জাতির জীবনে নতুন জীবনীশক্তি সঞ্চারণ করার জন্য মুজিববর্ষ উদযাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে জাতিকে নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ মুজিববর্ষ।
আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে গত বছর ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার চতুর্থবার শপথ নেওয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি।
ভাষণের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার-নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদ এবং ২-লাখ নির্যাতিত মা-বোনকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানান। সালাম জানান মুক্তিযোদ্ধাদের।
একই সঙ্গে স্মরণ করেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের শিকার বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য ও অন্য শহীদদের। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ও গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক হত্যার শিকার ব্যক্তি ও তাদের স্বজনদের উদ্দেশে সমবেদনা জানান তিনি।
২০২০ সালকে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বছর হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে বলেন, এ বছর উদযাপিত হতে যাচ্ছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। আগামী ১৭ মার্চ বর্ণাঢ্য উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার শুভ সূচনা হবে। আমরা ইতোমধ্যে ২০২০-২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছি।
২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠানমালা যুগপৎভাবে চলতে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই উদযাপন শুধু আনুষ্ঠানিকতা-সর্বস্ব নয়, এই উদযাপনের লক্ষ্য জাতির জীবনে নতুন জীবনীশক্তি সঞ্চারিত করা; স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে জাতিকে নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়া।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে একটানা সরকার পরিচালনা করছে। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তারা সরকার পরিচালনা করছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর সে লক্ষ্য হলো সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং তাদের জীবনমানের উন্নয়নসহ সবার মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানের ২৪ বছরের শোষণ এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পোড়ামাটি নীতির ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত অকাঠামো ও অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে উঠে এসেছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের অগ্রগতি থেমে যায়।
তিনি বলেন, পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলোর জনবিচ্ছিন্নতা, লুটপাট ও দর্শনবিহীন রাষ্ট্র পরিচালনা বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাহীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছিল ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং ভিক্ষুক-দরিদ্র-হাড্ডিসার মানুষের দেশ হিসেবে।
এরপর ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথম সরকার গঠন করে। তখন দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৫৫ শতাংশ। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আমরা দারিদ্র্য বিমোচনে বেশ কিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করি, যা প্রান্তিক মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে। …কৃষক ও কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণের ফলে দেশ দ্রুত খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে। পাশাপাশি আমরা বিভিন্ন খাতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা গ্রহণ করি যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামাত আবার ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা বলেন, শুধু রাজনৈতিক কারণে বহু চলমান উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত করে দেওয়া হয়। ‘হাওয়া ভবন’ খুলে অবাধে চলতে থাকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট। তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ২০০৭ সালের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। বর্তমানে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামাত এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের আর্থিক ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা কাটিয়ে এবং সেই সময়কার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করে আমরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় এক নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হই। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে একটি সুপরিচিত নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার অর্জনের পাশাপাশি নানা সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে।
তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, শিক্ষার হার ও গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ তার দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশিদেরই শুধু নয়, অনেক উন্নত দেশকেও ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আপনাদের স্মরণ আছে, গত বছর সরকার গঠনের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণে আমি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শোধরানোর আহ্বান জানিয়েছিলাম। আমি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করি। মানুষের কল্যাণের জন্য আমি যেকোনো পদক্ষেপ করতে দ্বিধা করব না।
- প্রতিশোধের ১৩ রূপরেখার দুর্বলটিও হবে ঐতিহাসিক দুঃস্বপ্ন : ইরান
- নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প
তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতি আহ্বান থাকবে, যেই অবৈধ সম্পদ অর্জনের সঙ্গে জড়িত থাকুক, তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসুন। সাধারণ মানুষের ‘হক’ যাতে কেউ কেড়ে নিতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করছি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির নির্মূল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দুর্নীতি বন্ধে জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। মানুষ সচেতন হলে, দুর্নীতি আপনা-আপনি কমে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার রোধে আমাদের পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। দেশবাসী এজন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।
তিনি বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠনের এক বছর পূর্ণ হলো। বিগত এক বছর আমরা চেষ্টা করেছি আপনাদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে। আমরা সবক্ষেত্রে শতভাগ সফল হয়েছি তা দাবি করবো না। কিন্তু এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। অতীতের ভুল-ভ্রান্তি এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব। আমাদের সামনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে। সকলের সহযোগিতায় আমরা সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবো, ইনশাআল্লাহ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাধারণ মানুষকে ঘিরেই আমার সকল কার্যক্রম। আপনাদের ওপর আমরা পূর্ণ আস্থা রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ অসাধারণ পরিশ্রমী এবং উদ্ভাবন-ক্ষমতাসম্পন্ন। যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে তারা নিজেদের মানিয়ে নিতে সক্ষম। অল্পতেই সন্তষ্ট এ দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। জাতির পিতা আজীবন সংগ্রাম করেছেন এসব মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। তার কন্যা হিসেবে আমার জীবনেরও একমাত্র লক্ষ্য মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আমার ওপর ভরসা রাখুন। আমি আপনাদেরই একজন হয়ে থাকতে চাই।