শিল্পে সর্বোচ্চ ও গৃহস্থালিতে সর্বনিম্ন অগ্রাধিকার দিয়ে ‘প্রাকৃতিক গ্যাস বরাদ্দ নীতিমালা, ২০১৯’ জারি করেছে সরকার।বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ থেকে গত ১১ ডিসেম্বর নীতিমালাটি জারি করা হয়। অর্থনীতিতে ভূমিকার গুরুত্ব অনুযায়ী গ্যাস বরাদ্দের ক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রাকৃতিক গ্যাস বরাদ্দের বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, গত এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে জিডিপির ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধির হার বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বর্তমানে দেশের মোট (প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট) উৎপাদিত বিদ্যুতের ৬০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসনির্ভর। এ চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এছাড়া শিল্প, সার, গৃহস্থালি ইত্যাদি খাতেও প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ক্রমবর্ধমান।
দেশে বর্তমানে সরবরাহকৃত প্রায় ৩২০০ এমএমসিএফডি প্রাকৃতিক গ্যাসের মধ্যে দেশজ উৎপাদন প্রায় ২৭০০ এমএমসিএফডি। দেশে গ্যাসের চাহিদা পূরণে লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) আকারে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে। এলএনজি আমদানির পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।
উল্লেখ্য যে, আমদানিকৃত এলএনজির ব্যয় দেশজ সরবরাহকৃত গ্যাসের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এ অবস্থায়, ‘সরকারের ভিশন-২০২১’ ও ‘ভিশন-২০৪১’ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে একদিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন যোগান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক গ্যাসের দেশজ সরবরাহের সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে যেসব খাতে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি করা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে অধিকতর ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হবে, সেসব খাত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে নীতিমালায় বলা হয়।
‘জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ২০৪১ সাল পর্যন্ত প্রণীত পরিকল্পনায় খাতভিত্তিক প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে শিল্প, বিদ্যুৎ ও সার খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এছাড়া জ্বালানি দক্ষতা, পণ্য উৎপাদনে বিকল্প জ্বালানির উৎস, জাতীয় উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় বিবেচনায় রেখে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার ও বরাদ্দ নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে। এলএনজি আকারে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির ক্ষেত্রে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়।’
এতে বলা হয়, ‘কাজেই বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মোকাবিলার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় কিংবা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম খাত/প্রতিষ্ঠানকে গ্যাস সরবরাহে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এছাড়া জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বের বিবেচনায় খাতভিত্তিক অগ্রাধিকার চিহ্নিতকরণ, বিক্ষিপ্তভাবে স্থাপিত শিল্পের পরিবর্তে পরিকল্পিতভাবে নির্ধারিত শিল্পাঞ্চলে স্থাপিত শিল্পকে অগ্রাধিকার ও প্ল্যান্ট/যন্ত্রপাতির দক্ষতার বিষয়গুলো গ্যাস বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হবে।’
বাণিজ্যিক খাতে স্বল্প পরিমাণ গ্যাসের চাহিদা থাকায় এ খাতে প্রাকৃতিক গ্যাস বরাদ্দ নিরুৎসাহিত করতে হবে জানিয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‘তবে হাসপাতালের মতো জরুরি সেবা খাতে এ বিষয়টি শিথিলযোগ্য। বিশ্বব্যাপী দিন দিন ইলেকট্রনিক, হাইব্রিড ও ব্যাটারিচালিত গাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া সিএনজি সাধারণভাবে ছোট গাড়িতে ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের গাড়িতেও অটোগ্যাসের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই জ্বালানি বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে পরিবহন খাতে সিএনজির পাশাপাশি অটোগ্যাস ব্যবহারকে উৎসাহিত করা যৌক্তিক।’
দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ পাওয়ার, শিল্প, সার, বাণিজ্যিক, সিএনজি, চা বাগান ও গৃহস্থালি খাতে ব্যবহার করা হয়। সরবরাহের বিপরীতে দেশে গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে গ্যাস ব্যবহার বরাদ্দের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও কৌশল প্রণয়নের গাইডলাইন হিসেবে এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
জাতীয় অর্থনীতিতে অবদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বের ভিত্তিতে গ্যাস ব্যবহারকারী খাতগুলোর বরাদ্দের অগ্রাধিকার ক্রম নির্ধারণ করা হবে। শিল্প, বিদ্যুৎ ও সার খাতের প্ল্যান্ট/যন্ত্রপাতির জ্বালানির দক্ষতার আলোকে গ্যাসের বরাদ্দে অগ্রাধিকার দিতে হবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
স্পেশাল ইকোনমিক জোন ও পরিকল্পিত এলাকায় গ্যাস বরাদ্দে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ক্যাপটিভ খাতে গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে শিল্পখাতে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির সুবিধার্থে শিল্পে মানসম্পন্ন ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ প্রয়োজনীয় নেবে।
- রাজাকারদের তালিকা : সরকারকে ধন্যবাদের সঙ্গে প্রশ্ন ড. কামালের
- শ্রদ্ধার ফুলে একাত্তরের বীর শহীদদের স্মরণ
দেশজ প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিবেচনায় বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের সুযোগ নেই। তবে দেশে যৌক্তিক মূলে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে প্ল্যান্ট/যন্ত্রপাতির জ্বলানির দক্ষতার নির্ধারিত মান অর্জন সাপেক্ষে বিশেষ বিবেচনায় বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করা যেতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সেক্টরে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগ থাকার বিষয় বিবেচনা করা হবে। পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক গ্যাসের জ্বালানি ব্যবহারের পরিবর্তে বিকল্প সুযোগ থাকলে তা বিবেচনায় নেয়া হবে।
গ্যাস বরাদ্দের অগ্রাধিকার ক্রম
মানদণ্ড অনুযায়ী গ্যাস বরাদ্দের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত হচ্ছে শিল্প (ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ)। এর পরের খাতগুলোর মধ্যে যথাক্রমে রয়েছে-বিদ্যুৎ, সার, ক্যাপটিভ পাওয়ার, চা বাগান, বাণিজ্যিক ও সিএনজি। সবচেয়ে কম অগ্রাধিকার খাত হচ্ছে গৃহস্থালি।
বাস্তবতার আলোকে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকার গুরুত্ব অনুযায়ী গ্যাস বরাদ্দের ক্রম পুনঃবিন্যাস বা হালনাগাদ করা হবে বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী, গ্যাস উৎপাদন, আমদানি, সঞ্চালন ও বিতরণ পর্যায়ে আধুনিক মিটারিং সিস্টেম চালু করা হবে। প্রতিটি শিল্প কারখানায় নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে ইলেট্রনিক ভলিউসেট্রিক কারেক্টর (ইভিসি) মিটার স্থাপন করা হবে। পর্যায়ক্রমে প্রাকৃতিক গ্যাসের সব গ্রাহককে মিটারের আওতায় আনা হবে।
বৃহৎ গ্যাস ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানে এনার্জি অডিটিং সিস্টেম চালু করা হবে উল্লেখ করে নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‘বছরের বিভিন্ন সময় ব্যবহারের তারতম্যের প্রেক্ষিতে শিল্প, বিদ্যুৎ, সার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য বছরভিত্তিক গ্যাস বরাদ্দের ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করা হবে। বছরের বিভিন্ন সময়ে চাহিদার পার্থক্য বিবেচনায় এলএনজি আমদানি এবং গ্যাস সরবরাহের ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করা হবে।’
আবাসিক, বাণিজ্যিক ও সিএনজি খাতে পাইপলাইন গ্যাস সরবরাহের পরিবর্তে ব্যাপকভিত্তিতে এলপিজি সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় রেগুলেটরি সাপোর্ট দেয়া হবে। এনার্জি ইফিশিয়েন্ট যন্ত্রপাতি ব্যবহারের উৎসাহ প্রদানের জন্য আমদানি পর্যায়ে এবং গ্রাহক পর্যায়ে প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে। গ্যাস ব্যবহারকারীদের কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তৈরি করা হবে। সরকারি গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থার পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে এলএনজি আমদানি ও সরবরাহ প্রদানে উৎসাহ দেয়া হবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।