‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এক ধরনের প্রতারণা’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

গাম্বিয়ার আইনজীবী

নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার আইনজীবী রাইখলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের বক্তব্য ‘এক ধরনের প্রতারণা’ বলে অভিহিত করেছেন।

তিনি বলেছেন, মিয়ানমার নিজেই স্বীকার করেছে যে খুব সামান্য সংখ্যায় উদ্বাস্তু ফিরেছে। রাখলার বলেন, মিয়ানমারের আইনজীবী ওকোয়া প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ এবং চীন, জাপান ও ভারতের সহায়তার বিষয়টিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এ দেশগুলো প্রত্যাবাসন চায়। কিন্তু প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব মিয়ানমারের। মিয়ানমার সেটি পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

universel cardiac hospital

রাখলার বলেন, আদালত নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, অং সান সু চি আদালতে রোহিঙ্গা বিশেষণটি ব্যবহার করেননি। শুধু বিচ্ছিন্নতাবাদী আরসা গোষ্ঠীর কথা বলার সময় ছাড়া তিনি তাঁদের মুসলিম হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে গণহত্যা সনদের অধীনে আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার শুনানি তৃতীয় দিনের মতো আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় বেলা তিনটায় শুরু হয়েছে।

শুনানিতে অভিযোগকারী দেশ গাম্বিয়ার পক্ষে প্রথমে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আইনজীবী রাইখলার। আদালতের প্রেসিডেন্ট ইউসুফের নেতৃত্বে আদালতের শুনানি শুরু হয়।

শুনানির প্রথম দিন এই মামলায় মিয়ানমারের পক্ষে দেশটির বেসামরিক সরকারের প্রধান অং সান সু চি গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাস দমনে সশস্ত্রবাহিনী মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে থাকলে তা দেশটির নিজস্ব ব্যবস্থায় বিচারের করার কথা বলেছেন সু চি।

কোনো প্রাণহানি ও নৃশংসতায় গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণিত হয়নি দাবি করে মিয়ানমারের আইনজীবীরা গাম্বিয়ার আবেদন খারিজ করা উচিত বলে আদালতে বক্তব্য দিয়েছেন। গাম্বিয়ার আইনজীবীরা আজ মিয়ানমারের যুক্তিগুলো খণ্ডন করে তাঁদের আবেদনের পক্ষে সমাপনী বক্তব্য দেবেন।

গাম্বিয়ার পক্ষে পল রাইখলার বলেন, প্রথমত মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রতি আচরণে গণহত্যার উদ্দেশ্য অস্বীকার করেছে। দ্বিতীয়ত, গণহত্যার উদ্দেশ্য অনুমান করা হলেও তার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়া যায় না। রাইখলার বলেন, মিয়ানমারের আইনজীবী অধ্যাপক সাবাস গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণের জন্য সাতটি নির্দেশকের কথা বলেছেন। সেই নির্দেশকগুলোর কথা গাম্বিয়ার আবেদনে রয়েছে এবং মিয়ানমার সেগুলো অস্বীকার করেনি।

এরপর গাম্বিয়ার পক্ষে আইনজীবী পিয়েঁর দ্য আর্জেন বক্তব্য দিতে উঠে বলেন, গাম্বিয়া স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এই মামলা করেছে। গাম্বিয়া ওআইসির প্রক্সি বা প্রতিভূ হিসেবে মামলা করেনি। গাম্বিয়া ওআইসির সাহায্য চাইতেই পারে। অন্যদেরও সাহায্য চাইতে পারে। সুতরাং গাম্বিয়া ওআইসির সহায়তা নেওয়ায় বলা যাবে না যে ওআইসি এই মামলার আবেদনকারী।

পিয়েঁর দ্য আর্জেন বলেন, গাম্বিয়া ওআইসি মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর মামলা করেছে বলে মিয়ানমারের আইনজীবী স্টকারের দাবি বিভ্রান্তিকর। মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ ওআইসির নয়, গাম্বিয়ার। গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘে গণহত্যার কথা বলেননি বলে যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে, ওআইসির সিদ্ধান্তের পরই গাম্বিয়া মামলা করেছে—কথাটি ঠিক নয়। গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘে বক্তব্য দেওয়ার পর জাতিসংঘ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই রিপোর্টের তথ্যের ভিত্তিতেই গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে গাম্বিয়া আদালতে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি বলেন, মিয়ানমারের আইনজীবী স্টকার বলেছেন, কোনো অপরাধ যদি ঘটেও থাকে, তাহলে গাম্বিয়ার সেই বিষয়ে মামলা করার অধিকার নেই। মামলা কূটনৈতিক ব্যবস্থায় তার আপত্তির কথা জানাতে পারে, কিন্তু আদালতে আসতে পারে না। স্টকারের এসব বক্তব্য সঠিক নয়। গাম্বিয়া সনদের স্বাক্ষরকারী হিসেবে সনদ লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদনের অধিকার রাখে।

এরপর প্রফেসর ফিলিপ স্যান্ডস গাম্বিয়ার পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেন, ১৯৪৮ সালের গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণ করছে কি না, সে প্রশ্ন তোলার অধিকার গাম্বিয়ার অবশ্যই রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি অতীতের রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক সনদের অংশীদার হিসেবে অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদন করার অধিকার গাম্বিয়ার রয়েছে। ফিলিপ স্যান্ডস বলেন, গণহত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিয়ানমারের আইনজীবী সাবাস একটি নতুন আইনগত মান নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন, যেটি পরীক্ষিত নয়। কিছু কিছু কার্যক্রম গণহত্যার নির্দেশিকার ধারণা তৈরি করলেও সব কার্যক্রম গণহত্যার ধারণা প্রমাণ করে না—এমন দাবি ঠিক নয়।

স্যান্ডস বলেন, ‘অধ্যাপক সাবাস শিক্ষাবিদ হিসেবে ২০১৩ সালে গণহত্যা কাকে বলে, তার ব্যাখ্যায় আল–জাজিরাকে কী বলেছিলেন, তা উল্লেখ করে বলেন, তিনি যে মত বদলাতে পারেন না, সে কথা আমি বলব না।’ উল্লেখ্য, মিয়ানমারের আইনজীবী হিসেবে প্রফেসর সাবাস দাবি করেছিলেন যে মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু গণহত্যা নয়। গণহত্যার উদ্দেশ্য সেখানে অনুপস্থিত।

প্রফেসর স্যান্ডস আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী আদেশ পরিস্থিতির জন্য সহায়ক হবে না—মিয়ানমারের এমন দাবির জবাব হচ্ছে, আমরা এ কারণেই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছি। বসনিয়ায় আদেশ দেওয়ার পরও সেব্রেনিৎসায় যে গণহত্যা হয়েছিল, সেই দৃষ্টান্ত দিয়েই আমরা বলেছি, সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা কেন প্রয়োজন এবং তার বাস্তবায়নের সময় বেঁধে দেওয়া জরুরি। সাবাস তাঁর ২০১৩ সালের সাক্ষাৎকারে গণহত্যা প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপ প্রয়োজন বলেছিলেন, সেগুলো যদি আদালত তার নির্দেশে অন্তর্ভুক্ত করেন, তাতে আমরা আপত্তি করব না।’

গাম্বিয়ার পক্ষে সবশেষে দেশটির আইনমন্ত্রী আব বকর তামবাদু বলেন, ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জীবন হুমকির মুখে। গাম্বিয়া প্রতিবেশী না হতে পারে, কিন্তু গণহত্যা সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে গণহত্যা বন্ধ এবং তা প্রতিরোধে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে।’

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে গাম্বিয়া ওআইসির কাছে সাহায্য চেয়েছে। সার্বভৌম দেশ হিসেবে গাম্বিয়া একা এই আবেদন করেছে। গাম্বিয়া গণহত্যা সনদের রক্ষক হিসেবে এই আদালতের কাছে জরুরি ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার নির্দেশনার দাবি জানাচ্ছে। তামবাদু ছয়টি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার দিকনির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তাঁর বক্তব্য শেষ করেছেন। এরপর আদালত বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত মুলতবি হয়ে গেছে।

গাম্বিয়ার বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হয়েছে। এরপর রাতে সাড়ে ১০টায় মিয়ানমার তাদের যুক্তিতর্ক তুলে ধরবে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে