বিডিআর বিদ্রোহ : প্রকাশের অপেক্ষায় ২৯ হাজার পৃষ্ঠায় পূর্ণাঙ্গ রায়

মত ও পথ প্রতিবেদক

বিডিআর বিদ্রোহ
ফাইল ছবি

পিলখানায় বহুল আলোচিত বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত এ মামলার ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায় এখন প্রকাশের অপেক্ষায়।

প্রায় দুই বছর আগে ঘোষিত রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি আজ মঙ্গলবারই প্রকাশ হতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক জানান, হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চের বিচারপতিদের দুই বিচারপতি রায়ে স্বাক্ষর করেছেন। অপর বিচারপতির স্বাক্ষরের পরপরই রায় প্রকাশ করা হবে।

জানা গেছে, বিশ্বে আলোচিত মামলাগুলোর মধ্যে আসামির দিক থেকে এবং রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা বিবেচনায় সবচেয়ে বড় মামলা এটি। বিচারিক আদালতে রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিলের ওপর শুনানি নিয়ে রায়ও ঘোষণা হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন দেশি-বিদেশি মামলার রায় পর্যালোচনার পর হাইকোর্টের রায় লেখা শেষ করা হয়েছে। এখন বৃহত্তর বেঞ্চের বিচারপতিরা স্বাক্ষরের পর পূর্ণাঙ্গ রায়টি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।

হাইকোর্টের বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর এ রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্ট রায়ে ১৩৯ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। এই রায় প্রকাশের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বিচারিক আদালতের দেয়া রায়ের অনুমোদন প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে।

জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি মো. শওকত হোসেন মূল রায় লিখেছেন। তিনি প্রায় সাড়ে ১১ হাজার পৃষ্ঠার রায় লিখে বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতির কাছে পাঠান। এরপর বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী পৃথকভাবে তার অংশ লেখেন। তিনিও প্রায় ১৬ হাজার পৃষ্ঠা লিখেছেন। এই দুই বিচারপতির সম্মিলিত রায় ২৭ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠা। এরপর বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার লিখেছেন সাড়ে ৫০০ পৃষ্ঠার ওপর। এই তিনজনের লেখা রায় একত্র করে তা চূড়ান্ত আকারে প্রকাশ করা হবে।

কী হতে পরে রায় প্রকাশের পরবর্তী প্রক্রিয়া

নিয়ম অনুযায়ী হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবেন আসামি ও রাষ্ট্র- উভয়পক্ষই। এরপর আপিলের বিচারের মধ্য দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন করা হবে। যদিও আপিল বিভাগের রায়ের পর ওই রায়ের রিভিউ আবেদন করার সুযোগ থাকবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো সুযোগ থাকবে না।

নৃংশস হত্যার কালো দিন

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের সদরদফতর পিলখানা রক্তে রঞ্জিত করে একই বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য। তাদের হাতে দেশের মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে প্রাণ দিতে হয়। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় দুটি ভাগে বিচার কাজ চলছে। এরই মধ্যে হত্যার বিচার শেষ পর্যায়ে। হত্যার অভিযোগে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে বিচার সম্পন্ন হয়েছে। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

পিলখানা হত্যা মামলা লালবাগ থেকে নিউমার্কেট থানায়

পিলখানা হত্যার ঘটনায় ২০০৯ সালের ৪ মার্চ লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নবজ্যোতি খীসা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলাটি পরে নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর হয়। মামলায় তৎকালীন বিডিআরের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল আলমসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি দেখানো হয় প্রায় এক হাজার বিডিআর জওয়ানকে।

দুই মামলায় সিআইডির চার্জশিট দাখিল

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি তদন্ত শেষে ২০১০ সালের ১২ জুলাই হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়। হত্যা মামলায় ৮২৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। একইসঙ্গে ৮০১ জনকে আসামি করে বিস্ফোরক আইনে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।

বিচারিক আদালতে রায় ঘোষণা

হত্যা মামলায় রাষ্ট্র ও আসামি- উভয়পক্ষের শুনানি এবং বিচার শেষে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বিচারিক আদালত রায় দেন। তৎকালীন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আক্তারুজ্জামান (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারপতি) বহুল আলোচিত এ মামলায় ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। বেকসুর খালাস দেন ২৭৮ জনকে।

হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল আবেদন রায়

রায় ঘোষণার পর বিচারিক আদালত থেকে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পাঠানো হয়। আর কারাবন্দি আসামিরাও আপিল করেন। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও আপিল করা হয়। সব আবেদনের শুনানির পর হাইকোর্ট বিচার শেষে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর রায় দেন।

হাইকোর্টের রায়ে বিচারিক আদালতের রায়ের ১৫২ জন ফাঁসির আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আটজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও চারজনকে খালাস; যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল; যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১২ জনকে খালাস এবং খালাসপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে ৩৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া বিচারিক আদালত ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিলেও হাইকোর্ট ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন।

বিডিআর থেকে বিজিবি

ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ‘বিডিআর’ এর নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) করা হয়।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে