রাজাকার রক্ষার ষড়যন্ত্র নাকি শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী চক্রান্ত?

মত ও পথ

মোকতাদির চৌধুরী
র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। ফাইল ছবি

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির মহৎ অর্জন। বাঙালির বর্তমান ও ভবিষৎ পথচলার একমাত্র পাথেয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। এ বছর মুক্তিযুদ্ধের ৪৮তম বিজয়বার্ষিকীকে সামনে রেখে একটি তাৎপর্যপূর্ণ কাজ সম্পাদিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থানকারী, মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহায়তাকারী রাজাকার ১০ হাজার ৭৮৯ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। দোসরদের এ তালিকা প্রকাশের দাবিটি ছিল বহুকালের। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, এই তালিকাটি তারা প্রণয়ন করেননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা সরকারি নথিপত্রে যা আছে, তাই প্রকাশ করা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে বাকি স্বাধীনতাবিরোধীদেরও তালিকা প্রকাশ করা হবে। মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার বাহিনী ছিল পাকিস্তান সরকারের পেটোয়া বাহিনী, যাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। জেনারেল নিয়াজির বইতে এদের সংখ্যা ৫০ হাজারের ওপর বলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, তালিকা প্রকাশের ঘটনাটি সারাদেশেই ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত করেছে।

রাজাকারদের তালিকা প্রকাশকে আমরা স্বাগত জানাই। কেননা, যে রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের সময় নিপীড়ন করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে; মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও সাধারণ গ্রামবাসীর ওপর সীমাহীন অত্যাচার করেছে এবং যাদের অনেকেই আবার ১৯৭৫-এর রক্তাক্ত পালাবদলের পর হর্তাকর্তা ও সমাজনিয়ন্ত্রক হয়েছে, তাদের নামের তালিকা নতুন প্রজন্মের জানা উচিত। এছাড়া ইতিহাসের প্রয়োজনেও স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা সংরক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তালিকা প্রকাশের পর এবং পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে যে খবরাখবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকছে না। তালিকায় স্থান পাওয়া বেশ কিছু নামের ব্যাপারে প্রবল আপত্তি উঠেছে। এমনকি এ অভিযোগও পাওয়া গেছে; তালিকায় স্থান পাওয়া এমন নামও আছে, যারা আবার সরকারের তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ সন্তান! শুধু তাই নয়; একাত্তরে যার বাবাকে পাকিস্তানি সেনারা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছে, তার সন্তানের নামও এসেছে স্বাধীনতাবিরোধী তালিকায়!

আমরা মনে করি, প্রকাশিত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত কিছু নাম নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার দাবি রাখে। একই নামে আরও কেউ আছেন কি-না, সেটিও বিচারের দাবি রাখে। সে কারণেই দ্রুত এবং পূর্ণাঙ্গ সতর্কতার সঙ্গে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নামগুলো যাচাই করা প্রয়োজন। এই যাচাই কেবল আমলাতান্ত্রিকতার ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা চর্চা করেন, গবেষণা করেন, সম্পৃক্ত করতে হবে তাদেরও। তবে এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই এ ধরনের কাজ করার আগে সর্তকতার প্রয়োজন ছিল্। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মন্ত্রণালয় কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে যথেষ্ট উদাসীনতা ছিল।যদিও তারা একটি বিবৃতি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে।একই সঙ্গে বলেছে আবেদন করলে যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে তালিকা থেকে নাম বাদ দেবে। আমরা বলতে চাই- ‘আবেদনের’ প্রসঙ্গটি অত্যন্ত আপত্তিজনক। মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের নাম ভুলে তালিকায় এসে থাকলে মন্ত্রণালয় তথা রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে সংশোধন করবে। ইতিহাসের দায় থেকেই এটা করা প্রয়োজন। এখানে আবেদনের প্রশ্ন আসবে কেন?

আমরা মনে করি- মন্ত্রণালয়ের প্রথম দফার তালিকাটি নিঃসন্দেহে ইতিহাসের দায় শোধ করার ক্ষেত্রে একটি অগ্রগতি। দেশের স্বাধীনতা যোদ্ধা এবং মিত্র ও শত্রুদের মুখগুলো যেন নতুন প্রজন্মের মানুষ চিনতে পারে। কিন্তু এই তালিকায় যেভাবে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয় এবং মাঠের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতায় আনতে হবে। এবং একই সঙ্গে এ ভুলের দায় তাদের নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সরকার ক্ষমতায় থাকার পর এখন এই বিতর্কিত তালিকার দায় কাউকে দেয়া যাবে না। কেননা এখন বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় নেই, সামরিক শাসনের কবল থেকে  মুক্ত স্বদেশ।

রাজাকারের তালিকাকে কেন্দ্র করে জাতির আবেগ অনুভূতি ও  ইতিহাসের সাথে যারা প্রতারণা  করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যাবস্থা নিতেই হবে। এটা রাজাকার রক্ষার ষড়যন্ত্র নাকি শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী চক্রান্ত? নাকি গোটা দেশ আওয়ামী লীগ হয়ে যাবার পরিণতি? এ অন্যায় যারাই করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। কেননা, তিনি আজ যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের এবং তাদের সন্তানদের মুখে উল্লাসের হাসি তুলে দিয়েছেন।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে