কঠিন। কারণ এখন যাদের ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ আছে তাদের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা লাভ থাকবে না। অন্যদিকে, ৬ শতাংশ হারে সরকারি আমানত ব্যাংকগুলো পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় হয় প্রায় ৯ শতাংশ। তাই হঠাৎ করে কমানো যাবে না। আমরা চেষ্টা করছি। আশা করছি ভালো ফল আসবে।
এর আগে রোববার সকালে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে বৈঠক করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির একটি মাত্র কারণ হচ্ছে ঋণে সুদহার খুব বেশি। আমাদের মতো এত বেশি সুদহার পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তবে তিনি বলেন, ঋণে সুদহার কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি ২০১৯ প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা।
এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপিঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। আর অবলোপনসহ খেলাপিঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
গত বছর একই সময়ে (সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে) খেলাপিঋণ ছিল ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা।
এদিকে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কে নামিয়ে আনবেন বলে গত বছর ২০ জুন এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি। ওই বছর ১ জুলাই থেকে এক অঙ্ক সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা আসে।
এ জন্য প্রণোদনা হিসাবে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ দেয় সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার ‘রেপো’ সুদহার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।
এর আগের বছর করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করে সরকার। এসব সুবিধা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল, ব্যাংকগুলো এক অঙ্ক সুদে ঋণ বিতরণ করবে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি উল্টো সুদহার বেড়েছে।
- আরও পড়ুন >> আপিল বিচারাধীন : কনডেম সেলে সময় কাটছে ৩০ যুদ্ধাপরাধীর
- আরও পড়ুন >> খালেদা জিয়া মানবিক কারণে জামিন পাওয়ার যোগ্য : ড. কামাল
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্পের মেয়াদি ঋণে সুদ নিয়েছে ১২ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ। দুটি ব্যাংক ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদে এসএমই ঋণ দিয়েছে।
২০১৮ সালে ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকরা যখন সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন, ব্যাংকগুলো এসএমইর মেয়াদি ঋণ বিতরণ করে ১১ থেকে ১৫ শতাংশ সুদে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ১৩ থেকে ১৭ শতাংশে উঠেছে। বাড়ি-গাড়ি কেনার ঋণে ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ সুদ নিচ্ছে ব্যাংক। ক্রেডিট কার্ডে অধিকাংশ ব্যাংকের সুদহার রয়েছে ১৮ থেকে ২৭ শতাংশ।
এদিকে ঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিক কমছে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে ঋণ প্রবৃদ্ধির ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ হয়েছে। আগের মাস সেপ্টেম্বর ছিল ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে। এর আগে আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
জুলাই শেষে ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, মে মাসে যা ছিল ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মার্চে প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ।