বিশ্ব জনমতের কাছে মিয়ানমার পরাজিত

ড. দেলোয়ার হোসেন

ড. দেলোয়ার হোসেন
ড. দেলোয়ার হোসেন

আজ এমন সময়ে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালিত হচ্ছে, যখন আগামীকাল রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) করা মামলার শুনানি শুরু হচ্ছে। আমরা জানি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের গণহত্যার অভিযোগ পুরোনো। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় ‘অপারেশন ড্রাগন কিং’। তখন অভিযোগ ওঠে, সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের ভীতি প্রদর্শন, ধর্ষণ ও হত্যার দ্বারা জোরপূর্বক গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করে। সে সময় ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি মুসলিম দেশে এর প্রতিবাদ হলেও বিশ্বব্যাপী তেমন গুরুত্ব পায়নি। এমনকি জাতিসংঘেরও শক্তিশালী পদক্ষেপ আমরা দেখিনি; বরং আমরা দেখেছি, তখন বিশ্বব্যাপী মিয়ানমারের আলোচনা হিসেবে অং সান সু চিই গুরুত্ব পেয়েছিলেন। তার আড়ালেই কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চলতে থাকে। ১৯৯২ সালেও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের অভিযানে গণহত্যা চালানো হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালে মিয়ানমার যে ভয়াবহ গণহত্যা পরিচালনা করে, কেবল সে ঘটনাতেই বাংলাদেশে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়।

ওই ঘটনাকে জাতিসংঘ ‘জাতিগত নিধনের এক আদর্শ উদাহরণ হিসেবে’ আখ্যায়িত করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখেছি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নির্যাতনের দায়ে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং লেইংসহ আরও তিন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। রোহিঙ্গা সংকট এখনও সমাধান না হওয়ায় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উদ্বেগও গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে কিন্তু মিয়ানমারের গণহত্যার বিষয়টি বিশ্বস্বীকৃত।

সর্বশেষ ১১ নভেম্বর ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সমর্থনে গাম্বিয়ার মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে করা মামলাটির মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে বিষয়টি আরও জোরালোভাবে উপস্থাপিত হলো। কালই সে মামলার শুনানি শুরু হবে। আইসিজেতে মিয়ানমারের পক্ষে বক্তব্য দেওয়ার জন্য দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি এরই মধ্যে সেখানে গেছেন। সু চি নিশ্চয়ই তার দেশের পক্ষে সাফাই গাইবেন। জাতিগত নিধনের অভিযোগটি তিনি কীভাবে অস্বীকার করবেন, সেটি দেখার বিষয়। তবে এটা ঠিক, আইসিজেতে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে মিয়ানমার। এর মাধ্যমে এটি স্পষ্ট, বিশ্ব জনমতের কাছে আজ মিয়ানমার পরাজিত। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত মিয়ানমারের গণহত্যার যেসব শক্তিশালী দলিল-প্রমাণ-ডকুমেন্টারি রয়েছে, তার বিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে সু চি কীভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করবেন?

এটা রোহিঙ্গাদের বিশাল বিজয়। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে শুনানিই তো মিয়ানমারের ওপর এক বড় চাপ। তার ওপর একে কেন্দ্র করে বিশ্বগণমাধ্যমে আলোচনা এবং বিশ্বের বিভিন্ন মঞ্চে যেসব আলাপ-আলোচনা হবে, সেটিও কিন্তু মিয়ানমারের ওপর নৈতিক চাপ। যদিও মিয়ানমার বরাবরই তাদের অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। এমনকি আমরা দেখেছি, কেউ কেউ মিয়ানমারের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছে। আমরা মনে করি, জাতিসংঘের অঙ্গীভূত প্রতিষ্ঠান নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে যখন মিয়ানমারের গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের শুনানি হবে, সেটি বরং সেসব দেশের জন্য আরও তৎপর হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে; যারা মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আর যারা মিয়ানমারের পক্ষে রয়েছে, এটা সেসব দেশের জন্যও শিক্ষা হবে। ভূ-রাজনৈতিক ও জাতীয় স্বার্থের বাইরে এসে মানবতার জন্য না দাঁড়ানোর অবস্থান তাদেরও অপরাধী করবে।

রোহিঙ্গা সমস্যার এখন সমাধান হলো নিরাপদ প্রত্যাবাসন। কিন্তু এটি এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। এ জন্য মিয়ানমারকে এগিয়ে আসতে হবে। মিয়ানমারকে বাধ্য করতে দেশটির ওপর কূটনৈতিক ও নৈতিক চাপ জরুরি। মোটের ওপর, আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত যখন বিষয়টি গড়িয়েছে, সেটা নিশ্চয়ই বড় চাপ হিসেবে কাজ করবে বলেই আমার মনে হয়।

অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে