অধ্যাপক অজয় রায়ের প্রয়াণে আমরা শোকাহত

সম্পাদকীয়

অজয় রায়
অজয় রায়

সোমবার দুপুরে বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মারা গেছেন বরেণ্য অধ্যাপক অজয় রায়। ৮৫ বছর বয়সী এই অধ্যাপক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং দীর্ঘদিন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রতিষ্ঠা করে লড়াই করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে।

অধ্যাপক অজয় রায় স্কুল এবং কলেজ জীবনে পড়াশোনা করেছেন দিনাজপুরে। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে এমএসসি পাস করে যোগ দেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। তিনি ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের লীডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে সেখানেই করেন পোস্ট ডক্টরেট। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় যোগদান করেন এবং অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।

universel cardiac hospital

তিনি আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী নৃশংস গণহত্যা শুরু করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক অজয় রায়। প্রাথমিকভাবে তিনি কুমিল্লার সোনামুড়া বর্ডারে যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং একাধিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে আগরতলা হয়ে কলকাতায় গমন করেন। সেখানে তিনি মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের সাম্মানিক সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান চিরস্বরণীয় হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন অধ্যাপক অজয় রায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মজীবন থেকে অবসর নেয়ার পর বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ গড়ে তোলেন। তিনি বিজ্ঞানকে তরুণ প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেবার প্রয়াসে বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার এবং সভার আয়োজন করতেন। তিনি মুক্তমনার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকেই কাজ করেছেন। এ ছাড়াও তিনি মুক্তান্বেষা পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন, যার লক্ষ্য হচ্ছে সমাজে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং মানবকল্যাণবোধ প্রতিষ্ঠা।

জীবদ্দশায় একুশে পদক, এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলোশিপ, বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অফ ম্যাথেমাটিকাল ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স কর্তৃক সম্মাননাসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি।

একুশে পদকপ্রাপ্ত পদার্থবিদ অজয় রায়ের দুটি গবেষণা নোবেল কমিটিতে আলোচিত হয়।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশের বইমেলা থেকে রেরিয়ে জঙ্গিদের হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন অজয় রায়ের বড় ছেলে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়। সেদিন উগ্রবাদীদের হামলার শিকার হয়ে হাতের আঙুল হারান অভিজিতের স্ত্রী ব্লগার রাফিদা আহমেদ বন্যাও।

এ ঘটনায় মামলা করেন শিক্ষাবিদ অজয় রায়। হত্যাকাণ্ডের চার বছর পর গত ১৩ মার্চ ছয় জঙ্গিকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। গত ২৮ অক্টোবর হুইল চেয়ারে করে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন অজয় রায়। তার সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। বর্তমান সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন এবং একাধিক জঙ্গি হামলা মামলার বিচারকাজ সম্পন্নও করেছেন। এমতাবস্থায় আমরা আশা করব, আলোচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার মতো অভিজিৎ হত্যা মামলার বিচার কাজ যেন দীর্ঘায়িত না হয়।

সবশেষে, অধ্যাপক অজয় রায়ের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তার শোকার্ত পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে