নতুন বছরে পুরনো চ্যালেঞ্জ সফল মোকাবেলা দরকার

আহমদ রফিক

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক। ফাইল ছবি

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন মূলত একদলীয় ধারায় চলছে। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে যে দ্বিদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রাধান্য, সঙ্গে দুর্বল তৃতীয় দল, গত এক দশকে তার আপাতত অবসান ঘটেছে বিএনপির ভুলত্রুটি ও বিভ্রান্তিকর রাজনীতির প্রতিক্রিয়ায়। যদিও দেশ চলছে সংসদীয় রাজনীতির তরিকায়, কিন্তু শক্তিশালী বিরোধী দল বলতে রাজনৈতিক ভুবনে কারো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এটা গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য সুখবর নয়, কিন্তু ঘটনার অনিবার্য টানে পরিস্থিতি এমন অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে।

এখন সময় ঘণ্টা বাজাল ২০২০ সালের আগমন ঘোষণায়। গেল বছরটা অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনা ও অশান্তির মধ্য দিয়ে পার হলো, অনেক অপূর্ণতা ও স্ববিরোধিতা নিয়ে। বছর শেষের বড় ঘটনা বহু প্রত্যাশিত আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠন একাধিক অঙ্গসংগঠনসহ, বহু আকাঙ্ক্ষিত সম্মেলন, নতুনত্ব-অভিনবত্বের বহু প্রত্যাশা নিয়ে। দলীয় নেতৃত্বে শান্তি ও সহাবস্থানের পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও অনেক প্রাজ্ঞ, মননশীল সমর্থকের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। পূরণ হয়নি যেমন নতুনত্বের প্রত্যাশা, তেমনি তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসংক্রান্ত বিষয় নিয়েও।

এদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের জন্মসময় পর্ব বা তারুণ্য-যৌবনের দিনগুলোর দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে পূর্বোক্ত ভাবনার শরিক এবং তা তুলনামূলক বিবেচনায়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাজনে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে শুরু থেকেই যে দুঃশাসন, তার প্রতিক্রিয়ায় অনেক বাধাবিপত্তির মুখে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার লক্ষ্য নিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার ভাবনায় আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে। নামে ‘মুসলিম’ শব্দটি ঢুকেছিল রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে, যেমন ছাত্রলীগে। বিষয়টি নিয়ে ছিল যথেষ্ট বিতর্ক।

এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানীর আদর্শিক লক্ষ্য ছিল জনবান্ধব রাজনীতি, মূলত নিম্নবর্গীয়ভিত্তিক এবং মুসলিম লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জবাবদিহিমূলক দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠা। অন্যদিকে তাঁর অনুজপ্রতিম সহযোগীদের রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তি ছিল জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্র এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণিস্বার্থের প্রাধান্যে। এখানে ছিল সংখ্যাধিক্য। এখানে যুক্ত হয় সংসদীয় রাজনীতিভিত্তিক শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরাশক্তি মার্কিন-প্রীতির নামে শূন্যতত্ত্ব। এভাবে আদর্শিক বিভাজন গোড়া থেকেই এবং তা একাধিক মাত্রায়। সোহরাওয়ার্দীহীন আওয়ামী লীগে মূলত ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদই শক্তিমান মতাদর্শ হয়ে দাঁড়ায়। দলের এ স্ববিরোধী সাংগঠনিক চরিত্রের প্রেক্ষাপট উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক নয়।

দুই.

দল যখন শক্তিমান নেতৃত্বে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে তখন তার শ্রেণি-চরিত্র প্রকট হয়ে ওঠারই কথা, হোক তা মূল দলে বা অঙ্গসংগঠনে। সামাজিক বিচারে অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি তাই অতি স্বল্পসংখ্যকের ভার্টিকাল চরিত্রে। দলীয় প্রসাদভোগী অঙ্গসংগঠনে যখন ন্যায়নীতির অভাব ও দুর্নীতির প্রভাব প্রকট হয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তখন তার বিরুদ্ধে অভিযান চালনা স্বাভাবিক ও অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। ঘোষণা ও প্রচার যথেষ্ট মাত্রায়। সম্প্রতি এটাই ঘটেছে গত বছরের শেষার্ধে। এ প্রচেষ্টা জনমত আকর্ষণ করেছে।

নতুন বছরে, নতুনভাবে সংগঠিত দল ও অঙ্গসংগঠন নিয়ে আওয়ামী লীগের নবযাত্রায় সংগত কারণে জনগণের অনেক প্রত্যাশা। প্রত্যাশা যেমন সাধারণ চরিত্রের তথা মসৃণ জীবন নির্বাহে, তেমনি শ্রেণিগতভাবেও। আর সেসব পূরণ করতে, অংশত হলেও অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে সরকারকে প্রত্যক্ষভাবে, দলকে পরোক্ষভাবে।

এসব নিয়ে এর মধ্যেই সমাজে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেছে, যেমন প্রতিপক্ষে তেমনি সহমর্মিতার পরামর্শে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প ও একাধিক খাতে যখন বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার স্বীকৃতি মিলছে তখন সেই শীর্ষ মুহূর্তে গত বছর দেখা গেল দুর্নীতির ব্যাপক অশনিসংকেত এবং যুবলীগ-ছাত্রলীগের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসীপনার চরম প্রকাশ, যা ‘টক অব দ্য সিটি’ হয়ে দাঁড়ায়।

যুবলীগ নেতার আসল নামের স্থান দখল করে নেয় রাজকীয় শব্দ ‘সম্রাট’, কী তার রাজকীয় অবস্থান ও আচরণ। অনুরূপ মহিমার প্রকাশ ঘটায় ছাত্রলীগের নেতা খালেদ মাহমুদ এবং অনুরূপ আরো কেউ কেউ। উদ্ঘাটিত হয় অনৈতিক ক্যাসিনোকাণ্ড—অনৈতিকতা, চাঁদাবাজি, অর্থপাচার থেকে পুলিশি প্রশ্রয় এবং কিছুসংখ্যক জাতীয় নেতার প্রশ্রয়-আশ্রয়। সমালোচনার ঢেউ ওঠে, যা মূল দলের ভাবমূর্তি স্পর্শ করে।

রাজধানী থেকে দেশের সর্বত্র একই আলোচনা, বিশেষ করে ক্যাসিনোকাণ্ডের অনৈতিকতা ও ব্যাপক দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে। প্রকৃতপক্ষে ২০১৯ সালের শেষ দিকে সমাজে সর্বত্র এবং সংবাদপত্রে এ আলোচনাই প্রাধান্য পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শুরু হয় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, দলে শুদ্ধি অভিযান। মানুষের মনে ইতিবাচক প্রত্যাশা জন্ম নেয়।

তিন.

তবে গত বছরের সবচেয়ে আলোচিত জনভোগান্তির বিষয়টি ছিল অনিয়ন্ত্রিত বাজার, ভোগাপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, আর পেঁয়াজের অস্বাভাবিক অবিশ্বাস্য মূল্যবৃদ্ধি—৪০ টাকা থেকে কেজি ২৫০ টাকা। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এনবিআর গোয়েন্দাদের মাঠপর্যায়ে অভিযান। কিন্তু ভোগান্তির সুরাহা সামান্য সরকারের ব্যাপক আমদানি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও। অভিযোগ উঠেছে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কয়েক শ কোটি টাকা মুনাফার, শুধু পেঁয়াজ নিয়ে এবং সে অর্থের সন্ধান মেলেনি।

এমনি একাধিক খাতের সমস্যা সামনে নিয়ে বর্ষশেষ (২০১৯), আওয়ামী লীগের নববিন্যাসে নতুন করে নববর্ষে প্রবেশ। নতুন বছরে নববিন্যস্ত দল নিয়ে অনেকের অনেক প্রত্যাশা। বিশ্লেষকদের মতে, নতুন বছরের সে প্রত্যাশা পূরণে রয়েছে বাধাবিপত্তি—এককথায় সরকারকে জনতুষ্টির জন্য অনেক চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে, তা খুব সহজ হবে না যদি দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব আদর্শিক বিচারে কঠিন কঠোর না হয়।

যেকোনো যুক্তিবাদী মানুষই মানবেন বহু কথিত আপ্তবাক্য—দুর্নীতি সব উন্নতিকে গ্রাস করে এবং তা মূলত জাতীয় ক্ষেত্রে ও রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে। এই দুর্নীতির নানা মাত্রা, নানা পার্শ্বমুখ, যা নানা খাতে প্রসারিত। এবং যা সব শেষে ক্ষুদ্র শ্রেণিবিশেষকে স্ফীতকায় অনাচারী দানবে পরিণত করে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবাদীদের বিচারে সে দেশে তা যদি ১ শতাংশ হয়ে থাকে, বাংলাদেশে নাকি তা ৫ শতাংশ। শতাংশ বিচার বড় কথা নয়, বড় কথা তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থশক্তি, যা ব্যাপকতায় থাবা বিস্তারে সক্ষম। অর্থাৎ সব খাতে তার নিয়ন্ত্রণ এবং বহুমুখী তার তৎপরতা ও বিস্তার। যেমন—বৃহৎ থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিল্পোদ্যোগে, মুদ্রাবাজারে-শেয়ারবাজারে, ব্যাংকিং খাতে, এমনকি শিক্ষা কার্যক্রম ও কর্মসূচি থেকে শিক্ষা বাণিজ্যে।

অন্যদিকে বিন্দুমাত্র স্বস্তি নেই পরিবহনব্যবস্থায়। সড়ক-মহাসড়ক যাত্রা নিরাপদ করতে অনেক আন্দোলন হলো, যেমন শিক্ষার্থীদের, তেমনি বিশেষ শ্রেণির মানুষের, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের। সব কিছু অতিক্রম করে মানুষের সড়কযাত্রা মৃত্যুমুখী ও বিপজ্জনকই রয়ে গেল—কী উৎসবে, কী নিয়মিত, দৈনন্দিন যাত্রায়। এ সমস্যাটিকে গুরুত্বহীন মনে করার কোনো কারণ নেই জনবান্ধব সরকারের পক্ষে।

চার.

সমস্যাগুলো আজকের নয়, বছর পেরিয়ে অব্যাহত বলেই প্রতি নতুন বছরে মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সরকারকে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়। কোনোটার সুরাহা হয়, কোনোটার হয় না। আমাদের সামাজিক দায় সমস্যার সমাধানে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। নতুন বছরে পৌঁছেও দেখা যাচ্ছে পরিবহন খাতের নৈরাজ্য তেমনই চলছে। প্রায় প্রতিদিন দৈনিকগুলোতে সড়কে মৃত্যুর খবর। একটি দৈনিকে খবর : ‘সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু দুটোই বেড়েছে’। সরকার কি নতুন সড়ক আইন প্রয়োগে কঠোর হতে পারে না? বাধা কোথায়, কোন দিক থেকে।

তেমনি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে তাদের গুদামে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সংগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পেঁয়াজের দাম হঠাৎ লাভ দিয়ে ২০০ টাকা কেজিতে চড়ে যায় কিভাবে? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবতে পারে না কেন? আবারও বলতে হয়, বাধা কোথায়? নাকি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে অপারগ সরকার?

এবার এমন একটি প্রসঙ্গে যেতে চাই, যেটা আমার বিষয় নয়; কিন্তু নিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদকেও দেখা যাচ্ছে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতে। বাংলাদেশ ব্যাংক নানা দুর্বলতায় সমস্যা-জটিলই হয়ে রয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে যেমন অর্থ খাতে, তেমনি ব্যাংকিং পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায়। খ্যাতনামা ব্যাংকার ইব্রাহিম খালেদের ভাষায় : ‘আমাদের অর্জন আশাব্যঞ্জক নয়।’ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া কি সম্প্রতি অ্যাওয়ার্ড পাওয়া অর্থমন্ত্রীর পক্ষে অসম্ভব?

অনেক কথা বলার ছিল, যা সরকারের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ, যার অন্তত কিছু সরকার কঠিন হাতে সফলভাবে মোকাবেলা করতে পারে। যেমন—সামাজিক-রাজনৈতিক খাতে দুর্নীতি দমন, যা অগ্রাধিকারভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি রাখে। যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছিল গত বছরের শেষার্ধে, এ বছর তা পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় হলে বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হতে পারে—চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, বিদেশে মুদ্রাপাচার, গুম, হত্যা ইত্যাদি।

কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সম্পর্কে একটি খবর হতাশাব্যঞ্জক : ‘অভিযান থেমে গেছে/অভিযুক্তরা ফিরছেন’। বিশদ বিবরণ অনাবশ্যক। কারণ বিষয়টি এর আগেই আলোচিত হওয়ার আলামত দেখাচ্ছে। ‘ক্যাসিনো সাঈদ নির্বাচনে লড়ছেন’ কিভাবে? শাসনব্যবস্থাকে কি দুর্নীতিমুক্ত করতে চাইবে না আওয়ামী লীগ? জনাকয়েককে কারাগারে পাঠিয়ে সব রক্ষা হবে না। তাই দরকার দুর্নীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে।

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে