মুখ দিয়ে লিখেই গ্র্যাজুয়েট হাফিজুর রহমান

ক্যাম্পাস ডেস্ক

হাফিজুর রহমান

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) সমাবর্তন নিতে যাওয়া আর সব গ্র্যাজুয়েটদের মতো নয় হাফিজুর রহমানের জীবন। কারণ হাত-পা বিকলাঙ্গ হওয়ায় এই অদম্য তরুণ মুখ দিয়ে লিখেই স্নাতক-স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।

প্রথমবারের মতো সমাবর্তনকে ঘিরে গ্র্যাজুয়েটদের পদচারণায় মুখর জবি ক্যাম্পাস। নিজ নিজ বিভাগ থেকে সমাবর্তনের উপহার সামগ্রী নিয়ে সবাই আনন্দভরা মন নিয়ে ফটোসেশন করছেন। সহপাঠীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিচারণ করছেন।

universel cardiac hospital

তবে অন্যদের মতো এদিক ওদিক ছুটতে পারেননি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে স্নাতোকত্তর করা হাফিজুর। সহপাঠীদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাধা ছিল তার হাত-পা না থাকা। জন্ম থেকে বিকলাঙ্গ হাফিজুর ক্যাম্পাসের মূল ফটকের পাশে হুইলচেয়ারে বসে অপলক দৃষ্টিতে দেখছেন সবাইকে। পরিচিতজনরা ছাড়াও অনেকে তাকে সমাবর্তনের গাউন, ক্যাপ পরা দেখে এগিয়ে আসছেন ছবি তুলতে, কুশলবিনিময় করতে। আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চশিক্ষার সনদ নিয়ে যখন সবাই ছড়িয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখছেন কর্মজীবনে প্রবেশের তখন হাফিজুরের মনে অজানা আতঙ্ক ভবিষ্যৎ নিয়ে। কারণ এখনো কোথাও চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেননি। সেই সুযোগ পাবেন কি না, কীভাবে পাবেন তাও অজানা।

এর মধ্যেও প্রথম সমাবর্তন নিয়ে হাফিজুর উচ্ছ্বসিত। তিন বলেন, ‘অন্যদের মতো আমিও আনন্দিত। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও মানসিক শক্তির জোরে এবং শিক্ষক, সহপাঠীদের সহযোগিতায় উচ্চশিক্ষা নেয়ার সুযোগ পেয়েছি। আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ পাব এই অনুভূতি বোঝানো যাবে না।’

শনিবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার ১৪ বছর পর হতে যাচ্ছে এই বিশাল আয়োজন।

১৯৯৩ সালে বগুড়া জেলার ধুনট থানার বেলকুচি গ্রামে জন্ম নেন হাফিজুর। বাবা মফিজ উদ্দিন একজন কৃষক। মা ফিরোজা বেগম গৃহিণী। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। সম্প্রতি বাবা হারিয়েছেন হাফিজুর।

বিকল দুই হাত ও দুই পা নিয়ে ছোটবেলায় বাবার কাছেই ‘বর্ণ পরিচয়’ শেখা হাফিজুরের। পরে বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ব্র্যাক স্কুলে শুরু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন। সে সময় বেয়ারিংয়ের গাড়িতে করে সহপাঠীরা স্কুলে নিয়ে যেত তাকে। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পা দিয়ে লিখেছেন হাফিজুর।

এভাবেই স্কুলে যাওয়া-আসার মধ্যে ২০০৯ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪.১৯ পেয়ে উত্তীর্ণ হন হাফিজুর। পরে ধুনট ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১১ সালে এইচএসসিতে পান জিপিএ ৩.৬০। সুশিক্ষিত হওয়ার প্রয়াস নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য এরপর ঢাকায় পাড়ি জমায় এই তরুণ।

কোনো প্রকার কোচিং ছাড়াই ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তি হন হাফিজুর। অচেনা এই নগরীতে একাকী লড়াই শুরু সংগ্রাম হয় তার। পরীক্ষার হলে মেঝেতে পাটিতে বসে ছোট টুলে খাতা রেখে মুখ দিয়ে লিখে পরীক্ষা দিয়েছেন এই শিক্ষার্থী। এভাবে ধীরে ধীরে উত্তীর্ণ হন অনার্স এবং মাস্টার্সে।

সুস্থ ও স্বাভাবিক সহপাঠীদের থেকেও বেশ ভালো ফলাফল করেছেন হাফিজুর। অনার্সে সিজিপিএ-৪ এর মধ্যে পেয়েছেন জিপিএ ৩.০১। মাস্টার্সে পেয়েছেন জিপিএ-৩.০৬। তার এই রেজাল্টে খুশি বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। মুখ দিয়ে লিখে উচ্চশিক্ষা নেয়ার ঘটনা দেশে আর আছে কি না জানা নেই।

তবে তার এই দীর্ঘ পথচলা মোটেও মসৃণ ছিল না। কীভাবে নিজের পড়াশোনা, থাকা-খাওয়ার খরচ মেটাবেন তা নিয়ে মাথায় চিন্তার পাহাড় ছিল হাফিজের। বাড়িতেও সহযোগিতা করার দায়িত্ব ছিল কাঁধে। কারণ চার ভাইয়ের মধ্যে বাকিরা সবাই বিয়ে করে তাদের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। কেউ বাবা-মাকে সাহায্য করার ছিল না।

আবার একা একা চলতে না পারার অক্ষমতা তো ছিলই। কখনো বন্ধুরা সহযোগিতা করলেও সার্বক্ষণিক সহযোগিতার জন্য নিয়ে আসেন ভাতিজাকে। ভাতিজাই এখন তার সব সময়ের সঙ্গী। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় ক্যাম্পাসের মূল ফটকের পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো সংবলিত ব্যাগ, টি-শার্ট, হুডি, ব্যাজ বিক্রি শুরু করেন হাফিজুর। সঙ্গে নিজ জেলা বগুড়ার দইও বিক্রয় করেন তিনি। এ কাজে ভাতিজার পাশাপাশি তার বন্ধুদেরও সহযোগিতা পেয়েছেন বলে জানালেন হাফিজুর।

দুর্গম এই পথ পাড়ি দেয়া হাফিজুর বললেন, ‘আজকে আমি যখন সমাবর্তনে অংশ নিচ্ছি এটা শুনে আমার গ্রামের বন্ধুরা খুব খুশি। তারা বলছে আমি এলাকার গর্ব। এটা শুনে সত্যি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।’ তবে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে নিজের শিক্ষা সনদ নেয়ার সুযোগ পেলে নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে করবেন তিনি।

এতসব সংগ্রামের মাঝেও উচ্চ শিক্ষিত হাফিজুর স্বপ্ন দেখেন একটি ভালো সরকারি চাকরির। এজন্য নিজেকে প্রস্তুতও করছেন। তবে কতটুকু এগুতে পারবেন তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ অতীতে অনেকের সহযোগিতা পেলেও ধীরে ধীরে কেউ কেউ হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। আবার নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরে সেকশন অফিসারের পদের জন্য আবেদন জানালেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাননি তিনি। মাঝে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও নিজের জীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরে দীর্ঘ চিঠি দিয়েছিলেন সেখান থেকেও কোনো সাড়া মেলেনি।

গণমাধ্যমকে হাফিজুর বলেন, ‘যদি আমাকে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো চাকরি দেওয়া হয় তবে আমার ও আমার পরিবারের জন্য বড় উপকার হয়। আর অন্য কোথাও যদি কোনো ব্যবস্থা হয় আমি আশা করি তাদের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হব।’

হাফিজুর বলেন, ‘একসময় সবাই বলত আমার পক্ষে উচ্চশিক্ষা নেয়া সম্ভব নয়, হাল ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো পরিকল্পনা করতে। কিন্তু আজ আমি মাস্টার্স সম্পন্ন করেছি।’

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উদ্দেশে হাফিজুর বলেন, ‘আমাদের উচিত লক্ষ্য স্থির করা। তাহলে আমরা সমাজের বোঝা হয়ে থাকব না। আমরা প্রতিযোগিতায় সাধারণ মানুষের মতোই অংশগ্রহণ করতে চাই। আর মস্তিষ্ক যদি কারো প্রতিবন্ধী না হয় তাহলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কিছুই নয়।’

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে