বিশ্বের তাবৎ মানুষ এখনো হয়তো রুদ্ধ নিঃশ্বাসে ভাবছে ইরাকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ম্যাড অ্যাডভেঞ্চার এবং ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে অবৈধভাবে হত্যার পর কী ঘটে? হয়তো বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে অথবা উঠতে যাচ্ছে। জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তাও বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ড অবৈধ এবং আন্তর্জাতিক আইন-কানুন ভঙ্গ করেছে। ইরান স্বাভাবিকভাবেই এই নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করেছে এবং বলেছে, এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ তারা নেবেই। বিশ্ববাসীর এখানেই মহাভয়, ইরান এই প্রতিশোধ নিতে গেলে একটা মহাযুদ্ধ বেধে যায় কি না।
ইমপিচমেন্ট থেকে বাঁচা এবং চলতি বছর নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সহজ জয়লাভের জন্য ট্রাম্প এ কাজটি করেছেন। এখন প্রশ্ন, ট্রাম্পের অনুরূপ ম্যাডনেসের পরিচয় দিয়ে ইরানও বিশ্বকে একটি যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেবে কি না! সোলাইমানি হত্যার তিন দিন পরও ইরান সরকার প্রতিশোধ গ্রহণের ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও কোনো হঠকারী পাল্টা হামলা না চালানোয় মনে হয় তেহরানকে উসকানি দিয়ে ট্রাম্প সফল হননি। তেহরান ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে। এরপর মধ্যপ্রাচ্যে বা বিশ্বের যেকোনো স্থানে এমন স্ট্র্যাটেজিক আঘাত হানবে, যা বড় যুদ্ধ বাধাবে না, কিন্তু ট্রাম্পের দম্ভের উপযুক্ত জবাব দেবে।
সোলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে ব্রিটেনের বিরুদ্ধেও ইরান আঘাত হানতে পারে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণের পর সানডে টাইমস পত্রিকায় খবরে বলা হয়েছে, ইরান এই হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ৩৫টি টার্গেট ঠিক করেছে। এগুলো সবই মার্কিন ও ব্রিটিশ টার্গেট। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হলিডে করতে গিয়েছিলেন ক্যারিবিয়ান দ্বীপে। তিনি লন্ডনে ফিরেই বাগদাদে মোতায়েন ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ও কূটনীতিকদের রক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার ব্যবস্থায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্কের কাগজগুলো পড়লে মনে হয়, মার্কিন পেন্টাগন সুনিশ্চিত যে ইরান তাদের সহজে ছেড়ে দেবে না। কিন্তু তারা এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না, বাগদাদে মোতায়েন পাঁচ হাজার মার্কিন সৈন্যের (এখন আরো তিন হাজার বাড়ানো হয়েছে) ও মার্কিন ও ব্রিটিশ কূটনীতিকদের ওপর এই হামলা চালানো হবে, না সাইবার অ্যাটাক, আন্তর্জাতিক জলপথ বন্ধ করাসহ সর্বত্র মার্কিন ও ব্রিটিশ স্বার্থের ওপর কুশলী আঘাত হানা হবে।
পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ইরানের প্রতিশোধাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে আমেরিকার সঙ্গে তার যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। কিন্তু এই যুদ্ধ হবে প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্রের যুদ্ধ বা কনভেনশনাল ওয়ার। এই যুদ্ধ দীর্ঘকাল চলতে পারে। কোনো পক্ষই জয়ী হবে না। কিন্তু এই যুদ্ধ বা বিবাদ মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির ভারসাম্যে এমন পরিবর্তন আনবে, যা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য ও দস্যুবৃত্তির অবসান ঘটাবে। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধে যেমন মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের অবসান হয়েছিল, তেমনি এবার ট্রাম্পের ম্যাড অ্যাডভেঞ্চারে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার অবসানের সূচনা হতে পারে।
অনেক হম্বিতম্বি করেও কোরিয়া এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা যেমন আণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেনি, তেমনি এখনো ইরানের বিরুদ্ধে আণবিক অস্ত্র ব্যবহারে সক্ষম হবে না। আণবিক অস্ত্রের অধিকারী চীন ও রাশিয়া এখনো বর্তমান ওয়াশিংটন-তেহরান বিবাদে সরাসরি তেহরানের পক্ষ গ্রহণ করেনি; কিন্তু ট্রাম্প আণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে চাইলে তাদের পক্ষে ইরানের পক্ষাবলম্বন ছাড়া উপায় থাকবে না। তা ছাড়া ইরানের হাতেও প্রাথমিক ধরনের আণবিক অস্ত্র নেই তা নয়। ফলে ট্রাম্পকে ইরানের বিরুদ্ধে আণবিক অস্ত্র ব্যবহারের খোয়াব দেখা ত্যাগ করতে হবে।
ইরান ও আমেরিকার সম্ভাব্য যুদ্ধ যদি কনভেনশনাল ওয়ারে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে আমেরিকার জয়লাভের সম্ভাবনা নেই। সামরিক শক্তিতে এত বলীয়ান হওয়া সত্ত্বেও কোরিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা জয়ী হয়নি। ছয় বছরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হ্যানয় থেকে লেজ গুটিয়ে পালাতে হয়েছিল। গালফ যুদ্ধও অমীমাংসিত রয়েছে। আমেরিকা জয়ী হয়নি। ইরানের সঙ্গেও আমেরিকার যুদ্ধে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম, যা ঘটবে, তা হলো দীর্ঘস্থায়ী হামলা-পাল্টা হামলা। ইরান যুদ্ধবিধ্বস্ত হবে, আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে তার আধিপত্য হারাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সম্পর্কে যেমন বলা হয়, চার্চিল যুদ্ধে জিতেছিলেন, কিন্তু সাম্রাজ্য হারিয়েছিলেন। তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা জয়ী হতে পারলেও সাম্রাজ্য হারাবে।
সাদ্দামের সঙ্গে যুদ্ধে আমেরিকা তাঁকে হত্যা করেছে, বাগদাদ ধ্বংস করেছে, ইরাক দখল করেছে। কিন্তু যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি। বাগদাদে তাঁবেদার সরকার বসিয়ে, হাজার হাজার সেনা মোতায়েন রেখে কোনো সাফল্য লাভ করেনি। ইরাকের জনগণের মধ্যে মার্কিন বিরোধিতা বেড়েছে। বাগদাদে মার্কিন সেনা প্রহরায় যে গ্রিন জোন রয়েছে, তাতে মার্কিন দূতাবাসে ইরাকি জনগণ বিক্ষোভ দেখিয়েছে ও হামলা চালিয়েছে। শুধু ইরাকে নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এখন সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। তার পেছনে রয়েছে রাশিয়া। ইরান এখন রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে মিলে যুক্ত সামরিক মহড়া চালাচ্ছে। ইরানের ভয়ে এখন সৌদি আরব ও ইসরায়েল কম্পিত। তাদের যুক্ত প্রচেষ্টা আমেরিকাকে দিয়ে ইরানের শক্তি ধ্বংস করা এবং সেখানে রেজিম চেঞ্জ করা।
আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলে এই ষড়যন্ত্র তো সফল হবে না। বরং চক্রান্তটি বুমেরাং হবে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের জন্য। ইরান আক্রান্ত হলে মার্কিনবিরোধী মনোভাব সারা আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। মার্কিনবিরোধী স্লোগান দিয়ে আরবরা রাস্তায় নামবে। আরব বসন্তের মতো এই বিক্ষোভ ভয়ানক ধাক্কা দেবে মার্কিন তাঁবেদার সরকারগুলোকে। সৌদি আরবে এরই মধ্যে একটি শক্তিশালী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে। তারা রাজতন্ত্রের ঘোরবিরোধী। নারী মুক্তির আন্দোলন এখন সৌদি আরবে প্রবল। ট্রাম্প স্বীকার করেছেন, মার্কিন সামরিক পাহারা না থাকলে হাউস অব সৌদ এক মুহূর্তও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন একটি যুদ্ধে সারা অঞ্চলে প্রবল আমেরিকাবিরোধী গণবিক্ষোভের ফলে সর্বপ্রথম ভেঙে পড়তে পারে সৌদি রাজতন্ত্র। এমনিতেই খাশোগি হত্যাকাণ্ডে এই রাজতন্ত্রের অবস্থা ভালো নয়।
আমেরিকা আগে কখনো একা যুদ্ধে নামার সাহস দেখিয়েছে তার কোনো প্রমাণ নেই। কোরিয়া যুদ্ধে বেআইনিভাবে জাতিসংঘের পতাকা ব্যবহার করেছে এবং তুরস্কসহ কয়েকটি মিত্র দেশকে সঙ্গী করেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ফ্রান্সের সঙ্গী হয়েছে এবং ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর সমর্থন পেয়েছে। গালফ যুদ্ধে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কোয়ালিশন গঠন করেছে। এখন ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলে ট্রাম্পের পক্ষে মিত্র সংগ্রহ সম্ভব হবে কি? ভারতকে ইরানের বিরুদ্ধে তাতাতে গিয়ে ট্রাম্প ব্যর্থ হয়েছেন। এবার একমাত্র ব্রিটেন, ইসরায়েল ও সৌদি আরব ছাড়া আর কারো এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্যবদ্ধ সমর্থনও তিনি পাবেন কি? যদি পান তা হবে মৌলিক সমর্থন। একা আমেরিকান সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে নামালে খোদ ট্রাম্প সাহেবের দেশেই গণবিক্ষোভ গড়ে উঠবে। আগামী নির্বাচনের জয়লাভের আশা বিনাশ হবে।
ইরানকে একঘরে করতে গিয়ে ট্রাম্প তেহরানের বর্তমান সরকারের একটা বিরাট উপকার করেছেন। মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশটিতে সাধারণ মানুষের জীবন কিছুটা হলেও দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে এবং সরকারবিরোধী মনোভাবের প্রকাশও ইদানীং দেখা গেছে। আমেরিকা কাসেম সোলাইমানির মতো জনপ্রিয় ব্যক্তিকে হত্যা করে ইরানের মানুষকে আবার এক করে দিয়েছে। কাসেম সোলাইমানির জানাজায় জনতার ভিড়ে তিল ধারণের স্থান ছিল না। আলজাজিরার খবরে এ দৃশ্য দেখানোর পর বলা হয়েছে, ‘ইরানে এটা একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। পশ্চিমা মিডিয়ায়ই বলা হয়েছে, ইরানের মানুষের এই শোক মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া-সুন্নি-নির্বিশেষে সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলবে।
১৯৫৬ সালে মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল নাসেরকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের লক্ষ্যে সুয়েজ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি ইডেন যেমন মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়েছিলেন, এবার ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেব বিলীয়মান মার্কিন আধিপত্যের অবসান ঘটান কি না তা দেখার রইল।
পশ্চিমা মিডিয়াগুলো যথারীতি কাসেম সোলাইমানিকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধ বলে প্রচারের চেষ্টা করছে। এই প্রচারণা সারা মধ্যপ্রাচ্যে নিহত জেনারেলকে হিরো বানিয়েছে। মৃত সোলাইমানি এখন জীবিত সোলাইমানির চেয়ে আরো শক্তিশালী হবেন। তাঁকে হত্যা করে ট্রাম্প সাহেব মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে শক্তির যে ভারসাম্য রয়েছে, তাতে পরিবর্তন ঘটানোর সূচনা করলেন। ইরান ও আমেরিকার মধ্যে এই সংঘাতে গালফ যুদ্ধের পরিণতির মতো মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বাড়বে, লাভবান হবে রাশিয়া। এরই মধ্যে এক ব্রিটিশ রাজনীতিক সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘ইরান নয়, পশ্চিমা স্বার্থ ও আধিপত্যের প্রধান শত্রু রাশিয়া।’ এবারের সংকটেও মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার প্রভাব বাড়বে।
- আরও পড়ুন >> বিদায়ি বছরের রাজনৈতিক সালতামামি
রাশিয়া ও চীন ট্রাম্পের ইরানবিরোধী যুদ্ধপ্রচেষ্টায় এখন পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ ছাড়া কিছু করেনি। কিন্তু ইরান সরাসরি আক্রান্ত হলে তারা চুপ থাকবে না। সিরিয়াকে মার্কিন হামলার মুখে রাশিয়া যেমন সামরিক হস্তক্ষেপ দ্বারা বাঁচিয়েছিল, ইরানকে সাহায্য করার জন্য তারও বেশি সামরিক কৌশল তারা গ্রহণ করতে পারে। লেবাননে, ফিলিস্তিনে, ইরাকে, লিবিয়ায় গেরিলা শক্তিগুলো আমেরিকার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ও সক্রিয় হবে। তাদের হাতে এখন আধুনিক মারণাস্ত্রও আছে। সুতরাং ইসরায়েলকে দিয়ে এবার তাদের ঠেকানো যাবে না। ট্রাম্প সাহেব কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার দ্বারা সাপের ঝুড়ির ডালা খুলেছেন। এই সাপের দংশন থেকে তিনি নিজে বাঁচেন কি না এই প্রশ্নটির জবাব পেতে বেশি দেরি হবে না।
লন্ডন, সোমবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২০