এই বছরটি প্রায় শেষ। অন্যদের কথা জানি না, আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে সামনের বছরটির জন্য অপেক্ষা করছি। তার প্রধান কারণ সামনের বছরটিকে আমরা টোয়েন্টি টোয়েন্টি বলতে পারব (যখন কেউ চোখে নির্ভুল দেখতে পারে সেটাকে টোয়েন্টি টোয়েন্টি ভিশন বলে!)। সামনের বছরটি নিয়ে আমরা নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা করছি; কিন্তু এই বছরটি কেমন গেছে? আমি একটা ছোট কাগজে বছরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার একটা তালিকা লিখতে গিয়ে দেখি, বেশির ভাগই মন খারাপ করা ঘটনা। কে জানে আমাদের মস্তিষ্ক হয়তো আনন্দের ঘটনা সহজেই ভুলে যায়, মন খারাপ করা ঘটনা না চাইলেও মনে থাকে।
যেমন ধরা যাক নুসরাতের ঘটনাটি। আমরা গল্প-উপন্যাস লেখার সময় বানিয়ে বানিয়ে নুসরাতের মতো চরিত্র তৈরি করি; কিন্তু সত্যি সত্যি যে আমাদের চারপাশের মানুষের মধ্যে নুসরাতের মতো তেজি মেয়েরা থাকে কে জানত? নুসরাতের ঘটনাটি যে খুব বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা তা কিন্তু নয়, প্রায় নিয়মিতভাবে আমরা খবরের কাগজে এ রকম খবর পড়ি, যেখানে একটা ছোট মেয়েকে ধর্ষণ করে মেরে মেলা হচ্ছে। এই ধর্ষক ও খুনিরা প্রায় সব সময়ই ধরা পড়ে যায়, তাদের বিচার হয়, শাস্তি হয়। তার পরও মেয়েদের ওপর নিষ্ঠুরতার ঘটনা কমছে না। আমি গবেষক নই, তার পরও মনে হয় ঘটনাগুলো বাড়ছে, কেন বাড়ছে আমরা জানি না। শুধু আমাদের দেশে বাড়ছে তা নয়, আমাদের পাশের দেশ ভারতে নারী ধর্ষণের ঘটনাগুলো রীতিমতো ভয়াবহ, ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’র বদলে নতুন বাক্য চালু হয়েছে—‘রেপ ইন ইন্ডিয়া’ (ভারতে অবস্থা সব দিক দিয়েই ভয়াবহ, তবে আমাদের দেশে সেটা নিয়ে সমালোচনা করলে ছাত্রলীগ এবং এক-দুজন মন্ত্রী খুব নাখোশ হন, কারণটা কী?)।
নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া খুব কষ্টের। বিএনপি-জামায়াত একসময় একেবারে সাধারণ নিরীহ মানুষকে পেট্রলবোমা দিয়ে পুড়িয়ে মারার ব্যাপারে খুব বড় এক্সপার্ট হয়েছিল। সে জন্য তাদের মনের ভেতর কখনো কোনো অনুশোচনা হয় কি না আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। সেই পুড়ে যাওয়া মানুষদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে আমাদের দেশে খুব ভালো বার্ন ইউনিট গড়ে উঠেছিল। তাই যখন কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় আগুনে পুড়ে একজন মারা গেল এং ৩৪ জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলো, তখন আমি ভেবেছিলাম তাদের প্রায় সবাই হয়তো বেঁচে যাবে। একেবারে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২২ জন মারা গেছে। একেবারে সাধারণ কম বয়সী শ্রমিক, মৃত্যু এসে তাদের যন্ত্রণার উপশম করে গেছে; কিন্তু তাদের আপনজনদের হাহাকারের দায়িত্ব কে নেবে? দুর্ঘটনার ওপর কারো হাত নেই; কিন্তু এই ঘটনাগুলো তো দুর্ঘটনা নয়। খবরের কাগজের খবর অনুযায়ী এই প্লাস্টিক কারখানার অনুমোদন পর্যন্ত ছিল না! আমরা কখনো রানা প্লাজার কথা ভুলব না; কিন্তু সেই ভয়াবহ রানা প্লাজার ঘটনার পর এখন আমাদের গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে নিরাপদ ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কেরানীগঞ্জের এই নিষ্ঠুর ঘটনার পর কি একই ধরনের ব্যাপার ঘটতে পারে না? শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সারা পৃথিবীর মাঝে না হোক, এ দেশের মাঝে নিরাপদ একটি কর্মক্ষেত্র হতে পারে না?
যে মৃত্যুগুলোর কথা আমরা সরাসরি দেখতে পাই, শুনতে পাই সেগুলো নিয়ে আমরা বিচলিত হই। কিন্তু যে মৃত্যুগুলোর কথা আমরা দেখতে পাই না, শুনতে পাই না সেগুলো নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। সে রকম মৃত্যু কিন্তু নিঃশব্দে ঘটে যাচ্ছে। তার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে পরিবেশদূষণ। আমরা যারা ঢাকা শহরে থাকি তারা সব সময়ই এই দূষণ দেখে বড় হয়েছি। আমরা সেটা প্রায় মেনেই নিয়েছিলাম, কখনো কল্পনা করিনি ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ আসলে সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে ভয়াবহ দূষণ। এখানকার বাতাস প্রতিদিন না হলেও মাঝে মাঝেই সারা পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাস। বিষয়টি জানার পর থেকে আমি প্রতিদিন বাতাসের খোঁজ নিই, শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে আমি এখন পর্যন্ত এক দিনও বাতাসকে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ‘ভয়ংকর অস্বাস্থ্যকর’ ছাড়া আর কিছু দেখিনি! যারা এই বাতাসে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে তারা যদি সড়ক দুর্ঘটনা বা অন্য কিছুতে মারা যেতে না পারে ভয়ংকর রোগে-শোকে ভুগে ভুগে মারা যেতে হবে। হাসপাতালের বিল দিতে দিতে পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে! আগে বায়ুদূষণের ব্যাপারটি নিয়ে কাউকে মাথা ঘামাতে দেখিনি। আজকাল মাঝে মাঝেই খবরের কাগজে এ নিয়ে আলোচনা হয়, এমনকি ঢাকার আশপাশে কিছু বেআইনি ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও খবর বের হয়েছে। ধুলাবালি কমানোর জন্য পানি ছিটানো হয় বলেও জেনেছি। একসময় ঢাকা শহর খুব পরিপাটি একটি শহর ছিল, আবার সেটি একদিন পরিপাটি শহর হবে সেই আশায় আছি। ইচ্ছে করলে এবং চেষ্টা করলে সবই সম্ভব। শুনেছি বড় শহরের মাঝে রাজশাহী শহরটি নাকি খুব সুন্দর একটা শহরে পরিণত হয়েছে। এই নতুন রূপ নেওয়ার পর দেখতে যাওয়া হয়নি। দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।
সারা বছর নানা রকম খারাপ খবরের শিরোনাম হয়ে যে সংগঠনটির নাম এসেছে, সেটি হচ্ছে ছাত্রলীগ। লিচু চুরি থেকে শুরু করে ধর্ষণ, খুন, নির্যাতন কিংবা শিক্ষককে পুকুরে ফেলে দেওয়া—তাদের কর্মকাণ্ডে কী নেই? আমি অনেকবার বলেছি, আমাদের অত্যন্ত দক্ষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশাল একটি অর্জনকে ছাত্রলীগের পুঁচকে একজন সদস্য কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় একটি অপকর্ম কর মুহূর্তে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। আমার নিজের চোখে দেখা সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ছিল যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা জয় বাংলা এবং জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে শিক্ষকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন দেওয়ার দাবি উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই নির্বাচন করাও হয়েছে। আমি একেবারে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি যদি সত্যি সত্যি ভালোভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের ভোট দিতে দেওয়া হয়, তাহলে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের কোনো নেতা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবে না। এ দেশে ছাত্রলীগ যে কী ভয়ংকর একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে আমরা সেটা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছিলাম যখন বুয়েটে আবরারকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। প্রশাসন তাদের পক্ষে, পুলিশ তাদের পক্ষে এবং তাদের কিছুই হবে না সে ব্যাপারে তারা এত নিশ্চিত ছিল যে তারা পালিয়ে যাওয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি।
ছাত্রলীগের সঙ্গে সঙ্গে এই বছর খবরের শিরোনাম হয়েছেন ভাইস চ্যান্সেলররা। শিক্ষা কিংবা গবেষণায় কোনো মহান অবদানের জন্য নয়, নানা ধরনের অপকর্মের জন্য। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ভাইস চ্যান্সেলর হচ্ছেন মোগল সম্রাটদের মতো। তাঁদের হাতে সব ক্ষমতা। যদিও নানা ধরনের কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর কথা; কিন্তু বাস্তবে সব কমিটি থাকে তাদের হাতের মুঠোয় এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেমন চলছে সেটি পুরোপুরি নির্ভর করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের ওপর। কাজেই সেই ভাইস চ্যান্সেলর মানুষটি যদি নিজে একজন শিক্ষাবিদ কিংবা গবেষক না হন, তাহলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে উঠবে কেমন করে। এ দেশের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এখানে ‘লবিং’ করে ভাইস চ্যান্সেলর হওয়া যায়। এই লবিং ভাইস চ্যান্সেলররা যখন ছাত্রলীগের গায়ের জোর নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালান, সেখানে আমরা কী আশা করতে পারি? আমাদের দেশে এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হয়ে উঠতে পারত। সেটি হয়নি, সেটি হবে তার কোনো সম্ভাবনাও দেখছি না। কী দুঃখের ব্যাপার!
আমাদের দেশের ভাইস চ্যান্সেলররা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে বিষয়গুলো অনুভব করতে পারেন না, আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কাজকর্মের সঙ্গে না থেকেও সেগুলো বুঝতে পারেন। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমি বেশ কয়েকবার মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছাকাছি বসে তাঁর নিজের মুখে বক্তব্য শুনেছি। আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের মাঝখানে তিনি সাধারণত একেবারে নিজের মতো করে কৌতুকের ভঙ্গিতে অনেক কথা বলেন। আমি একবার তাঁকে নিজের লেখাপড়া নিয়েও কৌতুক করতে শুনেছি। কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়া নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেগুলো যুগান্তকারী। আমি দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলাম বলে শুধু টাকার লোভের কারণে এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা কিভাবে এ দেশের ছেলে-মেয়েদের নির্যাতন করেন সেটা খুব ভালো করে জানি। সমন্বিত একটা ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে খুব সহজেই এ দেশের ছেলে-মেয়েদের অবিশ্বাস্য একটা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সেটি করা হচ্ছে না। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রথম এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন, যদিও এখন পর্যন্ত এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাবান ভাইস চ্যান্সেলর ও অধ্যাপকরা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে রাজি হচ্ছেন না। টাকার লোভ একজন মানুষকে কত নিচে নামাতে পারে সেটি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি শুধু যে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কথা বলেছেন তা নয়, তিনি সন্ধ্যাকালীন কোর্সের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা এর বিরুদ্ধে। কারণ তারা নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে তাদের শিক্ষকরা নিজেদের সত্যিকারে কোর্সগুলো না পড়িয়ে সন্ধ্যাবেলার অর্থকরী কোর্সগুলো পড়ানোর জন্য জীবন পার করছেন। আমি একধরনের কৌতূহল নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হয় সেটা দেখার অপেক্ষা করছি। এর মাঝেই সন্ধ্যাকালীন কোর্সের পক্ষে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু হয়েছে এবং আমার ধারণা, নানা ধরনের যুক্তিতর্ক দিয়ে সেটা শেষ পর্যন্ত বন্ধ করা হবে না। বাঘ একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়ে গেলে অন্য কিছু মুখে দিতে চায় না বলে জনশ্রুতি আছে। টাকাটাও সে রকম, একবার কেউ টাকার স্বাদ পেয়ে গেলে সেখান থেকে বের হওয়া যায় না।
এই বছর বারো মাসজুড়েই নানা ধরনের ঘটনা ঘটেছে; কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনা ঘটেছে একেবারে বছরের শেষ মাসের শেষ দিকে। একটি হচ্ছে রাজাকারের তালিকা, আরেকটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ‘বীরত্বগাথা’।
ইতিহাসে পাকাপাকিভাবে গেঁথে রাখার জন্য স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ দলিল। আমরা যারা একাত্তর দেখেছি তারা জানি, একাত্তরে নানা ধরনের স্বাধীনতাবিরোধী ছিল। কেউ কেউ রাজাকার, কেউ আলবদর, কেউ আলশামস, কেউ শান্তি কমিটির সদস্য, আবার কেউ হয়তো কোনো দলেই নাম লেখায়নি; তার পরও বড় ধরনের বিশ্বাসঘাতক যুদ্ধাপরাধী। এই নানা ধরনের নামের মাঝে রাজাকার নামটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে এবং আজকাল যেকোনো স্বাধীনতাবিরোধী মানুষ বোঝানোর জন্যই রাজাকার শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু যখন একটি ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করা হবে তখন কি তাদের ঐতিহাসিক পরিচয় দিয়ে পরিচিত করা উচিত নয়? তাদের মাঝে কেউ ছিল কাপুরুষ, কেউ ছিল নৃশংস। অপরাধের মাত্রাটিও কি এই তালিকায় উল্লেখ থাকতে পারত না?
কিন্তু রাজাকারের তালিকার এই বিষয়গুলো আমাকে কিংবা আমার মতো আরো অনেককে ক্ষুব্ধ করেনি। এত দিনে আমরা সবাই জেনে গেছি যে এই তালিকায় শুধু রাজাকারের নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের নামও আছে। এই তালিকাটি অসম্পূর্ণ হতে পারত, যেখানে কোনো রাজাকারের নাম তোলা হয়নি কিংবা তাদের নাম ভুল বানানে লেখা হতে পারত, তাদের গ্রামের নামে ত্রুটি থাকতে পারত; কিন্তু এ ছাড়া আর অন্য কিছু কারো কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। যে রাজাকার নয় তার নাম ভুলে লেখা হয়ে থাকলেও আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হতাম। কারণ এ দেশে রাজাকার শব্দটি হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ গালি, একজন মানুষকে রাজাকার বলে গালাগাল করার চেয়ে বড় কোনো অপমান হতে পারে না। সেই অপমানটি করা হয়েছে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে, এর চেয়ে বড় দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে? আমরা সবাই বুঝতে পারছি এ বিষয়টি মোটেও নিরীহ একটু ভুল নয়, এটি ইচ্ছাকৃত এবং এটি করা হয়েছে রাজাকারের তালিকাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। এর পর থেকে যতবার যতভাবে এই তালিকা তৈরি করা হবে, ততবার সবার মনে একটি প্রশ্ন থেকে যাবে যে এটাও হয়তো সত্যিকারের তালিকা নয়। সবচেয়ে দুঃখের কথা, এই তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে কেউ এই এত বড় অন্যায়ের দায় নিচ্ছে না, একে অন্যকে দোষ দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমরা কোনো দিন জানতে পারব না কেমন করে এত বড় একটি অন্যায় করা হলো বিজয়ের মাসে দেশের সবচেয়ে সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে!
এই বছরের দ্বিতীয় ঘটনাটিও কম হৃদয়বিদারক নয়। আমরা সবাই জানি, আজকাল যেকোনো একজন মানুষের সর্বনাশ করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে মানুষটিকে জামায়াত কিংবা শিবির হিসেবে পরিচিত করে দেওয়া। সরকারের বিরুদ্ধে কিংবা প্রচলিত পদ্ধতির বিরুদ্ধে কথা বললেও আজকাল এই ঝুঁকিটি নিতে হয়। কত সহজে কত সাধারণ মানুষকে এই অপবাদটি নিতে হচ্ছে তার হিসাব নেই। এভাবে চলতে থাকলে একটি সময় আসবে যখন যারা সত্যিকারের জামায়াত-শিবির হয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যাচ্ছে, তাদের আর আলাদা করা যাবে না।
এ দেশে কারা মুক্তিযুদ্ধকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে? একেবারে কোনো রকম দ্বিধা না করে বলে দেওয়া যায় যে সেটি ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংগঠনের হাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ডাকসু ভিপি এবং তার সঙ্গে অন্য কিছু ছাত্রকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সদস্যরা। মুক্তিযুদ্ধ শব্দটিকে এর চেয়ে বড় অবমাননা করা কি সম্ভব? এ দেশের মানুষ কি নিজের অজান্তেই ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি এখন খুব বড় অন্যায়, অনৈতিক ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে যুক্ত হতে দেখছে না? আমরা কেমন করে এটি ঘটতে দিচ্ছি?
এই অর্বাচীন তরুণরা কি জানে তারা কেমন করে এ দেশের সবচেয়ে মহান অবদানটির কত বড় অসম্মান করেছে?
২.
কেউ যেন মনে না করে ২০১৯ সালে বুঝি শুধু খারাপ খারাপ ঘটনা ঘটেছে, সেটি মোটেও সত্যি নয়। সবাই কি জানে আমাদের দেশের শিশুরা আন্তর্জাতিক রোবট-সংক্রান্ত প্রতিযোগিতায় কতগুলো সোনা, রুপা ও ব্রোঞ্জপদক এনেছে?
আমরা আমাদের এই সোনার শিশুদের মুখের দিকে তাকিয়েই সব দুঃখ-কষ্ট, গ্লানি ও অপমানের কথা ভুলে যেতে চাই।
লেখক : কথাসাহিত্যিক। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
- আরও পড়ুন >> ডিসেম্বরের স্মৃতি