আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরব ও অহংকারের দিন। দীর্ঘ নয় মাস বিভীষিকাময় সময়ের পরিসমাপ্তির দিন। লক্ষ লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তস্রোত, স্বামী-সন্তানহারা নারীর অশ্রুধারা, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা, আর বীরাঙ্গনাদের সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে নয় মাসের যুদ্ধ শেষে অর্জিত হয়েছিল মহান এই বিজয়। ৪৮ বছর আগে এই দিনে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছিল আত্মপরিচয়ের ঠিকানা।
আজ কৃতজ্ঞ জাতি সশ্রদ্ধ বেদনায় স্মরণ করবে দেশের বীর সন্তানদের। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে জনতার ঢল নামবে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সব প্রান্তের মানুষ অংশ নেবে বিজয় দিবসে। বিজয়ের ৪৮ বছর পেরিয়ে এবার ৪৯তম বিজয় দিবস। এবারের বিজয় দিবস এসেছে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। আগামী ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী এবং এর পরের বছর ২০২১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবে বাংলাদেশ।
মহান বিজয় দিবসে উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাণীতে তারা দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ঢাকায় প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার পুস্পস্তবক অর্পণ করার পর বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিকবৃন্দ শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। কৃতজ্ঞ জাতি সশ্রদ্ধ বেদনায় স্মরণ করবে দেশের পরাধীনতার গ্লানি মোচনে প্রাণ উৎসর্গ করা বীর সন্তানদের।
এদিন সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরের জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সম্মিলিত বাহিনীর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমভিত্তিক যান্ত্রিক বহর প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করবেন। প্রধানমন্ত্রীও এ কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
দিনটি সরকারি ছুটির দিন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপ জাতীয় পতাকায় সজ্জিত করা হবে। রাতে গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় করা হবে আলোকসজ্জা। হাসপাতাল, কারাগার ও এতিমখানাগুলোতে উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হবে। সংবাদপত্র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবে, বেতার ও টিভি চ্যানেলগুলো সম্প্রচার করবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বেলা একটা নাগাদ কলকাতা থেকে ঢাকা এসে পৌঁছান যৌথবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব, মুক্তিযোদ্ধাদের উপ-অধিনায়ক এ কে খন্দকার প্রমুখ। দুপুর একটার পর জেনারেল হেড কোয়ার্টারে বসে আত্মসমর্পনের দলিল তৈরির বৈঠক। এক পক্ষে নিয়াজি, ফরমান আলী ও জামশেদ। অপর পক্ষে জ্যাকব, নাগরা ও কাদের সিদ্দিকী। সিদ্ধান্ত হয় দলিলে স্বাক্ষর করবেন বিজয়ী বাহিনীর পক্ষে পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জয়েন্ট কমান্ডিং ইন চিফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং বিজিত বাহিনীর পক্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কামান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি।
- ২৬ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে
- ১০৭৮৯ রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জেনারেল অরোরা আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বিমান ও নৌবাহিনীর চিফ অব স্টাফসহ কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। নিয়াজি অভিবাদনসহ অভ্যর্থনা জানান যৌথ বাহিনীর কমান্ডারকে।
বিকাল পৌনে পাঁচটায় পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে এলেন। সামরিক বিধি অনুসারে বিজয়ী ও বিজিত সৈনিকরা শেষবারের মতো জেনারেল নিয়াজিকে গার্ড অব অনার জানায়। বিকাল পাঁচটায় জেনারেল নিয়াজি ও যৌথবাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এগিয়ে গেলেন ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। জেনারেল অরোরা বসলেন টেবিলের ডান দিকের চেয়ারে। বাম পাশে বসলেন জেনারেল নিয়াজি। দলিল আগে থেকেই তৈরি করা ছিল। জেনারেল অরোরা স্বাক্ষর করার জন্য দলিল এগিয়ে দেন নিয়াজির দিকে। তখন বিকাল পাঁচটা ১ মিনিট। নিয়াজি দলিলে স্বাক্ষর করে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে। দীর্ঘ নয়মাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে বাঙ্গালী জাতির জীবনে এলো নতুন প্রভাত। এলো হাজার বছরের কাঙ্খিত স্বাধীনতা। বাঙালি জাতি অর্জন করলো তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার।