নাগরিক আইন নিয়ে অশান্ত ভারত

আহমদ রফিক

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক। ফাইল ছবি

বিজেপি তার দ্বিতীয় দফার ভারত শাসনে অঘটন ঘটিয়ে চলেছে। শুরুটা আসাম (অসম) নিয়ে। তাঁরা বলতে পারেন, বস্তুত বলেছেনও যে এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ঠিকই অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক নৈকট্যের যুগে খুব কম বিষয়ই বাস্তব বিচারে অভ্যন্তরীণ। কারণ বিশ্বায়নের যুগে, পারস্পরিক নিকট সম্পর্কের যুগে এক দেশের ঘটনা অন্য দেশের সমাজ ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ হলে তো কথাই নেই।

বিষয়টি ত্রিধাবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে আরো বড় বেশি রকম সত্য। এবং তা এ কারণে যে বিদেশি শাসনের চাতুর্যে এবং দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক বিরোধিতা ও তজ্জনিত সংঘাতের জেরে বঙ্গ-পাঞ্জাবসহ ভারত বিভাজন। সেই সঙ্গে বিদেশি শাসনের অবসান। কিন্তু এ বিভাজন ছিল কৃত্রিম, বিশেষ করে বঙ্গে-সিরিল র‌্যাডক্লিফের কলমের খোঁচায়।

ধর্মবিশ্বাসে ভিন্ন হয়েও বাংলায় বাঙালি যেভাবে পাশাপাশি বাস করছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত, তাদের কি দ্বিজাতিতত্ত্বের রাজনীতিতে বিভক্ত করা যায়? যায়নি। পাকিস্তানি মতাদর্শের প্রাথমিক পরাজয় এভাবে তার জন্মলগ্ন থেকেই। প্রথমত জিন্নাহ কথিত পাকিস্তানে তাদের প্রচারমাফিক সব ভারতীয় মুসলমানের ঠাঁই হয়নি। কয়েক কোটি মুসলমানকে বিভক্ত ভারতে (জিন্নাহর ভাষায় হিন্দুস্তানে) থেকে যেতে হয়েছে। এটা পাকিস্তানি নীতির বরখেলাপ।

একই অবস্থা বা দুর্দশা বঙ্গের। পশ্চিমবঙ্গে যেমন বহুসংখ্যক মুসলমান থেকে গেছে, তেমনি পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে অমুসলিম জনগোষ্ঠী। জিন্নাহর কৃত্রিম পাকিস্তানি মতাদর্শ তথা দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যর্থতা এভাবে ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকেই স্পষ্ট। রাজনৈতিক স্বার্থপরতার জেদ, সংকীর্ণ চিন্তা, বিদ্বেষ-বিরূপতার সাময়িক আগুনে পুড়েছে শুভ মানসিকতা। কিন্তু সহাবস্থান পোড়াতে পারেনি রাজনৈতিক বিভাজন।

তবু এর দুর্ভাগ্যজনক দিকটি হলো তৎকালীন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তানি আতঙ্কে দেশভাগের প্রথম দিকেই সচ্ছল মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান হিন্দু সম্প্রদায়ের গরিষ্ঠ অংশ পূর্ববঙ্গ থেকে বাস্তুভিটা ত্যাগ করে কলকাতামুখী রাজধানী নগরীর প্রতি মুগ্ধতাও সম্ভবত একটি কারণ ছিল। এটা ছিল তাদের ভুল সিদ্ধান্ত। নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবর্গীয় স্বধর্মীদের পেছনে ফেলে রেখে স্বদেশ ত্যাগ। তবু শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একাংশ পিতা-পিতামহের ভিটায় থেকে যায়। তখনকার দেশান্তরের এই বাস্তব ঘটনাগুলো একালের অমিত শাহদের সম্ভবত জানা নেই বা জানা থাকলেও রাজনৈতিক স্বার্থে তা ইতিহাসের পরিত্যক্ত কাগজস্তূপে ফেলে রাখা হয়েছে।

শুধু উদ্দেশ্যমূলকভাবে পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু হ্রাসের হিসাবটা তুলে ধরা হয়েছে নাগরিকত্ব আইনের যথার্থতা প্রতিপন্ন করতে। পাকিস্তানের বিপরীতে ভারতীয় মনীষীদের বহুকথিত বহুত্ববাদ এবং স্বাধীন ভারতীয় সংবিধানের সেক্যুলারিজম ও নাগরিক অধিকারগুলোকে বাতিল করার অশুভ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রণীত বিজেপির নাগরিক আইন।

দুই.

আমরা এর আগে একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছি যে গোটা বিষয়টি বিজেপির তাত্ত্বিকদের বিভাজনমুখী অশুভ পরিকল্পনার অংশবিশেষ মাত্র। সাম্রাজ্যবাদী শাসনামলের একটি বিভ্রান্তির জের টেনে তার শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটানো সুস্থ মানসিকতা ও শুভবুদ্ধির পরিচায়ক নয়। কৌশলী রাজনীতির টানে ভোটবাক্স জয় করে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা মানবিক ভবিষ্যৎ গড়ার পক্ষে যাবে বলে মনে হয় না।

সময় ও রাজনীতি এসবের প্রতিশোধ নেয়। যেমন নিয়েছে জিন্নাহর পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি। বিভাগপূর্ব ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি যেমন ছিল ঘটনাবহুল, তেমনি তাতে ছিল বহুমাত্রিক বিভ্রান্তি মানবিক চেতনা অগ্রাহ্য করে। পাকিস্তান এখনো সেই বিভ্রান্তির জের টেনে সহিংসতার আগুনে পুড়ছে।

দীর্ঘকাল পর সেক্যুলার সংবিধানের ভারত ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবাদী বিজেপির শাসনে সেই পথ ধরেছে, বাকি রয়েছে হিন্দুত্ববাদের পক্ষে সংবিধান সংশোধন করা। আমাদের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে বাংলাদেশ যখন প্রশ্ন তুলেছে তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন তাঁর বরাবরের মধুর ভাষ্যে, বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।

আসাম তাত্ক্ষণিকভাবে বিষয়টিকে থলে পুরে রেখেছে, কিন্তু বাতিল করেনি। অন্যদিকে অমিত শাহ থেকে উচ্চবর্গীয় বিজেপি নেতাদের যথারীতি ভাষণ, প্রচার, সব কিছুই তাদের হিন্দুত্ববাদী আদর্শের পক্ষে সরব ও সক্রিয়। সেক্যুলার গণতন্ত্রী ভারতকে হিন্দুত্ববাদী ভারতে পরিণত করাই বিজেপির পূর্বাপর রাজনৈতিক মতাদর্শগত উদ্দেশ্য। এখন ভোটের জোরে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা।

তিন.

তখনই বারবার বলা হচ্ছিল যে নাগরিকত্ব বাতিলের আইন, চিরুনিচেরা তল্লাশি সব রাজ্যেই চলবে। প্রান্তিক রাজ্যগুলোর ছিল এ সম্পর্কে নানামুখী প্রতিক্রিয়া। তবু কারো কারো ইচ্ছা-কল্পনা ছিল, এত সমালোচনার মুখে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কথা ভেবে মোদি তথা বিজেপি নাগরিকত্ব সংশোধন প্রস্তাবটিকে আইনি রূপ দেবে না।

এমন ভাবনায় ভুল ছিল। বাংলাদেশেরও মৌখিক ‘মধু’তে নিশ্চিত হওয়ার কথা ছিল না। বিপরীত চিন্তার সবার পাতে ছাই ঢেলে বিজেপি তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি। লোকসভা-রাজ্যসভা দুই কক্ষেই বিল পাস। প্রস্তাব আইনে পরিণত। ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য একটি কলঙ্কজনক কালো দিন—ভাষ্য সংবাদপত্র মহলের।

তবে বিজেপি সম্ভবত যেটা ভাবেনি, ভারতের রাজ্য থেকে রাজ্যে সেটাই ঘটে চলেছে। স্তব্ধ, নির্বাক বাংলাদেশের শাসনযন্ত্র, মনোযোগী দৃষ্টিতে অবস্থা দেখছে। আর যথারীতি বিচার-বিশ্লেষণে সক্রিয় ঢাকার সংবাদপত্র মহল খবরে, প্রতিবেদনে, এমনকি নিরপেক্ষ ভারতীয় সাংবাদিক কারো কারো মতামত প্রকাশে।

ভারতীয় রাজনীতির এ প্রতিবাদী অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের অসন্তুষ্ট রাজনীতি। আসামে যা জনগণের একাংশের ব্যাপক প্রতিবাদী বিক্ষোভ, পশ্চিমবঙ্গে তা সহিংস গণ-আন্দোলনে পরিণত। একটি তিন কলাম সংবাদ ঢাকার দৈনিকে ‘উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ, ট্রেনে আগুন’। বিশেষ তথ্যে বলা হয়েছে, ‘জেলায় জেলায় রেল ও সড়ক অবরোধ, মুর্শিদাবাদে পাঁচটি খালি ট্রেনে আগুন, হাওড়ায় ১৫টি বাসে আগুন।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীসহ বুদ্ধিজীবী ও সুধীমহলের মন্তব্য : আন্দোলন-বিক্ষোভ গণতান্ত্রিক অধিকার এবং তা সমর্থনযোগ্য; কিন্তু সহিংসতা নয়। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়তি হুমকি : সহিংসতা মেনে নেওয়া হবে না। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, আসাম থেকে ত্রিপুরা-ভারতের পূর্বাঞ্চলে নাগরিক আইন বিরোধী যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু, তা এখন রাজধানী নয়া দিল্লিকে সহিংসতায় স্পর্শ করেছে।

সাম্প্রদায়িক চরিত্রের এ আইন বিজেপির জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা তাদের বিচক্ষণ রাজনৈতিক চিন্তায় ছিল না। প্রতিবেশী দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি সংকীর্ণ মতাদর্শ পূরণে হাতছানির যে একটা বিপরীত দিক থাকতে পারে তা বিজেপি নেতৃত্ব হয়তো ভেবে দেখেনি। এ আইনের সংবেদী প্রতিক্রিয়ার একাধিক পার্শ্বমুখ স্বদেশ ও বিদেশকে স্পর্শ করছে। জাতিসংঘ এর প্রত্যক্ষ ধর্মীয় সম্প্রদায়বাদী দিকটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে, যা প্রকৃতপক্ষে মানবতাবিরোধীও বটে।

অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে ভারতের অতীব মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ভারতের কাশ্মীর নীতির পাশাপাশি এই নাগরিক আইনেরও বিরোধিতা করেছে এর অগণতান্ত্রিক ও মানবতাবিরোধী চরিত্রের কারণে। তারা ভারতীয় প্রশাসনকে তাদের উদ্বেগের কথা সুষ্ঠু ভাষায় জানিয়েছে। আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর দিল্লি সফর শেষ মুহূর্তে বাতিল করে পরোক্ষে বাংলাদেশের মনোভাব জানিয়ে দিয়েছে।

বিজেপির এই আইন ঘিরে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের ভূমিকা, তা এখন স্পষ্ট। একাধিক বিশ্লেষকের মতে, এতে রয়েছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের প্রতিক্রিয়ার এক দিক, অন্যদিকে ছোট বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ভারতের নাগরিকত্বহীন মুসলমানদের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা। এবং সেই সুবাদে দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক চালচিত্র বদলের নেতিবাচক সম্ভাবনা, যা বাংলাদেশের বর্তমান শাসকদের জন্যও বাঞ্ছনীয় হওয়ার কথা নয়।

এ আইনের বিরোধিতার দিকটিও তাই ভারতের রাজ্য থেকে রাজ্যে সম্প্রদায় থেকে সম্প্রদায়ে ভিন্নমাত্রিক। তাই এর নানামাত্রিক প্রতিক্রিয়া আসাম, ত্রিপুরা থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে দিল্লি পর্যন্ত বিভিন্ন চরিত্রে। তাই পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে দিল্লিতে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্র-ছাত্রীদের বিক্ষোভ মিছিল ও পুলিশের সঙ্গে তাদের খণ্ডযুদ্ধ। আবার এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল উত্তরপ্রদেশের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। আসাম-ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ-বিহার হয়ে উত্তর প্রদেশে এ আইন সম্পর্কে বিপরীত প্রতিক্রিয়া, যা অবিশ্বাস্যই ঠেকছে।

কোণঠাসা হলেও হাবভাবে মনে হচ্ছে বিজেপি এ ব্যাপারে পিছু হটতে চাইছে না। তাই এমন বক্তব্য নাগরিকত্ব আইন প্রথম কার্যকর হবে পশ্চিমবঙ্গে। এবার কী করবেন মমতা? আপস সমঝোতা, নাকি লড়াই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে? সময় শিগগিরই তা বলে দেবে। আমাদেরও অপেক্ষা মমতার লড়াকু রাজনীতির বিচক্ষণতা দেখার জন্য।

লেখক : কবি, গবেষক ভাষা সংগ্রামী

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে