সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরুর এক সপ্তাহ আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, দেশে কোনো ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ (বন্দিশিবির) নেই। অথচ আসামের গোয়ালপাড়ায় ঘন বন সাফ করে সাতটি ফুটবল মাঠের সমান বন্দিশিবির নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেখানে আছে আরও পাঁচটি বন্দিশিবির।
ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, এনআরসি আর সিএএ অনুযায়ী যারা আর ভারতের নাগরিকত্ব দাবি করতে পারবেন না তাদের মধ্যে অন্তত ৩ হাজার জনকে বৃহত্তম ওই বন্দিশিবিরে রাখা হবে। আসাম রাজ্য সরকারের একটি সূত্র জানাচ্ছে, আগামী বছরের মার্চের মধ্যেই ভারতের বৃহত্তম এই বন্দিশিবিরের কাজ শেষ হবে।
আসামের প্রাদেশিক রাজধানী গোহাটি থেকে ১২৯ কিলোমিটার দূরের গোয়ালপাড়া মাতিয়া নামক স্থানে ২৫ বিঘা জমির উপর ৪৬ কোটি রুপি ব্যয়ে ওই বন্দিশিবির নির্মাণ করা হচ্ছে। গোটা বন্দিশিবিরের চারপাশে তোলা হচ্ছে ২০ থেকে ২২ ফুট উঁচু দেয়াল। এছাড়া সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন থাকবে।
নির্মাণের দায়িত্বে থাকা সাইট সুপারভাইজার মুকেশ বসুমাতারি আনন্দবাজারকে বলেন, এ মাসের (ডিসেম্বরের) মধ্যে আমাদের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে কাজ বন্ধ থাকায় তাতে খানিকটা সময় বেশি লাগছে। কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য কাঁচামাল সময়মতো পৌঁছাবে কিনা, তা নিয়েই এখন আমি বেশি চিন্তিত।
মুকেশ বসুমাতারি জানালেন, গোয়ালপাড়ার ওই বন্দিশিবিরে চার তলা মোট ১৫টি বাড়ি বানানো হবে। প্রত্যেকটি বাড়িতে থাকবেন কমপক্ষে ২০০ জন মানুষ। এছাড়া সেখানে নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য আবাসস্থল, একটি হাসপাতাল, একটি স্কুল, সরকারি, রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর ও কমিউনিটি হল।
এছাড়া বন্দিশিবিরটির অন্যত্র নির্মাণ করা হচ্ছে টয়লেট কমপ্লেক্স। তার ৬ট ব্লক বানানো হচ্ছে। প্রত্যেকটি ব্লকে থাকছে ১৫টি টয়লেট এবং ১৫টি বাথরুম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আসামের এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে আসামের কারাগারে থাকা ৯০০ বন্দীকে এই বন্দিশিবিরে আনা হবে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, আসামের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়া অনেক মানুষ এই বন্দিশিবির নির্মাণের সঙ্গে জড়িত। নিজেদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে না পারলে এই শ্রমিকদের অনেকেরই ঠাঁই হতে পারে এই বন্দিশিবিরে। এছাড়া সম্প্রতি পাস হওয়া নাগরিকত্ব আইনে বাদ পড়া মুসলিমদেরও পাঠানো হবে এসব বন্দিশিবিরে।
গণমাধ্যমগুলো বলছে, গোয়ালপাড়ার কাছাকাছি নির্মাণাধীন এই বন্দিশিবিরসহ মোট ১০টি বন্দিশিবির নির্মাণের পরিকল্পনা আছে ভারত সরকারের। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো আরও জানিয়েছে, বন্দিশিবিরগুলোকে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হবে। এছাড়া উঁচু দেয়াল টপকে পালাতে যাতে না পারে তাই থাকবে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।
বন্দিশিবির নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখতে সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক মানুষ সেখানে ভীড় করছেন। ওই এলাকার চারপাশে বসেছে বেশ কিছু প্রচুর চা ও খাবারের দোকান। অনেকে আবার বলছেন, বন্দিশিবির চালু হলে সেখানে কাজ জুটবে আশপাশের গ্রামবাসীদের।
স্থানীয় বাসিন্দা বিপুল কলিতা বলেন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর কাজ নিশ্চয়ই জুটবে আশপাশের গ্রামের মানুষদের।
গত আগস্টে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) অনুযায়ী আসামের ১৯ লাখ মানুষ তাদের নাগরিকত্ব হারিয়েছেন। রাজ্যটির মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ রাষ্ট্রহীন এই মানুষকগুলোকে এসব বন্দিশিবিরে রাখা হবে।
আসামে রাজ্য সরকারের ক্ষমতাও বিজেপির হাতে। রাজ্যটির ছয়টি বন্দিশিবির বন্দী থাকাদের মধ্যে ইতোমধ্যে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কর্ণাটকেও বন্দিশিবির তৈরির কাজ শুরু হয়েছে বলে সেখানকার স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে।
২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে আসামের গোয়ালপাড়া, কোকড়াঝাড়, জোরহাট, ডিব্রুগড়, তেজপুর ও শিলচরে মোট ৬টি বন্দিশিবির নির্মাণ করা হয়। এনআরসি অনুযায়ী যারা নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে পারেননি তাদেরকে এসব বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়। তাদেরকে বলা হচ্ছে ‘ডি-ভোটার।’
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ৩০ বছর চাকরির পর অবসর নেয়া মুসলিম ধর্মাবলম্বী সানাউল্লাহ নাগরিকত্ব হারিয়েছেন গত মে মাসে। বন্দিশিবিরের দুর্বিষহ জীবন নিয়ে তিনি বলেন, একটা ঘরে ৪০ থেকে ৪৫ জনকে রাখা হয়। জায়গার অভাবে রাতে মেঝেতে শুতে হয়। বাথরুমও খুব নোংরা। আর যে খাবারদাবার দেয়া হয় তা খাওয়ার অযোগ্য।
গত ৩১ আগস্ট আসামের চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ১৯ লাখ ৬ হাজার মানুষ। তালিকা প্রকাশের পর এই বিশালসংখ্যক মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। এদিকে সম্প্রতি পাস নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে অনেক মুসলিম নাগরিকত্ব হারাবেন। তাদেরও ঠাঁই হবে এসব বন্দিশিবিরে।